প্রতি মুহূর্তের জীবনে বাঁচার পক্ষে আমি। জীবনের পরবর্তী মুহূর্ত আমার হাতে আছে কিনা, আমরা কেউই তা জানি না। আমাদের সবাইকে নির্ধারিত সময়ে চলে যেতে হবে, সেটাই ধ্রুব সত্য। এই অনিশ্চিত জীবনে বর্তমানকে আমাদের শুধু যাপন নয়, উদযাপন করতে হবে।
করোনা প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। আসলে প্রতিটি রোগের ক্ষেত্রেই এটা মাথায় রাখা জরুরি। আমরা যেন প্রতিকারের পর্যায়ে যাওয়ার আগেই প্রতিরোধের দিকে মনোযোগ দিই।
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) পাঁচটি অবস্থাকে পাঁচটি অবস্থার পূর্বে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে ‘অসুস্থতার পূর্বে সুস্থতাকে গুরুত্ব দেওয়া’। আর এই সুস্থতাকে গুরুত্ব দেওয়ার মানেই হচ্ছে প্রতিরোধ।
দি ইকোনমিস্ট বলছে, ঢাকায় প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত। টেস্ট করার সীমাবদ্ধতা, বিভ্রান্তি, সামাজিক কুসংস্কার বা আক্রান্ত ব্যক্তিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার কারণে বিষয়টি পরিষ্কার হচ্ছেনা। তবে বাস্তবতা যাই হোক, করোনার ব্যাপকতাকে কেউ অস্বীকার করার সুযোগ নেই এবং কেউ করবেনও না বলে আমার বিশ^াস। তাই করোনার সাথে মানিয়ে নেয়া ছাড়া আমাদের আর উপায় নেই।
একসময় গ্রামের পর গ্রাম মানুষ কলেরায় মারা যেতো। কিন্তু তারা যদি জানতো সামান্য ফুটন্ত বিশুদ্ধ পানি পান করলে এই রোগে আক্রান্তের সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে, তবে হয়তো এতলোক মারা যেতো না। তাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রথমেই পরিবর্তন করতে হবে। করোনাকে অন্য দশটি সাধারণ রোগের মতোই মেনে নিয়ে এথেকে বেঁচে থাকার প্রয়াস চালাতে হবে।
করোনা প্রতিরোধে আমাদেরকে সামগ্রিক জীবনাচারের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। করোনাকে প্রতিরোধের বিষয়টিকে আমি প্রধানত দুইটি ভাগে ভাগ করতে চাই- প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি।
প্রাথমিক ভাগের প্রথম কাজটি হচ্ছে ঘরে থাকা এবং ঘরে থাকা। প্রশ্ন তৈরি হতে পারে, সবার পক্ষে কি সব সময় ঘরে থাকা সম্ভব? আসলেই তো, সবার পক্ষেতো ঘরে থাকাও সম্ভব না। তাহলে উপায় কী? যাদের পক্ষে সম্ভব, যতক্ষণ সম্ভব, যত বেশি সম্ভব, ঘরে থাকার চেষ্টা করতে হবে। যত বেশি নিজেকে আবদ্ধ রাখতে পারবেন, তত বেশি নিরাপদ থাকতে পারবেন।
প্রতিদিন বাজারে যাবেন না। সপ্তাহে বা পনের দিনে একদিন বাজারে যাবার চেষ্টা করবেন এবং বাজারটি করবেন পরিকল্পিতভাবে। বাসায় প্রতিনিয়ত প্রয়োজনীয় বাজারের তালিকা করতে থাকবেন। এভাবে চলতে চলতে তালিকাটি বড় হতে থাকবে এবং একটা সময় আসবে যখন আপনাকে বাজারে যেতেই হবে। তখন আপনি সব তালিকা মিলিয়ে একটি বড় তালিকা তৈরি করে নেবেন এবং আপনার সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বাজারে যাবেন।
দ্বিতীয়ত, আমাদের প্রত্যেকেরই মাস্ক পরিধান করা উচিত। যখনই আপনি ঘরের বাইরে যাবেন অবশ্য অবশ্যই মাস্ক পরিধান করে যাবেন। যদি জ¦র-সর্দি-কাশিসহ যেকোন উপসর্গ দেখা দেয়, তবে ঘরের ভেতরেও আপনি মাস্ক পরিধান করবেন।
তৃতীয়ত, হাত ধোয়ার ব্যাপারটি আপনাকে আয়ত্ত করতেই হবে। যেখানে অন্য কারো স্পর্শ লাগতে পারে, ড্রপলেট লাগতে পারে- এমন জায়গায় যখনি স্পর্শ করবেন, তারপর অবশ্যই হাত ধুবেন। যতক্ষণ আপনি হাত ধুতে পারবেন না, ততক্ষণ সতর্ক থাকতে হবে যেন হাতের স্পর্শ আপনার মুখ, নাক, চোখে বা কানে না লাগে। মোবাইল, দরজার হাতল বা বাজারের ব্যাগ ইত্যাদিতে স্পর্শ করার পর কোনভাবেই হাত না ধুয়ে থাকা যাবে না বা চেহারার কোথাও স্পর্শ করা যাবে না।
চতুর্থত, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে আপনি শতভাগ কঠোর হবেন। আশেপাশের মানুষ যারা নিয়মটি মানবেন না, তাদের বোঝানোর চেষ্টা করবেন। না মানলে প্রয়োজনে রূঢ় আচরণ করবেন। এই সাময়িক রূঢ় আচরণ দেশ, জাতি এবং আপনার-আমার কল্যাণের কারণ হবে।
পঞ্চমত, অপরিচিত সবাইকে করোনা রোগী ভাবতে হবে। এই ভাবনার বিষয়টি এখন জরুরি। বিপরীত মানুষটিকে রোগী ভেবে আপনার প্রয়োজনীয় সতর্কতা মেনে চলবেন।
ষষ্ঠত, বাইরে থেকে এসেই ঘরে ঢোকার ক্ষেত্রে আপনার পোশাক, জুতা ইত্যাদি নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। জুতা ঘরের বাইরে রেখে আসতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তৈরি বিøচিং পাউডারমিশ্রিত পানি বা অন্য কোন জীবাণুনাশক দিয়ে স্প্রে করতে হবে। সম্ভব হলে বাসার বাইরের গোসলখানায় গোসল করে ঘরে ঢুকবেন। যদি সে ব্যবস্থা না থাকে তবে বাসার বাথরুমেই গোসল করবেন এবং আপনার কাপড়গুলো সামান্য গরম পানির সাথে ডিটারজেন্ট মিশিয়ে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রেখে ধুয়ে ফেলবেন। মোবাইল থেকে শুরু করে সবকিছুই জীবাণুমুক্ত করতে হবে। মোবাইল ফোন কানে না লাগিয়ে লাউড স্পিকারে মুখের সামনে ধরে কথা বলা অধিক নিরাপদ।
সেকেন্ডারি কাজগুলোর দিকেও কিন্তু সমান তালে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রাণ বাঁচাতে এটুকু আপনি-আমি এতটুকু করতেই পারি।
খাদ্যাভাসের বিষয়ে খুব বেশি মনোযোগী হবার সময় এসেছে। ফাস্টফুড, সফট ড্রিংকস, মদপান, ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। খাদ্যে প্রোটিন ও ভিটামিন সি-এর মাত্রা বাড়াতে হবে। অধিক পিএইচপি মানসমৃদ্ধ খাবার যেমন- কমলালেবু, মাল্টা, লেবু, রসুন, এগুলো বেশি খেতে হবে। মোটকথা, শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়াতে হবে।
প্রতিদিন কমপক্ষে ২০-৩০ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে। ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়াম করতে পারেন। সুযোগ থাকলে মাস্ক পরে বাইরে হাঁটবেন। তা যদি না পারেন ঘরের ভেতরেই একটু হাত-পা নাড়াচাড়া করবেন, উঠা-বসা করবেন।
শরীরে রোদ লাগানোর চেষ্টা করতে হবে। এটি দেহে ভিটামিন ‘ডি’ তৈরিতে সহযোগিতা করবে। গবেষণা বলছে, বেলা ১০ টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত রোদ অধিক উপকারী।
সকাল-বিকাল গরম পানির ভাপ নেবেন। বাইরে থেকে বাসায় এসে এটা করতে পারেন। অনেকেই ভাবেন, ভাপ নিলে করোনা মারা যায়। এটা ভুল ধারণা। মূলত ভাপের মাধ্যমে আপনার শ^াসনালীটি পরিষ্কার থাকবে।
করোনার যেকোন লক্ষণ দেখা দিলে নিজেকে সাথে সাথে অন্যদের থেকে আলাদা করে নেবেন। যেন আপনার পরিবার, প্রিয়জন বা অন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।