দেশের বাজারে যেসব ডালডা বা বনস্পতি ঘি রয়েছে তাতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে ১০ গুণ বেশি ট্রান্সফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড) পাওয়া গেছে, যা মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। প্রতি ১০০ গ্রাম নমুনায় ২ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট থাকার কথা থাকলেও সর্বোচ্চ ২০ দশমিক ৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট মিলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতিকর এই উপাদান হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকির অন্যতম প্রধান কারণ।
শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে ডালডায় ক্ষতিকর উপাদান নিয়ে এক গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা গবেষণাটির নাম ‘অ্যাসেসমেন্ট অব ট্রান্সফ্যাট ইন পিএইচও ইন বাংলাদেশ’।
২০১৯ সালে গবেষণাটি করেছে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট। গবেষণায় সহায়তা করেছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট।
গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে ডালডা বা বনস্পতি ঘি হিসেবে পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল (পিএইচও) ব্যবহার করা হয়। বাসাবাড়িতে এর ব্যবহার কম হলেও ভাজা-পোড়া স্ন্যাকস, বেকারিপণ্য ও বাণিজ্যিক উৎপাদনে তৈরিকৃত খাদ্যপণ্যে এটি বহুল ব্যবহৃত হয়। এই পিএইচওতে ক্ষতিকর ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড (টিএফএ) পাওয়া গেছে। এই টিএফএ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। ভেজিটেবল অয়েল বা উদ্ভিজ্জ তেল (পাম, সয়াবিন) যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পারশিয়ালি হাইড্রোজেনশন করা হলে তরল অবস্থা থেকে মাখনের মতো অর্ধকঠিন মারজারিন বা কঠিন ডালডা বা বনস্পতি ঘি উৎপন্ন হয়, যা বাজারে ডালডা নামে পরিচিত। এই উচ্চমাত্রার ট্রান্সফ্যাটযুক্ত ডালডা গ্রহণের সঙ্গে উচ্চহারে হৃদরোগ, স্মৃতিভ্রংশ (ডিমেনশিয়া) ও স্মৃতিহানি রোগ ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত।
এই গবেষণার জন্য ঢাকায় খুচরা বিক্রেতাদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বিভিন্ন বেকারি ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত পিএইচওর চারটি শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড পিওর, পুষ্টি, সেনা ও তীরের ডালডার ২৪টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এরপর পর্তুগালের লিসবনে ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউটের ফুড কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিতে নমুনাগুলো বিশ্লেষণ করা হয়।
গবেষণার ফলাফলে এসেছে, ২৪টি নমুনার মধ্যে ২২টিতে (৯২%) বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে। প্রতি ১০০ গ্রাম নমুনায় গড়ে ১১ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে, যেখানে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতি ১০০ গ্রামে সর্বোচ্চ ২ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের সুপারিশ করেছে। নমুনাগুলোয় প্রতি ১০০ গ্রামে সর্বনিম্ন শূন্য দশমিক ৬৯ গ্রাম থেকে সর্বোচ্চ ২০ দশমিক ৯ গ্রাম ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
গবেষণার ফলাফলে আরও এসেছে, একই ব্র্যান্ডের নমুনায় ট্রান্সফ্যাটের পরিমাণে তারতম্যের উপস্থিতি। যেমনÑ একটি ব্র্যান্ডের ডালডার নমুনায় শূন্য দশমিক ৬৯ গ্রাম থেকে ১৪ দশমিক ৫ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে। এসব শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাদ্যপণ্য জনস্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী। তিনি বলেন, খাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট থাকলে তা রক্তের ধমনিতে চর্বি জমতে দেয় এবং রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে। এতে ধমনিতে ব্লক তৈরি, রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে গিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। এই গবেষণায় প্রমাণ করে, দেশে অনেক পণ্যেই বিপজ্জনক মাত্রায় ট্রান্সফ্যাট রয়েছে, যা অধিকহারে হৃদরোগ ও হৃদরোগজনিত মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারের উচিত হবে সব ধরনের ফ্যাট, তেল এবং খাবারে ট্রান্সফ্যাটি অ্যাসিডের সর্বোচ্চ পরিমাণ বা মোট তেলের ২ শতাংশ (প্রতি ১০০ গ্রামে ২ গ্রাম) নির্ধারণ করে নীতিমালা প্রণয়ন করা।
সংবাদ সম্মেলনে প্রগতির জন্য জ্ঞানের (প্রজ্ঞা) ট্রান্সফ্যাক্ট প্রকল্পের দলনেতা মো. হাসান শাহরিয়ার বলেন, বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা যে সীমা বেঁধে দিয়েছে প্রতি ১০০ গ্রামে ২ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ করা ও ট্রান্সফ্যাটের উৎস নিষিদ্ধ করাÑ এই দুটি করণীয়। কারণ, ২০২৩ সালের মধ্যে পৃথিবীতে মানুষের খাদ্যশৃঙ্খল থেকে ট্রান্সফ্যাট সরানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা। এই লক্ষ্যে বিশে^র ৩০টির বেশি দেশে ইতোমধ্যেই ট্রান্সফ্যাটের সীমা নির্ধারণ করেছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর আহম্মাদ একরামুল্লাহ বলেন, বাজারে তৈরি খাদ্যপণ্যের গায়ে অবশ্যই ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা উল্লেখ করে লেবেল দেওয়া উচিত।
প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, এটা পরিষ্কার যে হৃদরোগের সঙ্গে ট্রান্সফ্যাটের সম্পর্ক আছে। এর ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। এতে নীতিনির্ধারকরাও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে এগিয়ে আসবেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন গবেষণা কার্যক্রমে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানকারী গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের বাংলাদেশের প্রধান মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস, গবেষণাটির উপদেষ্টা আবু আহাম্মদ শামীম প্রমুখ। সময়ের আলো