ক্যানসারের কাছে হেরেই গেলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পাড়ি জমালেন পরপারে। সোমবার (০৬ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে রাজশাহী মহানগরীর মহিষবাথান এলাকায় বোনের বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন এই খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে পুরো রাজশাহী নগরজুড়ে স্তব্ধতা নেমে আসে। সব মানুষের মাঝেই দেখা যায় শোকের ছায়া। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাজানো হচ্ছে এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া পুরনো দিনের সেই গানগুলো।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে এন্ড্রু কিশোরের দেহে ক্যানসার ধরা পড়ে। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করেও ক্যানসার নির্মুল হয়নি তার। চিকিৎসক হাল ছেড়ে দেয়ায় গত ১১ জুন ক্যানসার নিয়েই ফিরতে হয়েছে দেশে। তারপর থেকেই ছিলেন রাজশাহীতে। রোববার শারীরিক অবস্থার ভীষণ অবনতি ঘটে।
এন্ড্রু কিশোরের বোন জামাই প্যাট্টিক বিপুল বিশ্বাস জানান, সিঙ্গাপুরে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি দিলেও ক্যানসার দূর হয়নি। চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাই এন্ড্রু কিশোরের ইচ্ছায় তাকে দেশে আনা হয়। এরপর থেকে বোনের বাসায় ছিলেন। এটি ক্লিনিকও। সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন এন্ড্রু কিশোর। সেখানেই কেটেছে তার শৈশব ও কৈশোর। এন্ড্রু কিশোর প্রাথমিকভাবে সংগীতের পাঠ শুরু করেন রাজশাহীর খ্যাতনামা ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। একসময় গানের নেশায় রাজধানীতে ছুটে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান, লোকগান ও দেশাত্মবোধক গানে রেডিওর তালিকাভুক্ত শিল্পী হন।
১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে ‘মেইল ট্রেন’ সিনেমায় ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে এন্ড্রু কিশোরের চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক যাত্রা শুরু হয়। সেই শুরুর পর থেকে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেও গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যে খানে’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় বাংলা গান উপহার দিয়েছেন শ্রোতাদের।
সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য দেশ-বিদেশের আরও অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন উপমহাদেশের খ্যাতনামা এই শিল্পী। প্লে ব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোর সব সময় সাদামাটা জীবনযাপন করেছেন। কখনও তাকে নিয়ে কোন বিতর্ক ওঠেনি। হাজারও ভক্ত অনুরাগীদের কাঁদিয়ে দেশবরেণ্য এই শিল্পী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন।
রোববার রাতেই এন্ড্রু কিশোরের সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা জানিয়ে ফেসবুক পেইজে পোস্ট দিয়েছিলেন স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রু। প্রাণ খুলে দোয়া চেয়েছিলেন সবার কাছে। ওই পোস্টে তিনি এন্ড্রু কিশোরের চিকিৎসা থেকে শুরু করে যাবতীয় বিষয় লিখেছেন। আবেগঘন ওই পোস্টে ভাল কোন খবর ছিল না।
লিপিকা লেখেন, গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর তারা সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন। সেখানে এন্ড্রু কিশোরের ক্যানসার ধরা পড়ে। তারপর কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি শেষ হয় এপ্রিল মাসে। চিকিৎসক বলেছিলেন, এখন আর কিছু দরকার নাই। ওষুধ দিয়ে বলেছিলেন, আগস্ট মাসে যেতে। তারা ১৩ মে দেশে আসার জন্য টিকেট কাটেন। কিন্তু কিশোর শারীরিকভাবে খুব দুর্বল ছিলেন। তাই ইতি টিকিট বাতিল করেন। চিকিৎসক বলেন, কেমোর জন্য এন্ড্রু কিশোর দুর্বল। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, সময় লাগবে।
পরে ১০ জুন তারা আবার টিকিট কাটেন। কিন্তু হঠাৎ ২ জুন কিশোরের হালকা জ্বর আসে। পরদিন রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। তাই ৪ জুন হাসপাতালে ভর্তি করেন চিকিৎসক। কিন্তু জ্বর বার বার আসতে থাকে। কোন ওষুধ তার শরীরে কাজ করছিল না। চিকিৎসক বলেছিলেন, ক্যানসার আবারও আসছে কিনা তা দেখতে হবে। পরীক্ষার পর দেখা যায় এন্ড্রু কিশোরের শরীরে সেটিই ঘটেছে।
দ্বিতীয়বার ক্যানসার ধরা পড়ায় এন্ড্রু কিশোর দেশের ফেরার সিদ্ধান্ত নেন জানিয়ে লিপিকা লেখেন, ‘কিশোর ডাক্তারকে বলে, তুমি আজই আমাকে রিলিজ করো, আমি আমার দেশে মরতে চাই, এখানে না, আমি কাল দেশে ফিরব। আমাকে বলে, আমি তো মেনে নিয়েছি, সব ঈশ্বরের ইচ্ছা, আমি তো কাঁদছি না। তুমি কাঁদছ কেন? কিশোর খুব স্বাভাবিক ছিল, মানসিকভাবে আগে থেকে প্রস্তুত ছিল। যেদিন থেকে জ্বর এসেছিল সেদিন থেকে। কিশোর হাইকমিশনে ফোন করে বলে, কালই আমার ফেরার প্লেন ঠিক করে দেন। আমি মরে গেলে আপনাদের বেশি ঝামেলা হবে, জীবিত অবস্থায় পাঠাতে সহজ হবে। ১০ জুন বিকালে হাসপাতাল থেকে ফিরি এবং ১১ জুন রাতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে ফিরে আসি আমরা।’
তিনি লেখেন, ‘ঈশ্বরের কি খেলা, ১০ জুন আমরা সম্পূর্ণ পজিটিভ রেজাল্ট নিয়ে ফিরতে চেয়েছিলাম। অথচ ১১ জুন ফিরলাম পুরো নেগেটিভ রেজাল্ট নিয়ে। আমি ডাক্তারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আর কতদিন? সে এটা লিখেছিল- ভবিষ্যৎবাণী করা কঠিন। তবে সাধারণত মাস থেকে বছর। এখন কিশোর কোন কথা বলে না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। আমি বলি কি ভাব, বলে কিছু না, পুরানো কথা মনে পড়ে আর ঈশ্বরকে বলি আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও, বেশি কষ্ট দিও না।
এ ব্যাপারে এটা শেষ পোস্ট উল্লেখ করেছিলেন লিপিকা। লেখেন, ‘এটাই শেষ পোস্ট, এর পর আর কিছু বলা বা লেখার মত আমার মানসিক অবস্থা থাকবে না। এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন মনে হয়। কিশোর থাকবে না, অথচ আমি থাকব। মেনে নিতে পারছি না। এই অসময়ে সবাই সাবধানে থাকবেন। নিজের প্রতি যত্ন নিবেন, সুস্থ থাকবেন, ভাল থাকবেন। আর এন্ড্রু কিশোরের প্রতি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি রাখবেন। প্রাণ খুলে দোয়া করবেন।’
এন্ড্রু কিশোর সংসার জীবনে স্ত্রী ছাড়াও সজ্ঞা (২৬) নামে এক মেয়ে ও সপ্তক (২৪) নামে এক পুত্র সন্তান রেখে গেছেন। তার দুজনই বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করছেন। সজ্ঞার পড়াশোনা প্রায় শেষের দিকে।