১৯৯০ দশকের সিটকম জঁরার সেইনফিল্ড (টেলিভিশন সিরিজ) পুনরায় দেখার সময় প্রথমবারের মতো আমি কভিড-১৯ সম্পর্কে নিজের মনকে গুছিয়ে নেয়ার আভাস পাই। পর্দায় একটি দৃশ্যে দেখলাম, মংকের ক্যাফেতে চরিত্রগুলো টেবিলে একসঙ্গে বসে ছিল। সেখানে ক্রামার এমনভাবে বসে ছিলেন যে তার হাত ছিল আরেকটি চেয়ারে। যেখানে তার বাহু স্পর্শ করছিল আরেকজনকে, যা শারীরিকভাবে আমাকে হঠাৎ আতঙ্কিত করে তোলে।
ততদিনে আমার নিজের শহর নিউ অরলিন্স মহামারীর কয়েক সপ্তাহ পার করে ফেলেছিল। কোনো মানুষ সামনে এগিয়ে এলে তাকে ঠেকাতে আমি পিছিয়ে যাওয়া শুরু করেছিলাম। কেউ আমার পাশ দিয়ে যেতে চাইলে তারা চলে যাওয়া পর্যন্ত আমি আমার নিঃশ্বাস আটকে রাখতাম এবং চোখ ঘুরিয়ে নিতাম। এ ধরনের আচরণ বেশ স্বাভাবিক বলেই মনে হচ্ছিল। যদিও এরই মধ্যে মধ্য মার্চে বিজ্ঞানীরা বাইরের পরিবেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে ইঙ্গিত দিয়েছিল। আমার সব বন্ধুই জানিয়েছিল একই ধরনের অনুভূতির কথা। একজন আমাকে বলেছিল, পাতালরেলের দৃশ্য এলে সে টিভি বন্ধ করে দেয়। এখানে আমরাই কেবল না। অনেক রাজ্য খুলে দেয়ার পর দলমত নির্বিশেষে বেশির ভাগ আমেরিকান বলেছিল, তারা ভেতরে-বাইরে ভিড় ও কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে যেতে অস্বস্তি বোধ করছে।
স্নায়ুবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, লোকেরা অপরিচিত মানুষের আশপাশ দিয়ে এবং ভিড়ের মধ্য দিয়ে চলাচল করছে না। মূলত তাদের মনে আগে থেকে বিদ্যমান ভয় ও অস্বস্তিকর অনুভূতির কারণে এমনটা হচ্ছে। বিপরীতে সমাজের অনেকেই একই সঙ্গে একটি নতুন সংবেদনশীল অনুভূতির অভিজ্ঞতা লাভ করছে।
স্নায়ুবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানী লিসা বারেট বলেন, আমাদের মস্তিষ্কে আবেগ তৈরির প্রক্রিয়াটি হলো অভ্যন্তরীণ ও বাস্তব দুনিয়ার অভিজ্ঞতাকে প্রসঙ্গের ভেতর বসানো। তাহলে আমরা আমাদের চারপাশে সৃষ্টি হওয়া উদ্বেগকে আরো ভালোভাবে শ্রেণীবদ্ধ করতে পারব। এ মানসিক প্রতিক্রিয়াকে এমনকি সরাসরি করোনাভাইরাসের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ারও প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, আপনি কেবল এ সম্পর্কে পত্রিকায় পড়তে পারেন কিংবা কেউ একজন আপনাকে এ সম্পর্কে বলতে পারে। কেউ একজন কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে, কারণ সে ভিড়ের মধ্যে গিয়েছিল—এটি জানার পর তাত্ক্ষণিকভাবে আপনার মস্তিষ্কের সম্ভাব্য এ ঘটনা সম্পর্কে বুঝতে বেশি সময় লাগে না।
লোকেরা কেন ভিড়ের ব্যাপারে তীব্র বিদ্বেষ বোধ করছে, এটা বোঝার জন্য সহায়তা করে আবেগী অভিজ্ঞতা এবং রিফ্লেক্সিভ অস্বস্তির মধ্যকার পার্থক্য। আর আমরা যদি ইতিহাসের ওপর আস্থা রাখি তবে এটা সম্ভব হতে পারে যে মহামারী শেষ হয়ে যাওয়ার পরও ভিড়ের বিরুদ্ধে মানুষের বিরক্তি অপরিবর্তনীয় থেকে যাবে।
কখন গিয়ে আকস্মিক ধাক্কার অনুভূতি আবেগে পরিণত হয়?
কেবল কেউ একজন ভিড় দেখে ধাক্কা খেয়েছেন, তার মানে এই নয় যে তারা এটিকে ভয় পাচ্ছেন। একটি আকস্মিক ধাক্কার অনুভুতি থেকে আবেগে রূপান্তরের বিষয়টি পরে আসে এবং এটি পুনরাবৃত্তি নিয়ে আসে, যখন আপনার মস্তিষ্ক এ নতুন পরিস্থিতি ও সংবেদনকে শ্রেণীবদ্ধ করতে শেখে।
বারেট বলেন, আপনার শরীর সব সময় তার পরিস্থিতি সম্পর্কিত তথ্য মস্তিষ্ককে প্রেরণ করে। আপনি সেসব সংবেদন শান্তি ও স্বস্তির সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে অভিজ্ঞতায় লাভ করবেন অথবা স্নায়বিক দুর্বলতা কিংবা অস্বস্তির প্রবৃত্তি হিসেবেও লাভ করতে পারেন। বেশির ভাগ মানুষ সহজাত এ প্রবৃত্তিকে মেজাজ হিসেবে অভিহিত করে, বিজ্ঞানীরা বলেন প্রভাব।
বারেটের গবেষণায় দেখা গেছে, আবেগ একই রূপে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ধরা দেয় না। এমনকি সময়ের সঙ্গে একই ব্যক্তির মধ্যেও তা একই থাকে না। ভয়ের ধারণা হচ্ছে, দৃষ্টান্তগুলোর একটি সেট যাকে আপনার মস্তিষ্ক একই নাম দিতে সক্ষম। উচ্চতাজনিত ভীতি একধরনের বমি ভাব নিয়ে আসে। কিন্তু উত্তেজনার একটা রোলার কোস্টার সামনে আসে কিংবা শীতল অনুভূতি নিয়ে আসে, যখন একটি শূন্য ঘরে অপ্রীতিকর শব্দের সৃষ্টি হয়। আমাদের মস্তিষ্ক সেসব অনুভূতির সঙ্গে যুক্ত হয় সেগুলোকে ভয় নাম দিয়ে।
মহামারীর ও উপসর্গহীন অদৃশ্য ভাইরাস বিস্তৃতিকারীদের বিধিগুলো ভাঙতে দেখেছে। বারেট বলেন, তাদের মন সঠিক নামটির সন্ধানে থাকে।
টেলিভিশনের মাঝে ভিড়ের দৃশ্য দেখে আমার মাঝে যে ভয় ও অস্বস্তির অভিজ্ঞতার শুরু হয়েছে, অন্য কারো মাঝে সেটি রাগ হিসেবে প্রকাশিত হতে পারে। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি আবার ভিড়কে সামাজিক দূরত্ব সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলার আবেদনও এখান থেকে বোধ করতে পারেন। সে হয়তো এটাকে আবেগ হিসেবে নাও ভাবতে পারে।
অস্বস্তির এ অনুভূতির বিকাশ কেন প্রথম স্তরে হয়ে থাকে সে সম্পর্কে আমাদের কিছু সূত্র দিতে পারে প্রাণীরা। স্নায়ুবিজ্ঞানী কর্নেলিউস গ্রোস ইঁদুরের এবং বানরের ওপর এক পরীক্ষা চালিয়ে দেখেন বিপদের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া প্রাণীদের মাঝে স্বাধীন পথের মধ্য দিয়ে সঞ্চালিত হয়। তিনি বলেছেন, এটা বিশ্বাস করা যুক্তিসংগত যে মানুষের ক্ষেত্রেও এটি সমভাবে প্রয়োগ করা যাবে।
গ্রোস বলেন, একটি স্টোভকে স্পর্শ করার ক্ষেত্রে ভয় কাজ করে, কারণ এটা গরম। কেউ আপনার দিকে কঠিনভাবে তাকাচ্ছে, এ ভয় কিন্তু শিকারির ভয় থেকে আলাদা। তার ধারণা, বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার পথ বিদ্যমান, কারণ আমাদের অস্তিত্বের হুমকি আসে বিভিন্ন স্তরের ঝুঁকির সঙ্গে এবং আমাদের মন প্রতিটি প্রচেষ্টার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। তাই এটা খুব একটা অবাক করা ব্যাপার নয় যে একবার যদি আপনার মস্তিষ্ক সিদ্ধান্ত নেয় যে একজন মাস্ক না পরা ব্যক্তি শারীরিকভাবে বিপজ্জনক, তখন প্রতিবার মাস্ক ছাড়া কাউকে দেখার পর মস্তিষ্ক আপনাকে সতর্ক বার্তা দেবে। আমার ধারণা এর কারণ হচ্ছে, আপনি সংক্রামক হওয়ার হুমকির এ বোধটি তাদের ওপর আরোপ করেছেন। কোনো কোনো ব্যক্তি হুমকিকে অন্যের শরীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেখে এবং ভয়কে শারীরিকভাবে অনুভব করে।
এ ধরনের শিক্ষা আমরা সব সময় পেতে থাকি। একবার পেট খারাপ হওয়ার জন্য দায়ী কোনো খাবারের কথা মনে হলে যেমন অনেক সময় বমির উদ্রেক ঘটে, এটিও তেমন বিষয়। যেখানে ভিড়ের মধ্যে কাউকে কাছে আসতে দেখে আপনার মাঝে অস্থিরতা তৈরি হয়।
অবশ্য মহামারীর সংবেদনশীলতার তীব্র অবস্থা সত্ত্বেও সামষ্টিক উদ্বেগের অন্য মুহূর্তগুলো নিয়ে করা গবেষণা বলছে, এ অস্বস্তির বোধ যা কিনা সামাজিক দূরত্বের দিকে চালিত হয়েছে, তা আবার সাময়িকও হতে পারে। এর কারণ হতে পারে স্মৃতি হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী কিংবা অনেক মানুষ এমনভাবে খাপ খাওয়াতে পারে, যা তারা বুঝতে পারে না। যেভাবেই হোক, ইতিহাসে তার স্পষ্ট দৃষ্টান্ত রয়েছে।
দ্য ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক থেকে সংক্ষেপে ভাষান্তর