বাঘ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরাও তুলনামূলক কম জানেন। আর সুন্দরবনের বাঘেদের বিষয়েও তো বিজ্ঞান তেমন কিছুই জানে না। তারা খুব গোপনে থাকে, সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না, এমনকি এক পলকের জন্যও নয়। বাঘের বিচরণ ক্ষেত্রও বিশাল। নেপালে একটি পুরুষ বাঘ ২৩ থেকে ২৭ বর্গমাইল পর্যন্ত এলাকায় বিচরণ করে থাকে, আর বাঘিনীর ক্ষেত্রে তা ছয় থেকে আট মাইল, সাইবেরিয়ায় খাবারের সংস্থান কম বলে বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র ১ হাজার ৫৪৪ বর্গমাইল পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বাঘেরা চাতুর্যের সঙ্গে জীবনযাপন করে। তারা শিকারে ধীর এবং দ্রুতগতি অবলম্বন করে। এই দক্ষতা একেবারেই ব্যতিক্রম; শিকারি যেন বুঝে না ফেলে সে জন্য অবশ্যই ধীর হতে হবে একইসঙ্গে শিকার যেন বাঘকে দেখে না ফেলে সে জন্য ততটাই সতর্ক থাকতে হয়।
বিশ্বের অন্যান্য বাঘের তুলনায় সুন্দরবনের বাঘগুলো অনন্য। ভারত উপমহাদেশ জুড়ে একই জিনের অধিকারী বাঘ- রয়েল বেঙ্গল টাইগার পাওয়া যায়, যা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাঘের প্রজাতি (সবচেয়ে বেশিসংখ্যায় বাঘ পাওয়া যায় সার্বিয়ায়, যাদের শরীর অনেকটা আগুনরাঙা)। সুন্দরবনের বাঘগুলোর আচরণেও রয়েছে কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য, বস্তুত বিশ্বের আর কোনো প্রজাতির শিকারি প্রাণী তাদের মতো করে মানুষ খেয়ে বেড়ায় না।
এত দিন সুন্দরবনে বাঘ গণনা হত বাঘের পায়ের ছাপ দেখে, গলায় রেডিও কলার লাগিয়ে অথবা জঙ্গলে ক্যামেরা ট্রাকিং করে। তবে সেই পদ্ধতিতে বেশ কিছুটা বদল আনা হয়েছে। যেমন, বাঘের পায়ের ছাপ গণ্য হবে না। নৌকোয় করে বিভিন্ন নদী, খাঁড়ি, জঙ্গলে বাঘের খাদ্য তৃণভোজী প্রাণী হরিণ, বুনো শূয়োর-সহ বিভিন্ন জন্তুর সমীক্ষা করা হয় এখন। এছাড়া বাঘের মল, মূত্র, গাছের গায়ে আঁচড়-সহ অন্যান্য চিহ্ন সংগ্রহ করা হবে, জঙ্গলের আশেপাশে বাঘের থাকার উপযোগী হেতাল, গরান, গেঁওয়া গাছের হদিস করা হবে।
এছাড়া, সুন্দরবনের বাঘের জিনগত বৈশিষ্ঠ্য বুঝতেও তাদের মল-মূত্র বিজ্ঞানীদের বিশেষ সহায়তা করে।
বাঘের মল-মূত্রের ভিন্নধর্মী ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়। যেমন, কিছুদিন আগে পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে জঙ্গি আস্তানায় চালানো ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযান সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সময় অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে চিতাবাঘের মল-মূত্র ব্যবহার করা হয়েছিল।
দুই বছর আগে পাকিস্তানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালানো এই অভিযানের অন্যতম সদস্য জম্মু-কাশ্মিরের নওসেরা সেক্টরের সাবেক ব্রিগেড কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাজন্দ্র নিমবোরকর এ তথ্য জানিয়েছেন।
নিমবোরকর বলেন, অভিযানের আগে তিনি পুরো এলাকার খুঁটিনাটি জেনে নিয়েছিলেন। সেক্টরে থাকাকালীন আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছিল, ওই এলাকায় কুকুরের উপর হামলা চালায় চিতাবাঘের দল। ভয়ে রাতের দিকে এলাকার বাইরে বেরোয় না কুকুর।
তিনি বলেন, রণনীতি ঠিক করার সময় আমরা জানতাম ওই রুটে গ্রামে ঢোকার সময় কুকুর চিৎকার করে উঠবে। কুকুরের হামলা ঠেকাতে চিতাবাঘের মল ও মূত্র সঙ্গে নেয়া হয়েছিল। গ্রামের বাইরে তা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়া হয়। এটা ভালো কাজে দেয়। কুকুর চুপচাপ গ্রামের ভেতরেই ছিল।
বাঘ দিবসে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণকর্মী ইসমে আজম বাঘের মলের ছবি শেয়ার করেছেন।
তিনি বলেছেন, ছবিটি বাঘের মলের। বাঘের উপস্থিতি, অবস্থান, শিকার সহ জীবন বৃত্তান্ত জানতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাঘের মল বা গু। একসময় সমগ্র সুন্দরবন জুড়ে চষে বেড়িয়েছিলাম বাঘের এই মল বা গুয়ের সন্ধানে। তাই মল বা গু বলে অবহেলা বা তাচ্ছিল্য করবেন না। গু দেখে বাঘ চেনা যায়!
২০২০ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে ২০১০ সালে প্রথম চালু হয় বিশ্ব বাঘ দিবস। আজ ২৯ জুলাই (বুধবার) ২০২০ সালের সেই দিনটি এসেছে। পৃথিবীর অন্য অঞ্চলে বিপন্ন বাঘ সংরক্ষণে যেমন উদ্যোগই থাকুক না কেন, সুন্দরবনে এজন্য অনেক প্রকল্প হাতে নিয়ে এবং এক দশক ধরে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হলেও বাঘের সংখ্যার উন্নয়ন ঘটেনি। ১৯৭৫ সালে আনুমানিক ধারণা ছিল সুন্দরবনে বাঘ রয়েছে ৩৭৫টি, ১৯৮৪ সালে গবেষণালব্ধ এই ধারণা ছিল ৪৫০টির মতো। আর ১৯৯২-৯৩ সালের জরিপে এই সংখ্যা ছিল ৩৬২টি। তবে এখন সর্বশেষ গবেষণায় ১১৪টির বেশি বাঘের তথ্য নেই বন বিভাগের হাতে। এ অবস্থায় এক দশকের বাঘ দ্বিগুণের লক্ষ্যে নেওয়া বিশ্ব বাঘ দিবসের অনুষ্ঠানে বড় করুণ মুখে আগের সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ থাকার তথ্য দিয়ে নতুন কী কর্মসূচি নেবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, সেটাই এখন দেখার।
বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবন হচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল। সুন্দরবনের ৬২ শতাংশ বনাঞ্চল বাংলাদেশের মধ্যে পড়েছে। এ বনের জল-স্থলে বাঘের জন্য রয়েছে প্রচুর বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য হরিণ, বানর, কাঠবিড়ালি, গিরগিটি, শুশুক, ভোঁদড়, কুমির ইত্যাদি।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা জরিপের তথ্য উল্লেখ করে বলছেন, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের ৬ হাজার বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ৪ হাজার ৮৩২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাঘ বিচরণ করে। এদের বিচরণের প্রধান ক্ষেত্র বাগেরহাটের কটকা, কচিখালী ও সুপতিসহ খুলনার নীলকমল, পাটকোষ্টা ও গেওয়াখালী এবং সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ, দোবেকি ও কৈখালী এলাকা।
সর্বশেষ বাঘশুমারিতে ক্যামেরার সামনে দিয়ে বাঘ চলাচল করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার ছবি পাওয়া যায়। পরে এসব ছবি বিশ্লেষণ করে বাঘের সংখ্যা নিরূপণ করা হয়। সর্বশেষ এই জরিপে সুন্দরবনের ২৩৯টি জায়গায় গাছের সঙ্গে ৪৯১টি ক্যামেরা লাগানো হয়েছিল। ২৪৯ দিন ধরে চালু রাখা ক্যামেরাগুলোতে বাঘের ২,৫০০টি ছবি পাওয়া যায়। ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা ১১৪টি বাঘ থাকার কথা অনুমান করেছেন। বাঘের প্রকৃত সংখ্যা বন বিভাগের কাছে নেই।
তবে বাঘের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ প্রায় অসম্ভব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফিরোজ জামান এ বিষয়ে ২০১৭ সালে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছিলেন, কয়েক স্তরের জরিপ ছাড়া কেবল একটা দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করে কী সংখ্যক বাঘ রয়েছে তা নিরূপণ সম্ভব নয়। ফলে একেকবার একেকরকম তথ্য পাওয়া গেছে।