জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- এর ঘনিষ্ঠ সহচর শামসুদ্দীন মোল্লার অনুসারী দরকার যারা দেশকে অবক্ষয় মুক্ত করে এগিয়ে নিতে পারবে।
আমরা যে জাতি হিসাবে কৃতজ্ঞ নই তার নজির আমরা অনেক বার দেখিয়েছি। দেশ ও জাতির জন্য যারা আজীবন সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন তাদেরকে আমরা ভুলতে বসেছি। সাম্প্রতিক কালে এ সংস্কৃতি আরো প্রকট হয়েছে ভূইঁফোর আর হাইব্রীড নেতা কর্মীর দাপটে। আজ আমার উপলব্ধি থেকে এমনই এক নেতার প্রয়ান দিবসে লিখছি তার বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের কিছু কথা। যার নাম এ্যাডঃ শামসুদ্দীন মোল্লা। বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের বাল্য বন্ধু, ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর শামসুদ্দীন মোল্লা। যে নেতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মানের, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারন করে আজীবন নিরলস কাজ করে গেছেন। যে নেতা তার কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই আমার এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।
ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলাধীন সদরদী গ্রামে ১৯২১ সালের ২০ এপ্রিল জন্ম গ্রহন করেন শামসুদ্দীন মোল্লা। ১৯৪১ সালে ভাঙ্গা পাইলট হাইস্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ১ বছর লেখাপড়া করার পর ভর্তি হন কোলকাতার সুরেন্দ্র মোহন কলেজে। সেখান থেকে ১৯৪৪ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে তিনি ডিগ্রি পাশ করেন ১৯৪৬ সালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে শামসুদ্দীন মোল্লার পরিচয় স্কুল জীবন থেকেই। ইসলামিয়া কলেজে একই ক্লাসে অধ্যায়ন এবং কলেজ হোস্টেলের একই রুমে থাকার সুবাদে তাদের ঘনিষ্ঠতা বন্ধুত্বে রূপ নেয়। বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরনায় শামসুদ্দীন মোল্লা নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের সান্নিধ্যে আসেন।
শামসুদ্দীন মোল্লা ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল. এল বি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ইতি মধ্যে তিনি জড়িয়ে যান স্বক্রিয় রাজনীতিতে। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের সেই প্রথম ভাগেই একাগ্রভাবে অংশগ্রহন করেন। আবার রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নেই মুসলিমলীগ ও তাদের রাজনীতির সম্পর্কে চিরতরে মোহভঙ্গ হয় শামসুদ্দীন মোল্লার। ১৯৪৯ সালে মাওলানা ভাষানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে শামসুদ্দীন মোল্লা তার কার্য নির্বাহী কমিটিতে জায়গা করে নেন। তখন থেকেই শুরু হয় তার বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে সম্পর্ক অটুট ছিল ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট নির্মম হত্যাকান্ডের দিন পর্যন্ত। ৭৫ পরবর্তী প্রেক্ষাপটেও তার আদর্শ থেকে কখনও বিচ্যুত হননি শামসুদ্দীন মোল্লা। শত ভয়ভীতি-দমন পীড়ন উপেক্ষা করেও তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
৬ দফা ও স্বাধীকার আন্দোলন বেগবান এবং আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে বঙ্গবন্ধুর অত্যান্ত বিশ্বস্হ্য হাতে গোনা যে ক‘জন নেতা ছিলেন তার মধ্যে মোল্লা সাহেব ছিলেন অন্যতম। সংগত কারনেই তার নিজের জেলা ফরিদপুরকে সুসংগঠিত করতে দায়িত্ব দেন শামসুদ্দীন মোল্লাকে। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন তিনি। ১৯৬২ সালে যখন আইয়ুব সরকার বিরোধী ছাত্র আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয় তখন দিশেহারা আইয়ুব সরকার কঠোর অবস্হানে চলে যায়। আইয়ুব সরকারের মামলা, গ্রেফতার ও গোয়েন্দা নজরদারী উপেক্ষা করে, ভয়ভীতির তোয়ক্কা না করে দল এবং আন্দোলন সুসংহত করার লড়াই চালিয়ে যান এ্যাডভোকেট শামসুদ্দীন মোল্লা।
১৯৬৪ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান যখন টালমাটাল তখনও শামসুদ্দীন মোল্লার নেতৃত্বে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সম্মিলিত ভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে ফরিদপুর জেলাকে স্বাভাবিক রাখতে সমর্থ হন। তৎকালীন সময়ে ১ম দিকে এ্যাডভোকেড আসমত আলী খান এবং পরবর্তীতে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এ্যাডভোকেট আদেল উদ্দীন আহমেদ।
মরহুম শামসুদ্দীন মোল্লার নেতৃত্বকালীন সময়ে ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন মহকুমায় যারা আওয়ামী রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পালন করেছিলেন তারা হলেন….ফরিদপুরে- সর্ব জনাব, এ্যাডঃ গৌরচন্দ্র বালা, ইমাম উদ্দীন আহমেদ, এস এম নুরুন্নবী, লিয়াকত হোসেন, এ্যাডঃ মোশারফ হোসন, সৈয়দ হায়দার হোসেন, অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন, আমিন উদ্দীন আহ্মেদ (আমিন মাস্টার), আঃ রউফ মাস্টার, ব্যারেস্টার সালেহউদ্দীন খান, ফিরোজার রহমান (ফিরোজ মাস্টার), এ্যাডঃ কাজী খলিলুর রহমান, ডাঃ আফতাবউদ্দীন আহমেদ, এ্যাডঃ সৈয়দ আলীমুজ্জামান চুন্নু, এ্যাডঃ মোফাজ্জেল হোসেন, এ্যাডঃ মজিবুর রহমান খান, এ্যাডঃ গাজী আব্দুল হাকিম, খন্দাকার আব্দুল জব্বার, আঃ হাই মিয়া, মোঃ সোলায়মান, মোঃ নুরুল ইসলাম, মোঃ জাফর (বড় জাফর), লুৎফার রহমান, বাঁশী মাষ্টার, আসমত আলী সিকদার, আয়নাল হক। মাদারীপুর- আসমত আলী খান, ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী, ডাঃ আবুল কাশেম, শাজাহান সরদার, আব্দুল মান্নান খান, হারুন অর রশিদ মোল্লা, শওকত হাওলাদার। গোপালগঞ্জ- মোল্লা জালাল উদ্দীন, এ্যাডঃ কাজী আঃ রশিদ, ডাঃ ফরিদ আহমেদ, নজীর হোসেন তালুকদার, কামরুল ইসলাম রইস। রাজবাড়ী- এ্যাডঃ ওয়াজেদ আলী চৌধুরী, কাজী হেদায়েত হোসেন, নুরুল হক, নজীর আহমেদ।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই হাত মিলিয়ে ছিলেন বেইমান খুনি মোস্তাকের সাথে। শামসুদ্দীন মোল্লা তার কর্তব্য এবং নেতার আদর্শের কারনে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। এই নির্মম ঘটনার প্রতিবাদ ও প্রতিশোধের জন্য যে কয়জন নেতা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শামসুদ্দীন মোল্লা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। এ নির্মমতার প্রতিবাদ জানাতে ঢাকা শহরে ১ম যে মিছিল হয় মোল্লা সাহেব ছিলেন তার অগ্রভাবে। ৩রা নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যার পর এ্যাডঃ শামসুদ্দীন মোল্লার উপরেও মৃত্যু পরোয়ানা জারী হয় এমতাবস্হায় কোন উপায় না পেয়ে তিনি ভারতে চলে যান। ভারতে গিয়েও তিনি চুপচাপ থাকতে পারেনি। বিবেকের তাড়না থেকেই তিনি জনমত তৈরী করতে থাকেন ঘৃন্য এসব হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানাতে।
উল্লেখ্য ১৯৭২ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশের সংবিধান রচয়িতা কমিটি। যে কমিটি অন্যতম সদস্য ছিলেন মরহুম শামসুদ্দীন মোল্লা। কমিটির সদস্যদের সাথে কাধেঁ কাধঁ মিলিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে অল্প সময়ের মধ্যে জাতিকে একটি অসাধারন সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন, যা বাংলাদেশে ইতিহাস হয়ে আছে।
বিশিষ্ট সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী মরহুম শামসুদ্দীন মোল্লার স্মৃতিচারন করতে গিয়ে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার একটা মার্জিনাল ব্যাপার হতে পারে। সবাই চায় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ। কিন্তু ছাত্র থাকা কালে ইসলামিয়া কলেজে বঙ্গবন্ধু ও শামসুদ্দীন মোল্লার মধ্যে যে সম্পর্ক সেটা ব্যক্তিগত সম্পর্কের চেয়ে আদর্শিক সম্পর্কটাই পরবর্তী জীবনে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন শাহ আজিজ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে তাই বলে শাহ আজিজ তো পরবর্তী কালে পুতুল প্রধানমন্ত্রী হতে আপত্তি করেননি। এটা বড় কথা নয়, আদর্শিক এবং ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব, এটার যোগফল ঘটেছিল শামসুদ্দীন মোল্লা নেতৃত্বে। যার ফলশ্রুতিতে তিনি সব দুঃখ-দারিদ্র্য এমনকি নিজের পরিবারের কথা ভূলে গিয়ে একটি আদর্শিক সংগ্রামে দাঁড়াতে পেরেছিলেন। এখানেই তার বৈশিষ্ট। আজকের রাজনীতিতে শামসুদ্দীন মোল্লার মত মানুষদের প্রয়োজন ছিল। বেঁচে থাকলে দেশটাকে, ফরিদপুরটাকে নতুনভাবে রূপান্তর করতেন।
মরহুম শামসুদ্দীন মোল্লার মত মানুষরা এযুগের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। আমরা যখন আদর্শ ভ্রষ্ট হচ্ছি রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতি থেকে; এক্ষেত্রে একজন শামসুদ্দীন মোল্লার দরকার এবং তার মত অনেক অনুসারী দরকার। যারা আমাদের অবক্ষয়কে দূর করে জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারবে।
বর্তমান রাজনীতিতে তথাকথিত অনুপ্রবেশকারী, অরাজনৈতিক গোষ্ঠির হাত থেকে দল ও রাজনীতিকে রক্ষায় সারা বাংলাদেশের এসকল ত্যাগী নেতাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আওয়ামী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করাই হবে সঠিক উপায়।