• ঢাকা
  • বুধবার, ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
ফরিদপুরে প্রয়াত অন্ধশিল্পী রফিকুলের মায়ের কান্দন থামছে না

ফরিদপুরে প্রয়াত অন্ধশিল্পী রফিকুলের মায়ের কান্দন থামছে না
—————————————————————

।।রেজাউল করিম।।

“মায়ের কান্দন যাবত জীবন…
দু’চার মাস বোনের কান্দন রে..
ওরে ঘরের পরিবারের কান্দন
কয়েক দিন পরে থাকেনা
দূঃখের ও দরদী আমার জনম দুঃখী মা
গর্ভধারিণী মা-জনম দুঃখীনি মা
দূঃখের ও দরদী আমার জনম দুঃখী মা।”

শ্রদ্ধেয় গীতিকার শাহ আলম সরকার এর এ লোক গানটি মা ভক্ত সকল মানুষের অন্তরকেই ছেদন
করে।

দেশের নানা প্রান্তে নন্দিত ও বরেণ্য শিল্পীবৃন্দ এ গান পরিবেশনকালে দর্শক ও শ্রোতা সাধারণের চোখের জল গড়িয়ে বুক ভিজে যায়।

পাষাণ হৃদয়েও আঘাত হানে নয়ন কোনের প্রবল বর্ষণে। হামলিয়ে কাঁদে কেউ কেউ।

ফরিদপুরে লোকগানের আসরে বা আড্ডায় এ গান শোনার ডাক পরতো রফিকের। শিল্পী অন্ধ রফিক।

দোতরাবাদনের লয় ও তালে সুরেলা কন্ঠে রফিক ‘মায়ের কান্দন সারা জীবন…’ গানটি ধরলে পিনপতন নীরবতায় দরদরিয়ে অশ্রু গড়াতো মজমায় অভ্যাগত দর্শক ও শ্রোতার চোখ বেয়ে।

শিল্পী রফিক নেই। চলে গেছেন পরপারে।যেন চুপটি করেই পাড়ি দিয়েছেন অপারে।

রফিকের বৃদ্ধা মাকে রফিক শুধুই বলেছিল – “যাই, মা।”

সন্তানের এরকম “যাই” শব্দ শুনলে সব মায়ের পিলে যে চমকে যায়।

সেদিন রফিক এর বৃদ্ধ মাতা ফাতেমা বেগমের তেমনই পিলে চমকে গিয়েছিলো। আর বাবা শেখ জসীম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন বাড়ির আঙিনায়।

গত ১৩ জুন শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লে শিল্পী রফিককে হাসপাতালে নিয়ে যান ছোট ভাই কোরবান সেক।

ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ধরা পরেছিলো তার দুটি কিডনিই বিকল।

পরিবারের ৫ সন্তানের মধ্যে রফিক ছিলেন বড়। জন্মে ছিলেন শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে।

১৯৭৫ সালের ১ আগস্ট পিতা জসীম ও মাতা ফাতেমার ঘর আলোকিত করে আসেন এক পুত্রসন্তান। নাম রাখা হয় রফিকুল ইসলাম।

ফরিদপুর শহরতলীর পূর্ব গোয়ালচামট এলাকায় দাদা মনসুর সেক এর বাড়িতে জন্ম নেয়া সন্তানটি বেড়ে ওঠে প্রকৃতির নির্মল আলো-হাওয়ায়।

পিতা জসীম ছিলেন খেটে খাওয়া সাধারন শ্রমিক। রফিকের হাতে পায়ে বক্রতা সমস্যার সাথে সাথে চোখে না দেখার সমস্যা বুঝতে পারেন তারা।

শৈশবে ছেলেকে অন্ধ স্কুলে ভর্তি করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারেনি রফিক।তবে তার ছিলো সুরেলা কন্ঠ।

পিতা জসীম গান বাজনা করতেন। গানের তালিম দেয়া শুরু করেন পিতা নিজেই। হারমোনিয়াম, তবলা,জুরি বাজানো শেখান তিনি।আর দোতরা বাদন শেখানো হয় শোভারামপুরের দোতারা বাদনের ওস্তাদ আইয়ুব আলীর কাছে।

লোকগীতি,লালনগীতি, জারি গান গাইতেন রফিক। এলাকার ছোটখাটো আড্ডায়, অনুষ্ঠানে অন্ধ রফিকের গান শুনতে বেশ পছন্দ করতো সংগীতপ্রেমীরা।

রফিক ছিলেন ফরিদপুরের লালন পরিষদের সদস্য। বিশিষ্ট লালন সংগীত শিল্পী ফকির আজমল শাহ, খ্যাতিমান শিল্পী পাগলা বাবলু, প্রয়াত সাংবাদিক সালামত হোসেন খান, বিশিষ্ট লালন ভক্ত, গবেষক ও সাংবাদিক মাহফুজুল আলম মিলন এবং বিভিন্ন গুণীজনের সান্নিধ্যে রফিক ফরিদপুর ও বিভিন্ন পাশ্ববর্তী জেলায় গান গেয়ে নিজ গুণে জয় করেন শ্রোতা হৃদয়।

গানের নেশা ও পেশায় সংসার চলতো তার। গান শুনে গুণমুগ্ধ শ্রোতা যে বকশিস দিতেন তাই দিয়ে চলতো সে। তার সাথে যোগ হতো তার পাওয়া প্রতিবন্ধী ভাতা।

একাধিক বিয়ে করেছিলেন রফিক। প্রেমাবেগে বিয়ে করলেও স্ত্রীগন একে একে রফিককে ছেড়ে পালিয়েছেন।

এ যেন প্রচলিত কথার মতো – অভাব যখন ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়,ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়।

ছেড়ে যাওয়া প্রথম স্ত্রীর ঘরে এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন রফিক। তার ঘরে নাতিপুতি আছে শিল্পী রফিকের।

বনিবনা নিয়ে দ্বন্দ্ব ও অভাবের দোহাই দিয়ে অন্যপুরুষের সাথে ঘর বেঁধেছেন পর পর আসা দুইজন স্ত্রী।

ঘরভাঙ্গা সংসারের বিষম বেদনায় ভেঙ্গে পরে রফিকের শিল্পী মন।

এ ভাঙ্গা মন জোড়া দিতে রফিকের ঘরে আবার আসেন আরেকজন। তিনি রফিকের বর্তমান রেখে যাওয়া স্ত্রী মরিয়ম। তার ঘরে ৫ বছরের একজন ছেলে সন্তান আছে। নাম তার মহিউদ্দিন।

করোনাকালে গান বাজনার ডাক বন্ধ হয়ে যায় রফিকের। সংসারে অনটন। আর কিডনি নষ্ট হওয়ায় ঘরে পরে থাকে প্রায় দুই মাস।

স্ত্রী মরিয়ম বাড়িতে বাড়িতে ঝি এর কাজ করে সংসার চালায়। আর খোদাবক্স রোডের গ্রিল দোকানদার ভাই কোরবান ও তার স্ত্রী সেবা শুশ্রূষা ও ঔষধ পথ্যাদি চালিয়েছেন।

আর হাসপাতালে ভর্তিকালীন সময়ে এলাকার প্রতিবেশী স্বজন শাহীন চৌধুরী দৌড়ঝাঁপ করে ডাক্তাদের শরণাপন্ন হয়েছেন ও অসুস্থ রফিককে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।

মহামারির এ ঘরবন্দির বন্দীদশায় অসুখে বিছানাধরা শিল্পী রফিকের খবর পায়নি তার ভক্ত ও গুণী স্বজনদের অনেকেই।

আর মৃত্যু! সে তো এসেছে আরো নীরবে। আগস্ট ২,সকাল সাতটা ৫মিনিটে বেরিয়ে যায় শিল্পী অন্ধ রফিকের প্রাণবায়ু। বয়স ৪৬ বছর।

সরেজমিনে রফিকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়
রফিকের দক্ষিণপোতা ছাপড়ার ঘরে নড়বড়ে চৌকির তক্তার পরে বসে গুমরে কাঁদছে বাবা জসীম শেখ।

আর মা ফাতেমা বেগম লাঠি ভর করে ঝাপসা চোখে রফিকে খুঁজছে সারা উঠোনময় ।

সন্তানহারা সব মায়ের মতনই ফাতেমা বেগম ডান অলিন্দে বাম হাত রেখে কেবলই রোনাজারি করছেন- “আমার পরাণতো ঠান্ডা হয় না রে, বাজান; ও বাজান, ও রফিক, ও রফিক…”

তখন আমার হৃদয়পটে ভেসে ওঠে শিল্পী রফিকের মুখ। আর অন্তঃকর্ণে শুনতে পাই রফিকের কন্ঠে গীতিকার শাহ আলম সরকারের সেই আকুতি :

“আরে আমারে আল্লাহ নাও গো তুলে
সন্তানেরে নিয়ো না,
দুঃখের দরদী আমার জনম দুঃখী মা।
গর্ভধারিণী মা-জনম দুঃখীনি মা
দূঃখের ও দরদী আমার জনম দুঃখী মা।”

✅ ছবি: রাজবাড়ি জেলার খ্যাতিমান শিল্পী মনসুর উল করিম এর বাড়ি বুনন আর্ট স্পেস থেকে শিল্পী অন্ধ রফিক এর ছবিটি ২০২০ সালের ১৭ জানুয়ারি ফরিদপুরের সাহিত্য প্রেমীদের সংগঠন বইঘাটা আয়োজিত সেই অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে তুলেছেন সাংবাদিক রেজাউল করিম।

ফেসবুকে লাইক দিন

তারিখ অনুযায়ী খবর

এপ্রিল ২০২৪
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
« মার্চ    
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
দুঃখিত! কপি/পেস্ট করা থেকে বিরত থাকুন।