ইস্পাত কঠিন মনোবল,দৃঢ়চেতা,সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা,মার্জিত রুচি বোধ, উন্নত ব্যাক্তিত্ব ,মানবিক বোধ , মননশীলতা , আধুনিক বিবেক বোধ সম্পূর্ণ একজন পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন আমার বাবা জায়নুল আবেদীন।
২০১৯ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর চলে যান আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে।
আজ বছর পূর্তি আব্বাকে না দেখার,আব্বা বলে না ডাকার। নিজের মনকে সান্তনা দেই মানুষ তো একদিন চলে যাবেই কিন্তু মনের অজান্তেই ভাবি এই তো সেদিন আব্বা ছিল পাশের ঘরে, ছুটে যাই, মনে হয় চিৎকার করে কান্না করি,করতে পারিনা, নিজে বাবা হয়েছি,আমার ১০ বছরের সকাল আমাকে কাঁদতে দেয়না। তখন ভাবি ছেলে বাবা হয়ে যায় কিন্তু বাবা ছেলে হতে পারে না, আমার সকালও একদিন বাবা হয়ে যাবে আর আমি…….।
আমি মা বাবার ছোট ছেলে, ৭ ভাই বোনের মধ্যেও ছোট। সবার ছোট হবার সুবাদে ভালোবাসাটাও বেশীই পেয়েছি। আব্বার কোলে কখনও চড়বার সুযোগ হয়েছে কিনা নিজের তো মনে পরেই না,ভাই বোনদের কাছেও কখনো শুনিনি তাই বলে ভালোবাসা আদরের কমতি ছিল কখনও মনে হয়নি। আব্বার ভালোবাসার
মধ্যেও ছিল ব্যক্তিত্ব বোধ। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি দেখেছি আব্বা কোথাও গেলে শুনশান নিরবতা, তার ব্যক্তিত্বের কাছে সবাই যেন কিছুটা গুটিয়ে নিয়েছে নিজেদের। আব্বা লক্ষীপুরের রাস্তায় ঢুকেছে বাসায় ফিরছে এই কথা মোটামুটি সবার কানেই চলে যেত, যুবক বয়সের কেউ রাস্তায় থাকলেও সেই সময়ের জন্য তার থেকে ভদ্র আর নিরীহ কেউ এই ইহলোকে আর থাকত না।
আমি যখন মিশন স্কুল থেকে ৩য় শ্রেণি শেষ করে ফরিদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেনিতে ভর্তি হলাম তখন অদ্ভুত এক সমস্যায় পড়তে হলো আমাকে বাড়িতে কড়া বাবা আর স্কুলে ভীষণ রাগী প্রধান শিক্ষক। সে সময়ে স্কুলে উত্তম মধ্যম দেবার প্রচলন ছিল। প্রত্যেক শিক্ষক ক্লাশে একখানা বেত নিয়ে যেতেন আর
এব্যাপারে আব্বা ছিলেন সিদ্ধহস্ত, আব্বার জোড়া বেত ছিল সেটাতে তেল দিয়ে পাকানোর দ্বায়িত্ব ছিল আমার ভীষণ পছন্দের মানুষ দপ্তরী খবীর ভাইয়ের উপর। কিছু দিন ক্লাশ করার পরে পূর্ণ রূটিন পেলাম তাতে দেখলাম আব্বার কোনো ক্লাশ নেই, হাফ ছেড়ে বাচলাম। আরও পরে জানতে পারলাম আব্বা শুধুমাত্র নবম আর দশম শ্রেনীতে ক্লাশ নেন আরো কিছু দিনের জন্য নিশ্চিন্ত হলাম।
আব্বার পছন্দ অপছন্দ (সেটা অবশ্যই সঠিক থাকত) বোঝানোর পদ্ধতিও ছিল আলাদা। একটু বলি ৯৪ সাল আমি নবম শ্রেনীতে পড়ি তখন ফরিদপুরে পল্লী কবি জসীম মেলা খুব জনপ্রিয়, আমি ঢাকায় বড় ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে এসে বঙ্গবাজার থেকে একটি স্কীন টাইট জিন্স আর সোয়েটার কিনেছি,পড়ে মেলায় যাবো প্লানমাফিক ড্রেস পরে বাড়ি থেকে বের হয়েছি আর মনে মনে বলছি আব্বার সাথে যেন দেখা না হয়, বের হওয়া মাত্রই আব্বার সাথে দেখা প্যান্টের দিকে তাকালেন তারপর বললেন বাসাই চল।
ফিরলাম, বললেন আর প্যান্ট নাই বললাম আছে, ঠিক আছে সেটা পরে আমার কাছে আই তাই করলাম, আব্বা ৫০ টাকা আমার হাতে দিয়ে বললেন মেলায় দেরি করবি না আর কালকে আমার সাথে বাজারে যাবি প্যান্ট বানাতে দিবি আমার বুঝতে বাকী রইলনা স্কীন জিন্স আর পড়া যাবেনা।
আব্বার ভালোবাসা যে কতটা প্রগাড় ছিল বুঝতে শুরু করলাম পড়াশোনার জন্য ঢাকা চলে আসলাম তখন।
মাকে ফোন দিলে বলত আব্বা নাকি বলে এতগুলো ছেলে- মেয়ে আর বাসায় কেউ নাই।
জীবন সায়ান্হে এসেও ছেলে মেয়ে কাউকে বিরক্ত না করার প্রয়াস চালাতেন।
চলে গেছেন রেখে গেছেন স্মৃতি আর ভালোবাসা।
ভালো থাকবেন আব্বা !!!!!!!!!!!!!
## কাজী রায়হানুল আবেদীন এর ফেইসবুক থেকে সংগৃহিত