লকডাউনের তিন মাস পর এসে যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ কোয়ারেন্টিন বাবল গঠন করছে। যা কিনা মহামারীর সঙ্গে ঝুঁকিতে থাকা মানুষের মানবিক ও সামাজিক জীবনের মাঝে এক ধরনের ভারসাম্য তৈরি করে। আমি একজন এপিডেমিওলজিস্ট এবং চার সন্তানের মা। যাদের তিনজনই টিনএজার, যারা ঝুঁকি গ্রহণের বয়স পার করছে।
গবেষণা বলছে, কোয়ারেন্টিন বাবল কার্যকরভাবে সার্স-কোভ-২-এর সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করার পাশাপাশি বন্ধু ও পরিবারের অন্যদের সঙ্গে সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে।
ঝুঁকি কমানো
কোয়ারেনটিম হচ্ছে মূলত কয়েকজন মানুষের ছোট একটি দল, যারা নিজেদের সামাজিক বৃত্ত তৈরি করে একসঙ্গে কোয়ারেন্টিন পালন করে। ঝুঁকি হ্রাস করার এটি একেবারেই সঠিক একটা উপায়।
ক্ষতি হ্রাস হচ্ছে জনস্বাস্থ্যের বাস্তববাদী ধারণা, যা স্পষ্টভাবে স্বীকার করে যে সব ঝুঁকি দূর করা সম্ভব না। তাই এটা উৎসাহিত করে ঝুঁকি হ্রাস করাকে। ক্ষতি হ্রাসের এই পদ্ধতিগুলো জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার ফ্যাক্টরগুলোকেও বিবেচনা করে। যা কিনা স্বাস্থ্য ও আচরণ উভয়কেই প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ সংযমের শিক্ষা সবসময় ঠিকভাবে কাজ করে না। অন্যদিকে নিরাপদ যৌন শিক্ষা ঝুঁকি কমায়, এটা দূর করে না। পাশাপাশি এটা কিশোর বয়সে গর্ভধারণ এবং যৌন সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতেও ভালোভাবে কাজ করে। একইভাবে কোয়ারেন্টিন বাবল তৈরির মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ বাড়লেও তা কভিড-১৯ বিস্তৃত হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।
মানসিক স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ
ঘরের মধ্যে থাকা, বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ডেলিভারির মধ্য দিয়ে এগোনো কভিড-১৯-এ সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই হ্রাস করে। তবে মহামারীর এসব ঝুঁকির বাইরে আরেক ধরনের সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়ে যায়। যেখানে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিও সমানভাবে যুক্ত। মহামারীতে মানসিক স্বাস্থ্যের নেতিবাচক প্রভাবগুলো এরই মধ্যে সামনে আসতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে ১৩.৬ শতাংশ মানুষের মাঝে মারাত্মক মানসিক সমস্যার উপসর্গ দেখা গেছে। যা ২০১৮ সালের চেয়ে ৩.৯ শতাংশ বেশি। রিপোর্ট অনুযায়ী ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের এক-চতুর্থাংশ মানসিক উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগছে। এছাড়া অনেক মানুষ উদ্বিগ্নতা ও হতাশায় ভুগছে।
মূলত একাকিত্ব ও সামাজিক আইসোলেশনই ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, হতাশা ও উদ্বেগ তৈরি করছে এবং এসব চালিত করছে হূদরোগ ও স্ট্রোকের মতো মারাত্মক সমস্যার দিকে। যা কখনো কখনো অকালমৃত্যুর কারণ হয়েও দাঁড়িয়েছে।
আইসোলেশন যেহেতু মানসিক ও শারীরিক উভয় ঝুঁকিই বাড়াচ্ছে, তাই কোয়ারেনটিম সাহায্য করতে পারে সামাজিক সুস্থতা ও জীবন মান উন্নয়নে।
সামাজিক নেটওয়ার্ক তত্ত্ব
সামাজিক সম্পর্ক কল্যাণ ও মানসিক স্বাস্থ্যকে ভালো রাখে, কিন্তু এটা সংক্রমণ ছড়ানোর মাধ্যমও বটে। এদিকে বিশ্বব্যাপী লকডাউন যতই শিথিল হচ্ছে একটা প্রশ্নই সামনে আসছে, কীভাবে ঝুঁকি কমিয়ে সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া বাড়ানো যায়?
সাম্প্রতিক এক গবেষণা সোস্যাল নেটওয়ার্ক থিওরি ব্যবহার করেছে কীভাবে একটি দলের মানুষের মাঝে তথ্য ছড়িয়ে পড়ে দেখার জন্য এবং সংক্রামক রোগের মডেল ব্যবহার করে দেখেছে এই মহামারীতে কোয়ারেনটিম ব্যবস্থা কাজ করে কিনা।
এটা করার জন্য গবেষকরা ভাইরাস কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে তা পরিমাপ করতে সামাজিক যোগাযোগের একটি কম্পিউটার মডেল তৈরি করেছিলেন। তারা আদর্শ আচরণের একটি মডেল তৈরি করেছিলেন, তবে অর্ধেকসংখ্যক মিথষ্ক্রিয়া এবং তিনটি ভিন্ন সামাজিক দূরত্বের পদ্ধতির সঙ্গে যেখানেও স্বাভাবিক থেকে অর্ধেক মিথষ্ক্রিয়া ছিল।
প্রথম সামাজিক দূরত্বের চিত্রে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য দ্বারা মানুষগুলো দলবদ্ধ ছিল। যেমন একই বয়সের লোকগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। দ্বিতীয় চিত্রে স্থানীয় সম্প্রদায়গুলো এবং আন্তঃসাম্প্রদায়িক যোগাযোগগুলো অব্যাহত ছিল। শেষ চিত্রে বিভিন্ন জায়গার মিশ্র বৈশিষ্ট্যের ছোট সামাজিক দলগুলোর মাঝে যোগাযোগ সীমাবদ্ধ ছিল। অর্থাৎ আলাদা আলাদা কোয়ারেন্টিন বাবল। এই বাবলে সব বয়সী মানুষ থাকতে পারে। কিন্তু তারা কেবল নিজেদের মধ্যকার গ্রুপের সঙ্গেই যোগাযোগ করতে পারে।
সামাজিক দূরত্বের সবগুলো ব্যবস্থা মহামারীর তীব্রতা কমিয়েছিল এবং এলোমেলোভাবে যোগাযোগ কমানোর চেয়ে এটা ভালো ছিল। কিন্তু কোয়ারেনটিম পদ্ধতি সংক্রমণ হ্রাসের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। বিশেষ করে সামাজিক দূরত্ব না থাকার চেয়ে। কোয়ারেন্টিন বাবল সংক্রমণের চূড়া স্পর্শ করাকে অনেকটাই কমাতে পারে।
অনেক দেশ তাদের প্রতিরোধী গাইডলাইনে কোয়ারেনটিমকে যুক্ত করতে শুরু করেছে, যাতে করে সংক্রমণের হার কমানো এবং কন্টাক্ট ট্রেসিং প্রোগ্রামকে ব্যবহার করা যায়। সম্প্রতি ইংল্যান্ড তাদের গাইডলাইনে কোয়ারেনটিমকে যুক্ত করেছে। এর আগে মে মাসে নিউজিল্যান্ডও একে যুক্ত করেছিল।
কীভাবে কোয়ারেন্টিন বাবল তৈরি করবেন
কার্যকর কোয়ারেনটিম তৈরি করার জন্য যা করা দরকার তা হলো প্রথমত সবাইকে নিয়ম মানার ব্যাপারে একমত হতে হবে। তবে সত্যি কথা হচ্ছে, একজনের অসংলগ্ন আচরণ গোটা গ্রুপকে ঝুঁকির মাঝে ফেলে দিতে পারে। তাই কোয়ারেনটিমের ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস। এছাড়া দলকে আগে থেকে ঠিক করতে হবে যদি কেউ নিয়ম ভাঙে কিংবা আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে এলে কী করতে হবে। আর যদি কারো উপসর্গ দেখা যায় তবে সবাইকে ১৪ দিনের জন্য সেলফ আইসোলেশনে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত প্রত্যেককে অবশ্যই কতটা ঝুঁকি গ্রহণযোগ্য তা ঠিক করতে হবে এবং এ সিদ্ধান্তের প্রতিফলনের জন্য নিয়ম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যেমন পারিবারিক মেলামেশায় একজন স্বস্তি বোধ করলেও অন্যজন না করতে পারে। তাই এসব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। এছাড়া কোয়ারেনটিমের বাইরে সবাই সাধারণ সব নিয়ম মেনে চলা উচিত।
স্ক্রলডটইন