• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
পিরোজপুরের ভাসমান সবজি চাষ

দক্ষিণাঞ্চলের নদীবেষ্টিত জেলা পিরোজপুর। এখানকার প্রায় প্রতিটি উপজেলাতেই রয়েছে জলাবদ্ধতা সমস্যা। সমুদ্র উপকূলীয় জেলাটিতে কিছু কিছু এলাকায় পানি আটকে থাকে প্রায় সারা বছরই। প্রকৃতির সঙ্গে আপস করে প্রায় দেড় থেকে দু’শ বছর ধরেই বিকল্প ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে আসছেন স্থানীয় কৃষকরা। এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে শোনা যায়, জেলাটির নাজিরপুর উপজেলায় দেড়শ বছর আগেও ছিল ভাসমান পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি ও চারা উৎপাদন ব্যবস্থা।হাল আমলে যা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়েছে পার্শ্ববর্তী ঝালকাঠি, বরিশাল ও গোপালগঞ্জ জেলাগুলোর বিল অঞ্চলে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিরোজপুরের ৭টি উপজেলার মধ্যে শুধু নাজিরপুর ও নেছারাবাদ উপজেলাতেই ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ হয় প্রায় ২শ হেক্টর জমিতে।

স্থানীয় ভাষায় এটি ধাপ চাষ নামে পরিচিত। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) ২০১৫ সালে ভাসমান পদ্ধতির সবজি চাষকে বিশ্ব কৃষি ঐতিহ্যভুক্ত করে গ্লোবালি ইম্পটেন্ট এগ্রিকালচার হেরিটেজ সিস্টেম বলে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। তবে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষীরা আগের মতো লাভ করতে পারছেন না। এমনকি মিলছে না সম্ভাবনাময় এই কৃষিক্ষেত্রে কোন সহযোগিতাও। ফলে অনেকটাই হতাশ এ এলাকার চাষীরা। তবে কৃষি শিল্পের উন্নতি করতে চাষীদেরও প্রশিক্ষণের কথা বলছে জেলা কৃষি বিভাগ।

কথা হয় নাজিরপুর উপজেলার দেউলবাড়ী অঞ্চলের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রেমানন্দ হালদারের সঙ্গে। তিনি জানালেন ভাসমান চাষ পদ্ধতির বিভিন্ন দিক। কচুরিপানা আটকে স্তর স্তর করে ৫ ফুট উচু, প্রস্থ সারে ৪ ফুট ও ৪০ থেকে ৪৫ ফুট দৈর্ঘের একটি ধাপ তৈরি করা হয়। চারজন লোক দুদিনে একটি ধাপ তৈরি করতে পারেন। তবে অনেক সময় ধাপের দৈর্ঘ্য জমি অনুযায়ী কম-বেশী হতে পারে। ধাপ তৈরির কয়েকদিন পর যখন ধাপটি নরম হয় তখন তার উপর ‘দৌল্লা’ বসানো হয়।

টোপাপানা দুলালি লতা দিয়ে পেচিয়ে ছোট বল আকৃতিতে তৈরি করা হয় দৌল্লা। দলা দলা করে এগুলো বানানো হয় বলেই এগুলোকে স্থানীয় ভাবে ট্যামা বা দৌলা বলা হয়। বলের মাঝ খানে অংকুরোদগম বীজ বসিয়ে ছায়াতে রাখা হয় তা। বীজ ভিজিয়ে রাখলে ৫ থেকে ৭ দিনে অংকুরোদগম হয়। পাতা বের হওয়ার পর দৌল্লাগুলো ধাপের উপর রাখা হয়। সাধারণত বল বা দৌল্লা তৈরিতে কাজ করেন কৃষক পরিবারের নারীরা। এরপর সেখান থেকে গজিয়ে ওঠে চারা ও সবজি।

মুগারঝোর এলাকার সবজি চাষী ফেরদাউস হাওলাদার বলেন, এসব সবজি চারা উত্তরে মাদারীপুর থেকে পিরোজপুরসহ দক্ষিণে বরগুনা, পটুয়াখালী ঝালকাঠী, ভোলা ও বরিশালের বিভিন্ন গ্রামে। আর সবজি যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। চাষীদের ভাষ্য নাজিরপুরের তালতলা নদীর উপর দীর্ঘ ব্রীজ হওয়ার কারণে সবজি পরিবহন সহজ হয়েছে।

নাজিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দিগ্বিজয় হাজরা জানান, উপজেলার ১২০ হেক্টরে সবজি, মসল্লা ও বিভিন্ন জাতের চাড়া তৈরি হয়। চাষাবাদের জন্য জুন মাস থেকে বেড আর দৌলা তৈরির প্রস্তুতি শুরু হয়। প্রায় দেড় থেকে দু’শ বছর আগে এ অঞ্চলে এ রকম চাষাবাদ শুরু হয়।

পিরোজপুর অঞ্চলে নাজিরপুরেই প্রথম এ চাষাবাদ শুরু হয়েছে বলেও জানান এই কৃষি কর্মকর্তা। তিনি বলেন, নিম্ন এলাকায় আসলে বর্ষা মৌসুমে মানুষের যখন কোন কাজ ছিল না তখন শ্রমের সঠিক ব্যবহারে জলজ আগাছা, কচুরি পানা, শ্যাওলা, দুলালী লতা দিয়ে ভাসমান বেড তৈরি করা হয়। পিরোজপুর জেলা ছাড়িয়ে তা এখন চাষ হচ্ছে ঝালকাঠী, বরিশাল ও গোপালগঞ্জ জেলার বিলাঞ্চলে।

স্বরুপকাঠী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা চপল কৃষ্ণ নাথ জানান, এ উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের গগন, চামি, ডুবি, বিন্না এলাকার ৬০ হেক্টরে সবজির চাড়াই উৎপাদন বেশী হয়।

তবে বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে থাকার কারণে এবছর চারার তেমন চাহিদা নেই বলে জানিয়েছেন স্থানীয় নাজিরপুরের মুগারঝোর কৃষি উন্নয়ন ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা মো. শামসুল আরেফিন। তিনি জানান, অতিরোদ ও অতি বৃষ্টিতে ভাসমান সবজি ও চারার ক্ষতি হয়। তাছাড়াও ভাসমান চাষে পোকার উপদ্রব হয় কিছুটা বেশি। অন্যদিকে এবছর পানিতে বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে থাকার কারণে চারার চাহিদা কম। তাই এবছর এ পেশায় প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত কমপক্ষে ১০ হাজার চাষী বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেন।

চাষীরা বলছেন, এ ধরনের চাষ বেশ ব্যয়বহুল। তবে স্থানীয় সবজির চাহিদা মেটাতে এ ধরনের চাষ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ চাষে সরকারি প্রণোদনারও দাবি জানান তারা। মুগারজোর এলাকার ভাসমান সবজি চাষী মো. রহুল আমীন বলেন, এ চাষাবাদে আমরা কোন সরকারি সহযোগিতা পাচ্ছি না। ফলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও এনজিও’র কাছ থেকে চড়া সুদে লোন নিয়ে আমরা এই চাষাবাদ টিকিয়ে রাখছি। আমাদের (চাষিদের) স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার দাবি জানাই সরকারের কাছে।

পিরোজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক চিন্ময় রায় বলেন, চাষীদের আয় বৃদ্ধি ও ভাসমান চাষ পদ্ধতির উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা করছে সরকার। ভালো প্রশিক্ষণ পেলে চাষীরা আরো লাভবান হবে বলে আশা করছি।

ফেসবুকে লাইক দিন

তারিখ অনুযায়ী খবর

এপ্রিল ২০২৪
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
« মার্চ    
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
দুঃখিত! কপি/পেস্ট করা থেকে বিরত থাকুন।