সেকাল থেকে একাল ৩
গুড় বাজারের দক্ষিণে কোতোয়ালি থানা। এই থানার প্রধান প্রবেশ পথ ছিল থানার উত্তর দিকে।সুন্দর পরিস্কার পরিচ্ছন ছিল থানা এলাকা ।
প্রবেশ পথের হাতের ডানে ছিল একটি ফুল বাগান ।সকাল বেলা একজন মালি বাগান পরিচর্যা করতেন। আমি প্রায়ই কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম।কোনো কোনো ওপড়ানো ফেলে দেওয়া ফুল গাছ নিয়ে এসে বাড়িতে লাগিয়েও ছিলাম। তবে একটিও বাঁচেনি।
কারণ এক চিলতে উঠোনে মাটি তেমন ছিল না। প্রায় অংশেই ছিল ইট। সামান্য মাটি যাও ছিল দেয়ালের দিকে তা ছিল এক ধরনের শুখনো মাটি।আর রোদেরও অভাব ছিল। তবে চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।
এ সময়েই প্রথম ফুল গাছের সাথে আমার পরিচয় । কোতোয়ালি থানার বাগানে সে সময়ে দেখেছি গোলাপ, কলাবতী,লাল জবা ,বেলি,দোপাট্টা ও গাদা ফুল গাছ। এই বাগানের নেশা পরে পূরণ করে ছিলাম ১৯৫১ সালে ঝিলটুলিতে গিয়ে।
আমাদের গুড় বাজারের বাডিতে দেওয়ার ঘেষে একটি বাতাবি লেবুর গাছ ছিল। আমরা বাতাবিকে সেলম বলতাম।
পাশে নানার (মার চাচা) চেম্বারের পশ্চিম দক্ষিণে ছিল একটি শেফালী ফুলের গাছ। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখতাম অজস্র শেফালি ফুল নীচে পড়ে আছে। আমি কুড়িয়ে আনতাম।
শেফালী ফুল সেই থেকে আমার প্রিয় ফুলের একটি। শেফালি বা এই শিউলি ফুলের হালকা গন্দ বেশ আনন্দ দায়ক।
ওরিয়েন্টাল হাউজের পূর্ব দিকে একটি তাল গাছ ও একটি পিচ ফলের গাছ ছিল । এই পিচ ফল গাছে বানর ছিল। হঠাৎ গাছ থেকে বানার আমাদের ঘরে ঠুকে পড়ত।
আমি আমার বোন লিলিকে নিয়ে ভয়ে চকিতে চুপ করে বসে থাকতম। অল্প বয়সের স্মৃতি অল্পই মনে থাকে।
ঝিলটুলিতে এসে অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠেই বের হতাম ফুল চুরি করার জন্য। প্রায় হিন্দু বাড়িতেই ফুলের বাগান ছিল। এই সব বাড়ির বাগান থেকে ফুল চুরি ছিল প্রতিদিনের কাজ।
আমাদের বাড়ির পাশে ছিল রায় বাহাদুর নলিনী কান্ত সেনের বিশাল বাগান বাড়ি। এমন কোন ফুল ও ফল মনে পড়ে না, যা এই বাড়িতে ছিল না। নলিনী কান্ত সেন কে আমি দেখিনি। তিনি তখন ইন্ডিয়া। তিনি প্রখ্যাত উকিল ছিলেন।
এই সময়ে এই বাডিতে থাকতেন যামিনী কান্ত লাহিড়ী উকিল। এই উকিল বাবুর এক ভাই রজনী কান্ত লাহিড়ী। যামিনী কান্ত লাহিড়ীর পুত্র কন্যাদের মধ্যে ছিল ভারতি,তুষার ও হিমু।
আর কোনো সন্তান ছিল কি না, মনে নেই। রজনী কান্ত ছিলেন অবিবাহিত। অত্যন্ত সুন্দর দ্বিতল বিল্ডিং। বাড়ির দক্ষিণে বিশাল পুকুর।
গেট দিয়ে ঠুকতেই হাতের ডানে ও বিল্ডিং এর পূর্ব দিকে টিনের কয়েকটি ঘর বাড়ি ছিল। আমাদের বাস ভবন ঘেষে একটু পশ্চিম দক্ষিণে যে টিনের ঘর
ছিল, সেখানে থাকত আমার কলেজ জীবনের সহপাঠী ও ইয়াছিন কলেজের সহকর্মী অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ সাহা
সুনীল নামে একটি ছেলে ও তার মা কিছুদিন রবীন্দ্রনাথদের পাশের টিনের ঘরে ছিল।রবীন্দ্রনাথের বড় ভাইয়ের নাম ছিল দুলাল। আর বড় বোনের নাম ছিল শান্তি। রবীন্দ্রনাথের বাবা অনেকটা কুজা হয়ে গিয়েছিলেন।
সকাল বেলা মুড়ি,মোয়া ইত্যাদি নিয়ে বাজারে চকবাজারের দ্বিতীয় গলির ডান দিকে বিখ্যাত পান সিগারেট বিড়ির দোকানের সামনে ছালা বিছিয়ে দোকান সাজিয়ে বসতেন।
সে সময়ে ঘরে ঘরে রেডিও ছিল না। এই পানের দোকানে একটি রেডিও ছিল। সকাল সন্ধ্যায় লোকজন দাঁড়িয়ে ভীড় করে সংবাদ শুনতেন।আমাদের পাড়ায় লুৎফর মিয়ার বাসায় একটি রেডিও ছিল।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকজন ক্রিকেট খেলার রিলে শুনতেন। অল্প বাড়িতেই ইলেকট্রনিক ফ্যান ছিল।আব্বা ঝিলটুলিতে এসে একটি পাকা কেনেন এবং আবদুস সালাম খান উকিলকে কথা প্রসঙ্গে বলেন।তিনি আব্বাকে বলেন,মজিদ তুই পাখা কিনেছিস কেন?তুই কি পাখ কেনার উপযুক্ত হয়েছিস।
আব্বা বললেন,কিনলাম একটা। এই পাখাটা এই সেদিন পর্যন্ত অনেক পাখার মধ্যেও টিকে ছিল।আব্বা কৈজুরী ভবনে অবস্থিত সোলেমানের ইলেকট্রিক সরঞ্জামের দোকান থেকে কিনেছিলেন। সোলেমান সাহেবের বাড়ি ছিল চিটাগাং। তিনি সাইকেল চড়ে যাওয়া আসা করতেন। সাইকেলের সাথে বেশ কয়েকটি ভেড়াও আসা যাওয়া করত।