নভেল করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯)-এর সংক্রমণে গোটা বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। এই ভাইরাসের ভয়াল থাবায় দেশে দেশে এখন স্বজনহারাদের আহাজারি। বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশেই মহামারি আকারে ছড়িয়ে গেছে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস। বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল এখনো চলছে। ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত ও শক্ত অর্থনীতির দেশও আজ নাগরিকদের জীবন ও অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে দিশেহারা হয়ে কোভিড-১৯ মোকাবিলার পথ খুঁজছে। করোনা মহামারির মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে ‘জীবন ও জীবিকা’ দুই ক্ষেত্রকে সমান গুরুত্ব দিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। একই সঙ্গে দরিদ্র মানুষকে ত্রাণ সহযোগিতায় নিয়েছেন নানা পদক্ষেপ। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদন যাতে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন না হয়, তার জন্য সরকার বিভিন্ন প্রণোদনার ব্যবস্থা করে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিধি বাড়ানোসহ নানামূখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
করোনার কারণে জনসমাগম এড়াতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে মুজিবশতবর্ষের সরাসরি অনুষ্ঠান বাতিল করে ভার্চুয়ালি করার সিদ্ধান্ত নেয়। বন্ধ করে দেয়া হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীদের জন্য টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এবং অনলাইন পাঠদান চালু করাসহ সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখে এবং অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা যাতে পড়াশোনায় নিযুক্ত থাকে সেজন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। দফায় দফায় বাড়িয়ে ৬৬দিনের সাধারণ ছুটির ঘোষণা করে সরকার । এরপর এলাকাভিত্তিক লকডাউন করার মতো কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। জনগণকে বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের না হওয়ার এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ এবং বিদেশফেরতদের ১৪ দিন বাধ্যতামূলক হোম কোয়ারান্টিনে থাকার নির্দেশনা দেয় সরকার।
করোনাভাইরাস মহামারির এই দুঃসময়ে সরকার জনগণের পাশে রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দ্যেশে দেয়া এক ভাষণে বলেন, “আমাদের সাধ্যমতো আমরা মানুষের পাশে রয়েছি। আমরা মানুষের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছি। আর এই করোনাভাইরাসের সময়ে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে বলে আমি মনে করি। ইনশাল্লাহ, এই দুঃসময় আমরা পার করতে পারব।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৩১ দফা নির্দেশনা:
দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কোভিড-১৯ এর উপসর্গ গোপন না রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনসাধারণকে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়াসহ ৩১ দফা নির্দেশনা জারি করেন।নির্দেশনা অনুযায়ী,করোনাভাইরাস সম্পর্কে চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ ও এ সম্পর্কিত সচেতনতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে লুকোচুরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য পিপিই নিশ্চিত করতে হবে। করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত পিপিই, মাস্কসহ সকল চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত রাখা এবং বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় নিয়োজিত সকল চিকিৎসক, নার্স, ল্যাব টেকনিশিয়ান, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, অ্যাম্বুলেন্স চালকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। যারা হোমকোয়ারেন্টাইনে বা আইসোলেশনে আছেন, তাদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে হবে।নিয়মিত হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। নদীবেষ্টিত জেলা সমূহে নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রাখতে হবে। সারাদেশের সকল সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে।
আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ে দৃষ্টি দেয়ার আহ্বান জানিয়ে নির্দেশনায় বলা হয়,জাতীয় এ দুর্যোগে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী, সশস্ত্রবাহিনী বিভাগসহ সকল সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিগণ যথাযথ ও সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন, এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। ত্রাণ কাজে কোনো ধরনের দুর্নীতি সহ্য করা হবেনা।
দিনমজুর, শ্রমিক, কৃষক যেন অভুক্ত না থাকে। তাদের সাহায্য করতে হবে। খেটে খাওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অতিরিক্ত তালিকা তৈরি করতে হবে। সোশ্যাল সেফটিনেট কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেন স্থবির না হয়, সে বিষয়ে যথাযথ নজর দিতে হবে। খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে, অধিক ফসল উৎপাদন করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার করতে হবে। কোনো জমি যেন পতিত না থাকে। সরবরাহ ব্যবস্থা বজায় রাখতে হবে, যাতে বাজার চালু থাকে। সাধারণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৫ এপ্রিল করোনাভাইরাসের আর্থিক ক্ষতি কাটাতে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন।
এর মধ্যে শিল্প ঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ২০ হাজার কোটি টাকা, রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা, রফতানি উন্নয়ন ফান্ড ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, প্রিশিপমেন্ট ঋণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা, গরিব মানুষের নগদ সহায়তা ৭৬১ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে দশ টাকা কেজিতে চাল দেয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা। এছাড়াও করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।এর আগেও বিভিন্ন সময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আনতে সরকারের তরফ থেকে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এবারের মতো এতো বড় আকারের প্রণোদনা প্যাকেজ এর আগে আর দেয়া হয়নি।
করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক স্থবিরতা মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত বিভিন্ন সহায়তার প্যাকেজ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে অনেক আগেই। কিছু কিছু ব্যক্তি-পর্যায়ের প্যাকেজ সহায়তা বিতরণ কর্মসূচি শেষ হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। কিছু এখনও চলমান। তবে ব্যবসায়িক সহায়তা প্যাকেজ পুরোটাই বাংলাদেশ ব্যাংক বাস্তবায়ন করছে। বর্তমানে এ প্যাকেজ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় গতিও এসেছে। ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিখাতের সুবিধাভোগীরা এ উদ্যোগকে সমযোপযোগী বলে উল্লেখ করেছেন।
সরকার ঘোষিত খাতভিত্তিক প্রণোদনার মধ্যে শিল্প ঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা, রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ বাবদ পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এর পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা, রফতানি উন্নয়ন ফান্ড ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, প্রি-শিপমেন্ট ঋণ বাবদ পাঁচ হাজার কোটি টাকা, গরিব মানুষের নগদ সহায়তায় ৭৬১ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে দশ টাকা কেজিতে চাল দেওয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকার বাইরেও করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এছাড়া করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মোকাবিলা সংক্রান্ত ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ শীর্ষক একটি বড় প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (আরএডিপি) আওতায় এবার এই প্রকল্পের জন্য ‘বিশেষ প্রয়োজনে উন্নয়ন সহায়তা’ খাত থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২০৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। অনুমোদিত বিনিয়োগ প্রকল্পের অনুমোদিত অঙ্গসংস্থান অনুযায়ী ব্যয় করতে হবে এবং টাকা খরচের ক্ষেত্রে সব ধরনের আর্থিক বিধিবিধান অনুসরণ করতে হবে।
করোনাকালে রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য স্বল্প সুদে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়ার ফলে মন্দার সময়ে শিল্প কারখানার মালিকরা অতিরিক্ত চাপ ছাড়াই তাদের কর্মী-শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারছেন। সরকারের পক্ষ থেকে ঋণ সহায়তা বাবদ এটি তাদের দেওয়া হচ্ছে। এটি পুরোপুরি অনুদান নয়। এছাড়াও মাঝারি-ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য যে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে সেটা দিয়ে আর্থিক ক্ষতি সামাল দিতে পারবেন এই ব্যবসায়ীরা। তারা মন্দা কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে পারবেন। এভাবে কৃষক, রফতানিকারকরা একইরকম সুবিধা পাচ্ছেন।
করোনাকালে রোজার ঈদে দেশের প্রতিটি মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনকে ‘ঈদ উপহার’ হিসেবে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২ হাজার ৫০০ টাকা হারে দেওয়া হয়েছে প্রতিটি মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনকে।
করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়া দেশের নিম্ন আয়ের ৫০ লাখ পরিবারের জন্য নগদ অর্থ সহায়তা বিতরণ করা হয়েছে। পরিবারপ্রতি দেওয়া হয়েছে আড়াই হাজার টাকা। এ খাতে সরকারের মোট ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। সারা দেশের নন-এমপিও কারিগরি, মাদ্রাসা ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫১ হাজার ২৬৬ জন শিক্ষককে জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা এবং ১০ হাজার ২০৪ জন কর্মচারীকে জনপ্রতি ২ হাজার ৫০০ টাকা হারে সর্বমোট ২৮ কোটি ১৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে আর্থিক অনুদান হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে।
করোনাকালীন সংকটের জন্য প্রধানমন্ত্রী ১৩ হাজার ৯২৯টি কওমি মাদ্রাসার এতিম দুস্থদের জন্য ১৬ কোটি ৯৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অধীন নন-এমপিও ৮০ হাজার ৭৪৭ জন শিক্ষক এবং ২৫ হাজার ৩৮ জন কর্মচারীর অনুকূলে ৪৬ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার টাকার আর্থিক অনুদান দিয়েছেন। সরকারের এসব অনুদান সহায়তা বিতরণ করা হয়েছে। দেশের ৬ হাজার ৯৫৯টি কওমি মাদ্রাসাকে ৮ কোটি ৩১ লাখ ২৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
করোনা মহামারি ব্যবস্থাপনায়ও সরকার নানাবিধ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। হাসপাতালের অবকাঠামোগত দিক ও রোগীর সংখ্যাধিক্যের কথা চিন্তা করে সারাদেশে হাসপাতালসমূহকে কোভিড ও নন-কোভিড এ দুভাগে বিভক্ত করে রোগীর চিকিৎসাসেবা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এছাড়াও চিকিৎসা সুরক্ষা সরঞ্জাম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুযায়ী সরবরাহ করা ও চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ট্রেনিংয়ের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। একই সাথে কোভিড রোগীর চিকিৎসার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুসরণ করে মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ‘চিকিৎসা গাইডলাইন’ প্রস্তুত করা হয়। মহামারি মোকাবিলায় লোকবল সংকট কাটিয়ে উঠতে দ্রুততার সাথে চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। সময়ের সাথে বেসরকারি হাসপাতালসমূহকে কোভিড চিকিৎসায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় ।
স্বাস্থ্যখাতকে বর্তমান সরকার সব সময়েই প্রাধান্য দিয়ে আসছে, তারই ধারাবাহিকতায় এবার স্বাস্থ্যখাতে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী যারা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কাজ করছেন তাদের জন্য ৮৫০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। সারের ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার কোটি টাকা, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের জন্য ১০০ কোটি টাকা, বীজের জন্য ১৫০ কোটি টাকা এবং কৃষকদের জন্য আরও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা ভাইরাসের সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে বিভিন্ন খাতে মোট প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, যা দেশের মোট জিডিপির ৪ দশমিক ০৩ শতাংশ।
জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর ছয় প্রস্তাব:
সম্প্রতি জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের ভার্চুয়াল বৈঠকে করোনা মহামারির কারণে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় উঠে আসা দেশগুলোর জন্য ২০৩০ সাল পর্যন্ত নতুন আন্তর্জাতিক সহায়তার ব্যবস্থা রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, কোভিড-১৯ সংকট মোকাবিলায় আমাদের সু-সমন্বিত বৈশ্বিক রোডম্যাপ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ২০২০ এজেন্ডা, প্যারিস চুক্তি, আদ্দিস আবাবা অ্যাকশন এজেন্ডা এই সংকট কাটিয়ে ওঠার হাতিয়ার হতে পারে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘকে অব্যাহতভাবে কার্যকর ভূমিকা রেখে যেতে হবে। তিনি কোভিড-১৯ সংকটের মোকাবিলা করতে আরও উন্নত সমন্বিত রোডম্যাপ তৈরি করার জন্য বিশ্বনেতাদের সামনে ছয় দফা প্রস্তার তুলে ধরেন। দফাগুলো হলো:
প্রথম: জি-৭, জি-২০, ওইসিডি দেশগুলো, এমডিবি এবং আইএফআইগুলোকে অর্থনৈতিক প্রণোদনা দিতে হবে এবং ঋণ মওকুফে পদক্ষেপ নিতে হবে। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে ওডিএ এর ০.৭ প্রতিশ্রতির বাস্তবায়ন করতে হবে।
দ্বিতীয়: আমাদের আরও বেশি বেসরকারি অর্থ ও বিনিয়োগ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সরিয়ে নিতে হবে। ডিজিটাল বিভাজন বন্ধ করার জন্য আমাদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনকে কাজে লাগাতে হবে।
তৃতীয়: কোভিড-পরবর্তী শ্রম বাজারে এবং প্রবাসী শ্রমিকদের সহায়তা করার মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহের নিম্নমুখী প্রবণতার বিপরীতমুখে নেয়ার জন্য সঠিক নীতিমালা করার পদক্ষেপ প্রয়োজন।
চতুর্থ: উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোকে অবশ্যই উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য শুল্ক এবং কোটামুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার, প্রযুক্তি সহায়তা এবং আরও প্রবেশযোগ্য অর্থায়নের বিষয়ে তাদের অদম্য প্রতিশ্রুতি অবশ্যই পূরণ করতে হবে।
পঞ্চম: কোভিড-১৯ মহামারির কারণে স্বল্পন্নোত দেশ থেকে উত্তরণের পর যাতে পেছনে যেতে না হয়, এজন্য অন্তত ২০৩০ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সহায়তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ষষ্ঠ: জলবায়ু সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড এবং স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের জন্য অর্থ সংগ্রহে আরও জোর প্রচেষ্টা করা দরকার।
করোনা ভ্যাকসিন
৪ জুন ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্মে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (গাভি) আয়োজিত ভ্যাকসিন সামিটে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি দ্রুত ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আহ্বান জানান এবং সংস্থাটির তহবিল বাড়াতে অনুদান দিতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। সরকার ইতোমধ্যে করোনা ভ্যাকসিন সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু করেছে। “এটি যে জায়গায় উদ্ভাবিত হবে, আমরা সেখান থেকে এটি সংগ্রহ করব। এ বিষয়ে আমরা যথেষ্ট আন্তরিক”বলে জাতিকে আশ্বস্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। জাতিসংঘের ৭৪তম অধিবেশনে এক ভার্চুয়াল বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন “বিশ্ব শিগগিরই কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন পাবে। এই ভ্যাকসিনকে বৈশ্বিক সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। সকল দেশ যাতে এই ভ্যাকসিন সময় মত এবং একইসঙ্গে পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। কারিগরি জ্ঞান ও মেধাসত্ব প্রদান করা হলে, এই ভ্যাকসিন বিপুল পরিমাণে উৎপাদনের সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে।’
করোনাকালে বাংলাদেশের অর্থনীতি :
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক অতি সম্প্রতি জানিয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর গতি বেশ উৎসাহব্যাঞ্জক। তারা আভাস দিয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী জুনে শেষ হতে যাওয়া অর্থবছরে এ দেশের অর্থনীতিতে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে।
করোনাভাইরাস মহামারি কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে । এক্ষেত্রে আশা দেখাচ্ছে পোশাক খাত ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি যেখানে প্রায় ৮৩ শতাংশ কমে ৫২ কোটি ডলারে নেমে গিয়েছিল, সেখানে জুলাই মাসে তা দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে ৩৯০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। এ ছাড়া মে-জুন সময়ে আমদানি বেড়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে রপ্তানি এক বছর আগের তুলনায় ৪ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে ২৯৬ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে ।জুলাই ও আগস্ট মিলিয়ে মোট পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৫৭০ কোটি ডলারের। এ সময়ে মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ২০৬৪ মার্কিন ডলার। এ থেকে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের গতি স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।
এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন প্রকাশ বলেছেন, যথাযথ অর্থনৈতিক প্রণোদনা এবং সামাজিক সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা’ গ্রহণের মাধ্যমে সরকার ভালোভাবে সংকট সামাল দিয়েছে । রপ্তানি ও রেমিটেন্স প্রবাহে প্রবৃদ্ধি বেশ উৎসাহব্যাঞ্জক এবং আশা করা হচ্ছে অর্থনীতির এই ঘুরে দাঁড়ানো হবে টেকসই, যা প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের প্রশংসা:
করোনা সংকট মোকাবিলায় দ্রুত বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ায় দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হচ্ছেন শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ফোর্বস ম্যাগাজিনসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করা হয়েছে। ২৪ এপ্রিল এক আর্টিকেলে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপের প্রশংসা করেছে বিখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বস। একইসঙ্গে প্রশংসা করা হয়েছে তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বেরও। শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৬১ (১৬ কোটির বেশি) মিলিয়ন মানুষের বাস। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দক্ষতার সঙ্গে সংকট মোকাবিলা করা তাঁর জন্য নতুন কিছু নয়। এরই ধারাবাহিকতায় করোনা মোকাবিলায়ও তিনি নিয়েছেন দ্রুত পদক্ষেপ।
প্রশংসা করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিকফোরামও।এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের আয়োজিত ‘এনহ্যান্সিং রিজিওন্যাল কো-অপারেশন ইন সাউথ এশিয়া টু কমব্যাট কোভিড-১৯ রিলেটেড ইমপ্যাক্ট অন ইটস ইকোনোমিকস’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল সম্মেলনে গণভবন থেকে যোগ দেন শেখ হাসিনা। এ সম্মেলনে বিশ্বকে এক হয়ে করোনা মোকাবিলা করার আহ্বান জানান তিনি। ১৫ মার্চ গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে কোভিড-১৯ ঠেকানোর লড়াইয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে সার্ক নেতাদের আহ্বান জানান তিনি। ২৫ মে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সহায়তা প্রদান বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। শি জিনপিংয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী পরে চীন বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশে আসে।
শেষ কথা:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ দেশের জনগণের জন্য আশীর্বাদ। তার সঠিক নির্দেশনা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনায় মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সঠিক পথে এগোচ্ছে। করোনা মহামারির এই সংকটে জনগণের পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “যতদিন না এই সংকট কাটবে, ততদিন আমি এবং আমার সরকার আপনাদের পাশে থাকব।’’ এই বৈশ্বিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের নেয়া উদ্যোগ তখনই সফল হবে যখন জনগণ সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করবে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করে যাওয়া তাই সময়ের দাবী।
## লেখক: মো:কামাল হোসেন ,তথ্য অফিসার ,তথ্য অধিদফতর