মাহবুব পিয়াল, ফরিদপুর :
উচ্ছ্বিষ্ট বজর্য থেকে ট্রাইকো-কম্পোস্ট প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে জৈব সার উৎপাদন করে মাসে প্রায় দুই লাখ টাকা আয় করছেন ফরিদপুরের আব্দুল কাইয়ূম খান (৪০) নামে এক উদ্যোক্তা। পাশাপাশি প্রায় ২৫ টি পরিবার স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে তার এই কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত থেকে।
জেলা সদরের অম্বিকাপুর ইউনিয়নের দ্বিরাজতুল্লাহ মাতুব্বরের ডাঙ্গী এলাকার ছমির শেখের বাজার সংলগ্ন প্রায় এক একর জায়গা জুড়ে ডিআরকে এগ্রো নামে জৈব সার উৎপাদনের কারখানাটি গড়ে তুলেছেন তিনি । ২০২১ সালে স্বল্প পরিসরে ও স্বল্প পুঁজি নিয়ে শুরু করেন। বর্তমানে দুটি এনজিওর সহযোগিতায় প্রায় ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে বিশাল কর্মযজ্ঞে রুপান্তরিত করেছেন। পঁচিশজন জন শ্রমিক সেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করছেন। শ্রমিকদের পারিশ্রমিক ও উৎপাদনের খরচ বাদে মাসে প্রায় দুই লাখ টাকা আয় করছেন এই উদ্যোক্তা।
আব্দুল কাইয়ূম খান দ্বিরাজতুল্লাহ মাতুব্বরের ডাঙ্গী গ্রামের মোঃ রেজা খানের পুত্র। দুই ভাই ও একবোনের মধ্যে সকলের বড় তিনি। প্রথমে জেলা শহরের নিউমার্কেট এলাকায় পোশাক বিক্রেতা ছিলেন। করোনাকালীন সে ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিকল্প এই ব্যবসার উদ্যোগ নেন। নানা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও শুরুর মাত্র ৪ বছরের মধ্যেই সফলতা পেয়েছেন।
এই উদ্যোক্তা বলেন, মানুষ যা ফেলে দেয় তা আমি কাজে লাগিয়ে থাকি। আমি পরিবেশ থেকে উচ্ছ্বিষ্ট সকলকিছু একত্রিত করে থাকি। মাটি ও মানুষের সুস্থ্যতার জন্য এই উদ্যোগ বেঁছে নিয়েছি। মানুষ যেন প্রাকৃতিক উপায়ে ভেজালমুক্ত খাবার খেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এই ব্যবসার মধ্যে দিয়ে বর্তমানে আল্লাহ আমাকে অনেক ভালো রেখেছেন। আগের কাপড়ের ব্যবসা থেকে এখানে সফলতা পেয়েছি। শুধু আমিই নই, আমার এখানে কাজ করে আরও ২৫টি হতদরিদ্র পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিভিন্ন এলাকা ও কারখানা থেকে গরুর গোবর, হঁাস-মুরগির বিষ্টা, পয়ঃবজর্য, জুটমিলের বজর্য, লিটার জাতীয় বজর্যসহ উচ্ছ্বিষ্ট বজর্য সংগ্রহ করে এনে স্তুপ করে রাখা হয়েছে। প্রতি পঁাচটন বজের্য এক কেজি ট্রাইকোড্রামা দিয়ে ৪০-৪৫ দিন স্তুপ করে রাখেন। এরপর তা ক্রাস মেশিনের মাধ্যমে সংমিশ্রণ করা হয় এবং সেখান থেকে গুড়ো জাতীয় উপাদান আলাদা করে বাজারজাতকরণে প্যাকেট করা হচ্ছে।
বর্তমানে তার কারখানা থেকে প্রতিমাসে ৩০০ মেট্রিক টন জৈব সার উৎপাদন করা হচ্ছে। স্থানীয় কৃষকদের চাহিদা মিটিয়েও সার ব্যবসায়ীদের ও একটি বেসরকারি কোম্পানিকে জৈব সার সরবরাহ করছেন।
তিনি বলেন, রায়সায়নিক সার থেকে কমমূল্যে আমি কৃষকদের কাছে জৈব সার বিক্রি করে আসছি। যাতে তারা কম খরচের মধ্যে সবজি ও ফসল উৎপাদন করতে পারে। সেজন্য জৈব সারের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি আমি একটি কোম্পানিকেও সার দিচ্ছি। ভবিষ্যতে আমার এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য কৃষি কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ ও সহযোগিতা কামনা করছি।
তার এই কারখানায় কাজ করেন লোকমান শেখ নামে এক প্রতিবন্ধি ব্যক্তি। লাঠিতে ভর করেই দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, আগে অনেক কষ্ট করেছি, কারো সহযোগিতা তেমন পাইনি। ইনশাল্লাহ এখানে কাজ আমার পরিবার নিয়ে ভালোভাবে জীবন যাপন করছি। আমরা চাই তার এই প্রতিষ্ঠান আরও বড় হোক। আমার মতো অনেকেই যেন এখানে কাজ করার সুযোগ পায়।
গ্রামের মধ্যে এমন কর্মযজ্ঞ দেখে সন্তুষ্ট স্থানীয় বাসিন্দারাও। তারাও প্রাকৃতিকভাবে তৈরি এই জৈব সার ব্যবহার করে উপকৃত হয়েছেন বলে জানান। স্থানীয় কৃষক আব্দুল মালেক বেপারী বলেন, রাসায়নিক সার বুনতে বুনতে জমি কয়লার মতো হয়ে গেছে। যে পরিমাণ সার দেয়া হয়, প্রতিবছর সেই পরিমাণ থেকে বাড়িয়ে দেয়া হয়। এতে জমির ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু জৈব সারে ফসলও ভালো হয়, মাটিও ভালো থাকে। লালমাটি কালো হয়ে যায় এবং মাটি কালো হলেই ফসল ভালো হয়। একারনে বর্তমানে আমরা হাতের কাছে পেয়ে জৈব সার ব্যবহার করে আসছি।
উদ্যোক্তা আব্দুল কাইয়ূম খানের এই কর্মযজ্ঞে পাশে থাকার আশ্বস্ত করেছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ নুরুল আমিন। তিনি বলেন, আমার এলাকায় এই কারখানাটি গড়ে তোলায় এলাকার কৃষকেরা উপকৃত হচ্ছে। তাকে পরিবেশসম্মতভাবে কারখানাটি চালানোর অনুরোধ করব এবং সরকারিভাবে সকল ধরনের সহযোগিতার জন্য আমি তার পাশে থাকব।
এই ট্রাইকো-কম্পোস্ট ব্যবহারে কৃষকেরা বেশি লাভবান ও উপকৃত হবে বলে জানান ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাসায়নিক সার থেকে ট্রাইকো-কম্পোস্টের মাধ্যমে উৎপাদিত জৈব সারে ৬ ধরনের উপাদান থাকে। যেমন, ইউরিয়া, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার ও মেগনেশিয়াম। এছাড়া ব্যাকটোরিয়ানাশক উপাদান, জৈব কার্বন ও হরমোন থাকে। এই সার কৃষকেরা ব্যবহার করলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে এবং ফসলের গুনগতমান বৃদ্ধি পাবে।
এই উদ্যোক্তাকে সকল বিষয়ে সহযোগিতা করা হবে বলে তিনি মন্তব্য করে বলেন, জেলার মধ্যে এটিই বৃহৎভাবে গড়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে নমুনা সংগ্রহ করে পরিক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে।