মনির মোল্যা, সালথা (ফরিদপুর) প্রতিনিধি:
আব্বু প্রতিদিন রাতে আমার জন্য চকলেট ও খেলনা কিনে নিয়ে বাসায় আসতো। যদি রাতে দোকান খোলা না পেতেন, তাহলে সকালে ঘুম থেকে ওঠেই আগে আমার চকলেট কিনে আনতো। আব্বু আমাকে অনেক আদর করতো। আজকে আমার আব্বুকে মসজিদের পাশে কবর দিয়ে রাখছে। এখন থেকে আর কেউ আমাকে খেলনা ও চকলেট কিনে দেবে না। বাবাকে হারানোর পর এভাবেই কথাগুলো বলছিল সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাইফুল ইসলাম রুবেলের চার বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে সাবিহা।
গতকাল রবিবার (১৫ ডিসেম্বর) বেলা ২টার দিকে দায়িত্ব পালনকালে কর্মস্থল গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট আঞ্চলিক মহাসড়ের আড়পাড়া এলাকায় কাভার্ড ভ্যান চাপায় নিহত হন এসআই সাইফুল ইসলাম রুবেল। তিনি গোপালগঞ্জে ডিএসবিতে কর্মরত ছিলেন। নিহত রুবেল ফরিদপুরের সালথা উপজেলার আটঘর ইউনিয়নের নকুলহাটি গ্রামের মৃত আব্দুল মান্নান মিয়ার ছেলে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন রুবেল। স্ত্রীসহ তার চার বছর বয়সি এক মেয়ে ও আড়াই মাস বয়সি এক ছেলে সন্তান রয়েছে। আজ রবিবার (১৫ ডিসেম্বর) সকাল ১০টায় নকুলহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানের রুবেলের লাশ দাফন করা হয়।
জানাজার পর সরেজমিনে রুবেলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, অকালে পরিবারের ছোট সন্তান হারিয়ে পাগলের মতো বিলাপ করছেন তার মা। আর চার বছরের মেয়ে সাবিহা বুঝতেই পারছেন না তার বাবা আর নেই। স্বামী হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে শিশু ছেলে কোলে নিয়ে বসে আছেন স্ত্রী তাহমিনা আক্তার সুরভী। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন যারা আসছে, তাদের জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছেন রুবেলের বড় ভাই শিক্ষক রাসেল মাহমুদ ও বোন নাজমা সুলতানা। মোটকথা পুরো পরিবাবের শোকের মাতম চলছে। স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে বাড়ির পরিবেশ।
রুবেলের মা সুফিয়া বেগম বলেন, আমরা ছেলের সাথে গোপালগঞ্জে থাকতাম। তবে সেখান থেকে বদলি হওয়ার কারণে দুই চার দিনের মধ্যে রুবেলের ঢাকার কর্মস্থলে যোগদানের কথা ছিল। তাই শনিবার দুপুরে বাসায় আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত দেওয়া হয়। সেই জন্য সকালে রুবেল ৬ কেজি খাসি, ৬ কেজি মুরগির মাংস ও ৬ কেজি দুধসহ বাজার করে আনে। দুপুরে রান্না-বান্নার কাজ শেষে রুবেলকে নিয়ে একসাথে খাবো বলে অপেক্ষায় ছিলাম। এরই মধ্যে খবর পাই, আমার ছেলে আর নেই। অনেক কষ্ট করে ছেলেকে মানুষ করেছিলাম। এভাবে তাকে হারাতে হবে জানা ছিল না।
স্ত্রী তাহমিনা আক্তার সুরভী বলেন, আমার মেয়ের পর ছেলে হওয়ায় অনেক খুশি হয়েছিল রুবেল। মেয়ে-ছেলে ছাড়া কিচ্ছু বুঝতো না তিনি। এখন আমার ছেলে-মেয়ের কি হবে। ওদের কে মানুষ করবে। সেই চিন্তায় আছি।
রুবেলের বড় ভাই শিক্ষক রাসেল মাহমুদ বলেন, আমার বাবা একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমাদের তিন ভাই-বোনকে উচ্চ শিক্ষিত করে দেশ ও মানুষের সেবায় নিয়োজিত করার চেষ্টা করেছেন। বাবার স্বপ্ন পুরণের জন্য ২০১৩ সালে অনার্স-মাস্টার্স শেষে সরাসরি পুলিশের এসআই পদে যোগদান রুবেল। ইতিমধ্যে ওসি হওয়ার জন্য পরীক্ষা ও ট্রেনিং শেষ করেছিল তিনি। আমার ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল ওসি হওয়ার এবং ছেলে-মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করার। তবে তার স্বপ্ন সড়কে পিষ্ট হয়ে গেল।
রুবেলের ফুফাতো ভাই উপজেলা বিএনপির যুগ্ম-সাধারন সম্পাদক খায়রুল বাসার আজাদ, স্থানীয় শাহিন ও সাইফুল ইসলাম বলেন, রুবেল অত্যন্ত ভদ্র ছেলে ছিল। পুলিশের চাকরি করে দেশ সেবার পাশাপাশি ছুটিতে বাড়িতে এসেও তিনি বসে থাকতেন না। গ্রামের যুব সমাজকে মাদক থেকে ফেরাতে তিনি তাদের নিয়ে খেলাধুলায় মেতে ওঠতেন।
১৬ ডিসেম্বর ২০২৪