• ঢাকা
  • সোমবার, ১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২রা ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
আমার বাবা – রোকেয়া পারভীন

আমার বাবা – রোকেয়া পারভীন 

অনেকবার ভাবি প্রতিদিনই বাবাকে কতবার মনে করি আবার নতুন করে লিখে কষ্ট বাড়ানোর দরকার কি! কিন্তু অপরাধী লাগে নিজেকে, মনে হয় বাবাকে নিয়ে কত কিছু করার ছিল, খুশী করার কত চেষ্টাই করতে পারতাম এখন, না সে রকম কোন সুযোগই আমার বাবা, মা কেউ দেননি। নিজেরা সবার জন্য সব কিছু করে চলে গেলেন চুপ করে।

ছয় মাস বয়সে তার মাকে হারিয়ে বড় হয়েছেন তার বড় ভাই ভাবীদের আদর স্নেহে। ১২ ভাইবোনের সবার ছোট আমার বাবা, তাইতো সে তার অনেক ভাতিজা, ভাগ্নেদের চেয়ে ছোট, বা সমবয়সী ছিল। কিন্তু সম্পর্কে বড় হবার কারনে সেই কূটি কাকা, আর কূটি মামাই ডাকতেন তারা। চাচী,ফুপুদের কাছে শুনেছি আব্বার বড় হবার গল্প। আব্বাও তার ছেলে বেলার অনেক গল্প বলেছেন আমাদের।
যেহেতু তার মা ছিল না, তাই কিছু হবার আগেই সবাই বলত আহারে ওর মা নাই। কিন্তু ভাতিজাদের সাথে ঝগড়া অনেক সময় নিজে থেকেই লাগাত, ওই যে মা না থাকার সুবিধা, বকা যা তারাই খেত। আব্বা নাকি ক্লাস ফোর থেকে বিড়ি খেত লুকিয়ে, পরে তার বাবার সাথে বায়না ধরলেই বলতেন যা তুই বিড়ি খা গিয়া। বাড়ীতে যেহেতু লুকানোর ব্যাপার ছিল তাই গ্রামে অন্য বাড়ীতে গিয়ে সেটা করত। চাচা ভাতিজার বিড়ির লড়াই। কেউ একজন অর্ধেক বিড়ি খেয়ে মাঝখানে ফেলত, সেটা উদ্ধার করতে সে আর তার ভাতিজা আক্কাস। ঝাপিয়ে পড়তেন, দু’জনের যুদ্ধ শেষে বিড়ির আর কোন অস্তিত্ব থাকত না। এই যুদ্ধ নিয়মিত ছিল।

৮ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন এতিম হবার যন্ত্রনা। বাবার চেয়ে ২ বছরের বড় আমার ফুপু, নিজে এই ভাই এর সব আব্দার রক্ষা আর যত্ন করেছেন। তার ভাইকে যাতে মশা বা ছারপোকায় না কামড়ায় প্রতিদিন রাতে নারকেল তেলের সাথে তারপিন তেল মিশিয়ে গায়ে দিয়ে দিতেন। রাত্রে কাচারী ঘরে গিয়ে দেখে এসে ভাতিজাদের সাবধান করে দিতেন, চাচার গায়ে হাত দিলে বুড়া কালে সবার হাত কাপবো😊
আমার দাদা হাজী কফিলউদ্দীন মোল্যা ২৫ বছর চেয়ারম্যান ছিলেন চরভ্রাসন ইউনিয়ন এ সেই বৃটিশ আমলে। কিন্তু এলাকার সব মানুষের সাথে বাবার ছিল অবাধ চলাফেরা। আর সবাই আদর করতেন এতিম হবার কারনে। চরভদ্রাসন স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হয়ে লজিং থাকতেন কমলাপুরের বিশ্বাস বাড়ীতে। আর আব্বার ভাতিজা নুরুমোল্যা পালদের ভাগ্নে, সে ওই বাড়ীতেই থেকেই পড়াশুনা করতেন। গল্প শুনেছি আমার চাচীরা চাল, আতপ চাল, মুড়ি ভেজে দিতেন সেই লজিং বাড়ীর জন্য। বেশীর ভাগ সময় মাথায় করেই আনতে হতো সেই ১৫ কিলোমিটার পথ। এরকম আরোও অনেক গল্প।
আমরা সব ভাইবোন তো আব্বার ন্যাওটা ছিলামই এমনকি আমাদের এলাকার ছেলেমেয়েরাও । কমলাপুরে আমাদের বাসার আশে পাশে সবাই আমার আব্বার সাগরেদ হয়ে যেত। কেউ আসলে না খেয়ে যেতে দিতেন না। আর ওই কথা আরে মিয়া বসো। গেলেইতো গেলা, এই বুড়া নানা,দাদা চাচারে সময় দাও।
আমাদের বাসার সামনে বারান্দায় আব্বা পেপার নিয়ে বসতেন। আমরা বাসায় থাকলে আব্বার আশে পাশেই সবাই। এর মধ্যে রাস্তা দিয়ে কেউ গেলে ডেকে আনতেন। গল্প আর চা। মা সব সময় ই বলত, পারেও তোর বাপ!
আমরা ভাইবোনেরা সবাই খাটের উপরে বসতাম আব্বার সাথে বিকেলের চা, টিভি দেখা, আর গল্প করতে। আমার মা রাগ হয়ে বলতেন, নবাবজাদা, নবাবজাদীরা নামো একটু। আব্বা খুব খুশী হয়ে বলতেন এই গালিটা আমার খুব পছন্দ তুমি আমার ছেলেমেয়েরে এটাই বলো। আমার আব্বা ভাবতেন মেয়ে বিয়ে হয়েছে তো কি! আমার কাছে থাকবে সবাই।

আমার মামাত,চাচাত বোনেরা আসলেও আব্বা যেতে দিতে চাইতেন না। আর ২টা দিন কাকার কাছে থেকে যাও, যাবার সময় এগিয়ে দিতেন ভাতিজিদের রাস্তা পর্যন্ত।

তারপর ছেলের বউরা যখন আসলো, আমার বাবার আর ভালো লাগেনা, তারা যখন বাবার বাড়ী যায়। আমাদের একই শহরে বাসা সুমী (বড় বউ), গেলেই আব্বা বলতেন সন্ধ্যায় চলে এসো বড় মাছ আনতে যাব বাজারে। ছোট বউ সনিও বাড়ী যেতে চাইলে, সেই কথা, তোমরা বাসায় না থাকলে বাজার করাই বৃথা, আর খালি বাসা আমার ভালো লাগে না। আমার মা হাসতো, কেমন লাগে এখন! ওরাও তাদের শ্বশুরকে সন্মান কর‍তো, ভালোবাসতো, থাকেনি বাবার বাড়ী গিয়ে। আমেরিকায় আসার আগ পর্যন্ত ১৪ বছর সবাই এ ই বাসায় একই সাথে, আমার বোন বিথীসহ। সে এক আনন্দের বাজার।
আমি ২০০৬ সালে কানাডা থেকে ৮ বছর পরে গিয়ে বুঝতে পারলাম কেন আমার বাবা, মা আমেরিকার গ্রীন কার্ডের এতোটুকু লোভ করেন নি। আশে পাশের ছেলে মেয়েরা আসছে, দাদী, দাদার কি লাগে না লাগে দেখছে সারাক্ষন, কি আনতে হবে, কোন গাছের ডাব পাড়তে হবে আরোও কত কি! মোট কথা মানুষ ছাড়া আমার বাবা, মা থাকতে পারতেন না। আমিও এতো খুশী দেখে, কি হবে এই আমেরিকা, কানাডা না আসলে! নাতী, নাত্নী সবাইকে নিয়ে চাঁদের হাট। ফরিদপুর হাই স্কুলের সামনে আব্বার মেডিসিনের দোকান, সেখানে ও গুলজার স্যার, ইমাম মামা আরোও সবাই আসেন গল্প করতে, আব্বা কি করে এখানে আটকা থাকবেন!

দেশের বাইরে ছিলেন ১৪ বছর, প্রতিটি চিঠিতে, মাকে যেন সন্মান করি,ভালোবাসি লেখা থাকত। যে বাবা একটা মুহুর্তও আমাদের ছাড়া থাকতে চাইতেন না সেই বাবা সন্তানদের মানুষ করার জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন জীবনে। মেয়েদের ভালো বাসতেন অনেক, সে যার মেয়েই হোক। পড়াশুনা শিখিয়ে মেয়েদের বিয়ে দিতে হবে সবাইকে বলতেন। আমাদের পাড়ার ফ্যালা ভাই এর মেয়েরা নানার ভক্ত ছিল, চা বানানো, কোন কাপড় ধুতে দিবে, কি লাগবে নানার, সব জানত ওরা। ওদের পড়াশোনার সব দায়িত্ব ছিল আমার বাবা মায়ের। এখনো নানার কথা মনে করে ফোন দেয়। আরোও কত যে গল্প আছে বাবাকে নিয়ে।

তবুও দুঃখ আমার যায় না,যাবেও না যতদিন বেঁচে আছি। সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল অপারেশন এ জীবনের সাথে যুদ্ধ করেছেন আমার বাবা। তার ডাক্তার ছেলে মেয়ে, জামাই, বউ সবাই অসহায় চোখে দেখেছে সেই কষ্ট! পরাজিত হয়ে তাকিয়ে থেকেছে বাবার অসহায় মুখের দিকে। আমার সাথে দেখা হয়নি তার শেষ সময়ে। ২০০৯ সালের জানুয়ারীতে আমি ঊড়ে উড়ে ক্লান্ত হয়ে যখন দেশে গিয়েছি তার ২ দিন আগেই বাবা চলে গিয়েছেন অন্যভূবনে। আমি শুধু জেনেছি বাবার সাথে গিয়েই দেখা হবে, হয়নি আর সেই দেখা।
আমরা জানি, আমার বাবা অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন, আত্মীয় স্বজন মানুষের জন্য তার মন কাঁদত সব সময়। কোন দিন কাউকে কষ্ট দিয়ে কথা বলেছেন কিনা জানি না। আমাদের সেই সুন্দর, কুসংস্কারহীন মনের বাবা যেখানেই থাকো, তোমার সন্তানেরা ভালোবাসে তোমাকে অনেক অনেক। আল্লাহ আমার বাবাকে তুমি জান্নাতুল ফেরদৌসের শীতল ছায়ায় রেখো।

ফেসবুকে লাইক দিন

তারিখ অনুযায়ী খবর

ডিসেম্বর ২০২৪
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
« নভেম্বর    
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১  
দুঃখিত! কপি/পেস্ট করা থেকে বিরত থাকুন।