অন্ধত্বকে হার মানানো শশীর জীবন সংগ্রাম
জন্মের পর ৩০টি বছর পেরিয়ে গেলেও পৃথিবীর আলো কেমন তা জানেনা শশী। তবে তিলে তিলে পরিশ্রম করে নিজের ভিতরের আলোকে প্রজ্জলিত করে একজন নারী আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছে সে।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তার জীবনের আলোই আজ নিভতে চলেছে দুরারোগ্য ব্যাধিতে। সময়মতো চিকিৎসা না হলে হয়তো চিরতরে নিভে যাবে তার জীবন প্রদীপ।
ফরিদপুরের মেয়ে শশীর পুরো নাম মারজিয়া রব্বানী শশী। ১৯৯৪ সালের ৩০ মে ফরিদপুরের সদ্য প্রয়াত আইনজীবী গোলাম রব্বানী বাবু মৃধা ও বেগম আফরোজা রব্বানীর ঘর আলো করে দ্বিতীয় মেয়ে হয়ে জন্ম হয় তার।
ঐশী জন্মান্ধ। মায়ের গর্ভ হতে ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকে পৃথিবীর আলো দেখেনি সে। তবে অন্ধকারকে জয় করার ইচ্ছা শক্তি আর অদম্য প্রচেষ্টায় নিজেকেই আলোকিত করে তুলেছে সে। অন্ধ হয়েও সে নিজেকে উচ্চ শিক্ষিত করে আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একজন আইনজীবী হিসেবে। তার এই অন্ধকার জয়ের কাহিনী যেনো রুপকথাকেও হার মানিয়েছে। শশীর জীবন সংগ্রামের কাহিনী বলতে যেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে যান তার মা।
আফরোজা রব্বানী এই প্রতিবেদককে বলেন শশীর বেড়ে ওঠার গল্প। কখনো সাফল্যের হাসি কখনো হারানোর শঙ্কায় মুষড়ে উঠেন।
তিনি বলেন, ‘প্রথম যেদিন তাকে ঘরের বাইরে আলোতে বের করেছিলাম তখন থেকে আস্তে আস্তে তার অন্ধত্বের বিষয়টি ধরা পড়ে। কেনো জানি মনে হচ্ছিলো শশীর চোখে আলো ধরা পড়েনা।’
‘মেয়েটিকে রোদে বের করার পর দেখছিলাম সে সূর্যের দিকে চোখ করে চেয়ে আছে। এতোটুকু মেয়ের তো সূর্যের আলোর দিকে চেয়ে থাকার কথা না। এরপর তার সামনে হাত বাড়াই। খেলনা ধরি। সে টের পায় না। আস্তে আস্তে বুঝলাম আমার মেয়েটি চোখে দেখেনা।’ শশীর মা জানান।
তিনি বলেন, ‘এরপর ভেঙে পরেছিলাম। ওকে বোধহয় পড়াশুনাও শেখাতে পারবো না এমনই আশঙ্কা করেছিলাম। তবে পরে দেখলাম, ওর বোনদের পড়ার সময় পাশে থেকে শুনে শুনেই সে সব মুখস্থ করে ফেলছে। এতে আশাবাদী হয়ে উঠলাম আমি।’
‘সিদ্ধান্ত নিলাম মেয়েকে পড়াশুনা করাবো। তারপর আমরাই মুখে মুখে বলে ওকে পড়াতে থাকি। তবে বিষয়টি মোটেও সহজ ছিলোনা। হাতে ধরে ফ্লোরের উপর চক দিয়ে লিখে লিকে ওকে অক্ষরের সাথে পরিচিত করাই।’ সেই কষ্টের দিনগুলোর কথা মনে করে স্মৃতির অলিগলিতে হারিয়ে যান এই মা।
‘যখন এসএসসির সময় হলো, শশীর ছোটবোন তাবিদা ওর হয়ে পরীক্ষার খাতায় উত্তর লিখে দেয়ার অনুমতি পায়। প্রশ্ন পড়ে শোনানো পর শশী মুখে মুখে উত্তর দিতো। আর তাবিদা সেটি খাতায় লিখে দিতো। এভাবে সে এসএসসিতে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়।’ যেনো আকাশের চাঁদ ধরা দেয় শশীর মাবাবার কাছে।
ফরিদপুরের সরকারী সারদা সুন্দরী কলেজ হতে এইসএসসি উত্তীর্ণ হওয়ার পর সে ভর্তি হয় ঢাকার সাইথইষ্ট ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে সে আইনে অর্নাস সম্পন্ন করে।
শশীর মা জানান, ‘বাড়ির বাইরে ঢাকায় যাওয়ার পর তার পড়াশুনাটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়ায়। তখন আমি টেলিফোনে তাকে পড়া বলে দিতাম। সে সেটি শুনে শুনে মুখস্থ করতো। এরপর প্রতি সপ্তাহে ঢাকায় যেয়ে আমি তার পড়া টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করে দিয়ে আসতাম। সে সেসব শুনে শুনে মুখস্থ করতো।’
এভাবে ২০১৫ সালে শশী আইনে অনার্স ডিগ্রী লাভ করেন। ২০১৮ সালে তিনি বার কাউন্সিলের সনদ পেয়ে ফরিদপুর জেলা আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এভাবে অন্ধত্বকে জয় করে নতুন এক ইতিহাসের সৃস্টি করেন তিনি।
২০১৫ সালে পরিববারের সম্মতিতে তিনি মধুখালী উপজেলার মেগচামী ইউনিয়নের মোঃ জাহাঙ্গির আলমকে বিয়ে করেন।
অন্ধত্বকে এভাবে জয় করে তাক লাগিয়ে দিলেও জীবন যেনো তার কাছে এখনো কঠিন হয়েই রয়েছে। ইতিমধ্যে ধরা পড়েছে শশীর কিডনী বিকল হতে চলেছে। নিয়মিত কিডনী ডায়ালাইসিস করে তাকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে।
এই প্রতিবেদন লেখার সময় শশী ঢাকার শ্যামলীতে একটি কিডনী হসপিটালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও শশীর চিকিৎসক ডাঃ স্বপন কুমার মন্ডল জানিয়েছেন, শশীর কিডনী প্রতিস্থাপন করতে না পারলে ও হয়তো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে না।
ফরিদপুরের প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদ শশীর এই দুরাবস্থায় অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে বলেন, ফরিদপুর বারের একজন সম্ভাবনাময়ী নারী আইনজীবী শশী। ওর মতো অন্ধ হয়ে এর আগে কেউ এখানে আইনপেশায় আসেনি। আমরা ওর দ্রুত আরোগী কামনা করছি। আশা করছি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ও আবার সুস্থ্য হয়ে উঠবে।
শশীর পারিবারীক সূত্র জানায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শশীর কথা জেনে তার চিকিৎসার জন্য দুই লাখ টাকা দেন। এছাড়া সম্প্রতি অন্ধত্বকে জয় করে এভাবে আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় শশীকে একটি বেসরকারী সংস্থা অ্যাওয়ার্ড ও নগদ আর্থিক সহায়তা পুরণ করে। তবে শশীর চিকিৎসার জন্য ইতিমধ্যে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। তাকে বাঁচিয়ে তুলতে আরো অনেক টাকা দরকার।
অন্ধত্বকে জয় করা শশী কি পারবে মানবিক হৃদয়গুলোকে জয় করে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে?