• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ ইং
আলফাডাঙ্গায় বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি

কবীর হোসেন আলফাডাঙ্গা(ফরিদপুর) থেকে:

ও বউ ধান ভানে রে/ঢেঁকিতে পাড় দিয়া/ ঢেঁকি নাচে বউ নাচে/ হেলিয়া দুলিয়া /ও বউ ধান ভানে রে……। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য ঢেঁকি নিয়ে লেখা এ গানটিতে ঢেঁকির সাথে গ্রামীণ নারীর মধুর সম্পর্কের চিত্রটাই যেন ফুটে উঠেছে। এ ছাড়া ঢেঁকি নিয়ে বাংলা সাহিত্যে রয়েছে নানা গান ও কবিতা।

আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে প্রায় সবখানে। শহর থেকে গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান পাল্টে গেছে। মাটির বাড়ির স্থলে উঠেছে ইটের বাড়ি। কুঁড়েঘরের স্থান নিয়েছে দালান। মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো সহজ করতে তৈরি করা হয়েছে নানা আধুনিক যন্ত্রপাতি, ব্যবহার হচ্ছে নানা রকম সব প্রযুক্তি। এসব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে এক সময়কার গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য। পাল্টে গেছে গ্রামের চিত্র। এই আধুনিক যন্ত্রপাতি আর প্রযুক্তির আড়ালে চাপা পড়ে গেছে গ্রামের সেই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি।

আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি আগের মতো এখন আর চোখে পড়ে না। অথচ একসময় ঢেঁকি ছিল গ্রামীণ জনপদে চাল ও চালের গুঁড়া বা আটা তৈরি করার একমাত্র মাধ্যম। ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দে মুখরিত ছিল গ্রামীণ জনপদ। কিন্তু এখন ঢেঁকির সেই শব্দ আর শোনা যায় না। কাঠের ঢেঁকি এখন গ্রামীণ জনপদের বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য।

জানা যায়, আগে প্রায় সবার বাড়িতে ঢেঁকি ছিল। ঢেঁকিছাঁটা চাল ও চালের গুঁড়ার পিঠার গন্ধে মন জুড়িয়ে যেত। কিন্তু এখন আর তা নেই। ঢেঁকি সাধারণত বরই, বাবলা ও জামগাছের কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। সাড়ে তিন থেকে চার হাত দৈর্ঘ্য, আর পৌনে এক হাত চওড়া। মাথার দিকে একটু পুরু এবং অগ্রভাগ সরু। মাথায় বসানো থাকে এক হাত পরিমাণের কাঠের দস্তা। এর মাথায় লাগানো থাকে লোহার গুলা। এর মুখ যে নির্দিষ্ট স্থানে পড়ে সে স্থানকে গড় বলে। এই গড়ে ভেজানো চালে পাড় দিয়ে তৈরি করা হয় গুঁড়া।

সত্তরের দশকের পর ইঞ্জিনচালিত ধানভাঙা কল আমদানি শুরু হওয়ার পর গ্রামাঞ্চল থেকে ঢেঁকি বিলীন হওয়া শুরু হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তির পথে। গ্রামের মানুষ ভুলে গেছেন ঢেঁকিতে ছাঁটা চালের স্বাদ। যান্ত্রিক সভ্যতা গ্রাস করেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী কাঠের ঢেঁকি শিল্পকে।

বাঙালি জীবনাচরণের আরেকটি বড় অংশ ছিল নবান্ন উৎসব। গ্রামাঞ্চলের মানুষের ভাষ্য, গ্রামে একসময় নতুন ধান ওঠাকে কেন্দ্র করে নবান্ন উৎসব হতো। সেই উৎসবে পরিবারের শিশু-কিশোররা কত আমোদ-আহ্লাদে নাচত আর গাইত। বাঙালি জীবনের এই উৎসবটার সঙ্গেও ছিল ঢেঁকির সম্পর্ক।

ঢেঁকিতে ছাঁটা চালের আটা থেকে তৈরি হতো নানা উপাদেয় রকমারি পিঠা। বাড়ি বাড়ি পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যেত। একসময় গ্রামীণ জনপদে ‘ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া-দুলিয়া’ এ রকম নানা লোকগানের মাধ্যমে চালের গুঁড়া তৈরি করা হতো। গ্রামবাংলার নববধূ, কিষানি ও তরুণীরা নবান্ন উৎসবের জন্য বিভিন্ন ধরনের পিঠাপুলির আয়োজন করত। ঢেঁকির ঢেঁকুর-ঢুঁকুর মিষ্টি-মধুর শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মনের সুখে গান শুনতে শুনতে বৃদ্ধাদেরও চলত পান খাওয়ার আড্ডা, আজকাল যা কেবলই স্মৃতি।

আলফাডাঙ্গা পৌর এলাকার কুসুমদী গ্রামের সাবেক সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার জরিনা বেগমের বাড়িতে এখনও ঢেঁকি আছে। তার সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, বাড়ীর আশেপাশের লোকজনের সুবিধার্থে গুঁড়া তৈরি করার জন্য এ ঢেকি রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন,নিজ গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকা ছাড়াও পৌর এলাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে ঢেঁকিতে চাল গুঁড়া করার জন্য তার বাড়িতে আসেন অনেকে।

আলফাডাঙ্গা উপজেলার বুড়াইচ ইউনিয়নের কঠুরাকান্দি গ্রামের গৃহবধূ দেলে বিবি বলেন, বিয়ের পর থেকেই ঢেঁকি দিয়ে বিভিন্ন খাদ্যদ্রবাদি মাড়াই করেছি। আগে প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ঢেঁকিতে চালের আটা তৈরি করতে আসত। কিন্তু এখন আর তেমন কেউ আসে না। এখন সবাই মেশিনে চাল মাড়াই করে।

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভাতে মোট ১২১ টি গ্রাম।সরজমিনে গ্রামগুলোয় ঘুরে দেখা যায় অধিকাংশ গ্রামে এখন ঢেঁকির দেখা মেলে না। কালের বিবর্তনে ঢেঁকি এখন শুধু ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করে। দিন দিন ঢেঁকি বিলুপ্ত হলেও একে সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই।

বানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাজ ইসলাম খোকন বলেন,আগামী প্রজন্ম যাতে বাংলার এসব সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের মেলবন্ধন স্থাপন করতে পারে, সেজন্য সরকারি বা বেসরকারিভাবে উদ্যোগ জরুরী।

জানতে চাইলৈ, আলফাডাঙ্গা পৌর মেয়র সাইফুর রহমান সাইফার বলেন,
বাংলার ঐতিহ্যগুলো রক্ষার্থে কাজ করতে হবে সবাইকে। নইলে এক সময় ঐতিহ্যগুলোর স্থান হবে জাদুঘরে এবং তা থাকবে শুধু পুস্তকেই সীমাবদ্ধ। বাংলায় এক সময় ঢেঁকির গুরুত্ব ও কদর ছিল অনেক। বর্তমানে বৈদ্যুতিক বা আধুনিক যন্ত্রপাতির ছোঁয়াতে তা বিলুপ্তির পথে। ঢেঁকির মতো অনেক বাঙালি ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা উচিত এ ঐতিহ্যগুলো।

ফেসবুকে লাইক দিন

তারিখ অনুযায়ী খবর

মার্চ ২০২৪
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
« ফেব্রুয়ারি    
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১  
দুঃখিত! কপি/পেস্ট করা থেকে বিরত থাকুন।