করোনাকালে বিষণ্ন সময় মোকাবেলা করবেন যেভাবে
আনসার উদ্দিন খান পাঠানঃএই করোনাকালে প্রায় সবধরণের ব্যবসা বাণিজ্যে ধস নামলেও মোবাইল ফোন অপারেটরদের ব্যবসা ভালই চলছে- এটা বুঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না । কলরেট কমেনি , ঘরে বন্দি মানুষের কথা বলা আর অন্তর্জালে সময় কাটানো বেড়েছে , সমানতালে বেড়েছে ব্যবহৃত টকটাইম আর ইন্টারনেট ডাটা ক্রয়ের খরচ ।
সামাজিক দূরত্বের ধাক্কা সামলাতে গিয়ে প্রিয়জনদের সাথে মানসিক দূরত্ব কমাতে চাইবেন সবাই এটাই স্বাভাবিক । ভাগ্যিস ফোন বা নেটে সহজে কথা বলার সহজ সুযোগের এই যুগে এই করাল মহামারী আঘাত এনেছে ।
তথ্য, বিনোদন, যোগাযোগ, প্রশান্তি, প্রফেশনাল কর্ম ইত্যাদির জন্য এখন মোবাইল ফোনটা হাতের কাছে ক্রমাগত অনিবার্য হয়ে উঠছে। আবেগ উৎকণ্ঠা একঘেয়েমি কমাতে পছন্দের মানুষের সাথে ফোনে কথা বলা এখন এক মহৌষধ ।
তা সেই প্রিয়জন নির্বাচনে আপনি যদি ভুল করেন সেটা আপনার শুধু সময় আর অর্থের অপচয়ই না, অন্য প্রান্তের ব্যক্তি যদি আপনাকে অবজ্ঞা করে, কটূক্তি করে কিংবা আপনাকে না বোঝে তাহলে কিন্তু আপনি নতুন ঝামেলাও খাল কেটে বয়ে আনতে পারেন।
সেক্ষেত্রে কন্টাক্ট নির্বাচনে আপনি একটু কৌশলী হতে পারেন (নতুন বা পুরনো প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য অবশ্য তা প্রযোজ্য হবে না )।
প্রথমেই বলব সেলিব্রেটি বা অনেক মানুষের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ এমন কাউকে ফোন করার চিন্তা বাদ দিন। তাদেরকে কুশল জিজ্ঞেস করার লোকের অভাব নেই, আপনার ফোন তার কাছে অযাচিত হবার সম্ভাবনাই বেশি। আপনার সাথে, তার দৃষ্টিতে গুরুত্বহীন কথা বলে তিনি নিজেকে সাধারণে নামিয়ে আনতে নাও চাইতে পারেন । নিজের জ্ঞান বৃদ্ধি বা বিনোদনের ইচ্ছায় তাদের কেবল ফলো করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখুন।
একেবারে চেনা না থাকলে এই গোত্রের কাউকে ফোন করার ইচ্ছে বাদ দিন।
এবার ভাবুন এই মুহূর্তে আপনি কার কার ফোন পেলে খুশি হতেন, কেন হতেন। কেন হতেন তা নিশ্চিত হওয়ার পরেই আপনি মনে মনে সেই ব্যক্তি হয়ে যান। তারপর ভাবুন আপনার ফোন পেলে আপনারই মত খুশি হতে পারেন কারা। তাদের কাউকেই ফোনটা করুন। অনেকদিন কথা হয় না বা এই ফোন করাটা আপনার সাথে যায় না তেমন ভাববেন না, এটা করোনাকাল, কারণ হিসেবে এটাই যথেষ্ট। আপনি যেমন কল করে ভারমুক্ত হতে চাইছেন, অন্যপক্ষ তেমনি কল রিসিভ করে ভারমুক্ত হতে চাইছেন, কঠিন সময়ের হিসাবই আলাদা। কি বলবেন? আপনি সেই আরাধ্য মানুষের কাছে যা শুনতে চাইছিলেন, তাই বলুন। আপনি হাসতে চাইছিলেন? তবে তেমন কিছু নিয়েই কথা বলুন। কাউকে পেলেন না এখন? ভাবনা কি, নিজের সাথেই নিজে কথা বলুন।
একা মানুষের প্রতিবাদ হচ্ছে কথা বলা। সব মানুষই মূলত একা, একাকীত্ব ঘুচাতেই সে কথা বলে সেতু বানাতে চায় সারাক্ষণ। আমি নিজে পেশাগত কারণে পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে এই করোনাকালে একা এক সরকারি বাড়িতে অবস্থান করছি। ভাবছিলাম একাকীত্বের যাতনা নিয়ে ফেসবুকে কিছু একটা লিখব। সহসা দেখলাম আমার এক বন্ধু, যিনি প্রিয়তমা স্ত্রী এবং একমাত্র পুত্র সাথে করে লকডাউন এলাকায় কদিন বাসায় বন্দি আছেন, তিনি তার নিদারুণ একাকীত্বের কথা লিখছেন। একাকীত্বের ভয়াবহতায় তিনি প্রায় মরে যাচ্ছেন। তা দেখে আমি আমার একার কথা বেমালুম ভুলে গেলাম ।
আসলে মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বাইরে যাবার জন্য পা বাড়ানোর সময়টাতে বাধা পাওয়ার সাথে সাথেই একা হতে থাকে। যিনি বা যারা পথ আগলে দাঁড়ায় প্রথমেই সে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। তারপর যত সে নিজেকে গুটিয়ে নেয় তত সে একা হতে থাকে, কেউ তাকে হাত বাড়িয়ে তুলতে না আসলে সে একাকীত্ব আরও প্রগাঢ় হয়। একসময় খরখুটো ধরে বাঁচার মত করে অবশিষ্ট থাকে কথা। আর কেউ না থাকলে সে নিজের সাথেই কথা বলে, একাকীত্ব ঘুচাতে চায়। এটিও মন্দ নয়। একটা লেখায় পড়ছিলাম , “We need to create physical space from each other right now, but we have an opportunity to get closer to others and ourselves” এই নিজের কাছে আসা মানে নিজের শরীর, নিজের টিকে থাকার যুদ্ধ, নিজের একাকীত্বের অভিনব ফিলিংস এসবকে জানা। আমরা সময়ের ভাগ্যবান সন্তান, প্রযুক্তি আছে এখন হাতের মুঠোয়, জানতে চাওয়ার উত্তরও পেতে পারি আঙ্গুলের ডগায়।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন , একাকী মন বড় চঞ্চল, সে বর্তমানে থাকতে চায় চায় না, কেবল ছুটে যায় হয় অতীতে নয় ভবিষ্যতে। জাপটে ধরা দুঃসময়কে মোকাবেলার জন্য তাকে বর্তমানে রাখাটা বড্ড জরুরি । অতীত ভাল ছিল বা ভবিষ্যতে কি হবে, সেসব নিয়ে ব্যস্ত থাকলে বর্তমানের লড়াইটা দুর্বল হয়ে যায় ।
যারা সফল তারা শত বিপত্তি সত্ত্বেও এই একাকীত্বের লড়াইটা ছাড়েননি। নেলসন ম্যান্ডেলা তার ২৭ বছরের কারাজীবনের ১৮ বছর কাটিয়েছেন প্রায় নির্জন রবেন আইল্যান্ডের কারাকক্ষে । কারাবাসকালে তিনি মা এবং বড় পুত্রকে হারান, তাদের শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকার অনুমতিও পাননি। বছরে মাত্র একবার স্বজনরা দেখা করতে পারতো। বছরে দুইটি চিঠি পাবার সুযোগ ছিল। সেই তিনি কি করে লড়তেন একাকীত্বের সাথে? লিখেছেন আত্মজীবনী Long Walk to Freedom এ ।
বিষণ্ন সময় মোকাবেলায় তার তিনটি অস্ত্র ছিল। প্রথমত তিনি আশা হারাননি, শত আঘাতেও তা ধরে রেখেছেন দৃঢ়ভাবে। দুঃখ ছিল কিন্তু হতাশা ছিল না। দ্বিতীয়, তিনি শরীরচর্চা ছাড়েননি। মন আর শরীর প্রফুল্ল রাখার প্রধান দাওয়া এটি। জানতেন সাফল্য যদি জীবনে আসেও , শরীরটা যদি সুস্থ না থাকে, সে পুরস্কার হাত বাড়িয়ে নেওয়াও যাবে না। তৃতীয়ত তিনি ঢাকনা খুলে আনন্দকে খুঁজে নিতেন। জানতেন আনন্দ হাতের কাছেই থাকে, তাকে মুক্ত করে নিজের কাছে আহ্বান করা চাই। বন্দিসেলের মেঝে আর দেয়ালে পিঁপড়ার সারি দেখেও তিনি সারাদিন কাটিয়ে দিতেন । পিঁপড়াজীবন দর্শনেই আনন্দ নিয়েছেন। ৭১ বছর বয়সে কারামুক্ত হয়ে গণমানুষের নেতা হয়ে বেঁচে ছিলেন আরও ২৪ বছর । আমরা সকলে তার মত এত মহান নই, আশার কথা যুদ্ধটাও তার মত এত কঠিন আর দীর্ঘ হবে না। যুদ্ধ জয়ের কৌশলটা আমরা নিতেই পারি।
শরীর তফাতে থাকুক, মনজুড়ে থাকুক। কথা চলুক, দূরের মানুষের সাথে, নিজের সাথে। সামাজিক দূরত্ব মানে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নয়। জানাই তো আছে, লড়ে যাওয়া মানুষ বরাবর জিতে যায়।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)