টানা কয়েকদিন ধরে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আগেই সতর্ক করেছিলেন শীতে করোনার সম্ভাব্য দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে। পুরোদমে শীত আসার আগেই আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। তাপমাত্রা কিছুটা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শনাক্ত রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা, আক্রান্ত রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর হার একটু একটু করে কমে আসছিল। যদিও নমুনা পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণ শনাক্তের হার কখনই ১০ শতাংশের নিচে নামেনি। কিন্তু নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে এসে হঠাৎ করে আবার একদিনে শনাক্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন দ্বিতীয় ঢেউ দেখা যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, রোববার করোনায় আরও ৩৮ জনের মৃত্যু হয়, যা আগের দিনের তুলনায় ১০ জন বেশি। দেশে আরও ২ হাজার ৬০ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। তাতে এ পর্যন্ত দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৪১ জন। আর প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ৬ হাজার ৩৮৮ জনে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে বাসা ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও ২ হাজার ৭৬ জন রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছে গত এক দিনে। তাতে সুস্থ রোগীর মোট সংখ্যা বেড়ে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৪২৮ জন হয়েছে।
দেশে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে সরকার বলে আসছে, করোনাভাইরাসের প্রকোপ শীতে বাড়বে। সেজন্য কয়েকবার প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর সতর্কতা ছাড়াও মহামারি নিয়ন্ত্রণে গঠিত জাতীয় পরামর্শক কমিটি এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারাও কয়েকবারই পরবর্তী ধাপের জন্য প্রস্তুতির কথা বলেছেন। যে কারণে এ সপ্তাহে যখন সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেল, সবাই একে দ্বিতীয় ধাপের সঙ্গে মেলাতে শুরু করেছেন। সংক্রমণ যদি দ্রুত বাড়ে, সেক্ষেত্রে আরেক দফা দেশে লকডাউন হবে কি না জোরেশোরে এ আলোচনাও চলছে জনগণের মধ্যে। তবে লকডাউনে যাওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেছেন, আমাদের অর্থনীতির জন্য লকডাউন কোনো সমাধান নয়। অলরেডি সাত মাসে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছে। সুতরাং লকডাউন হচ্ছে আমাদের একেবারে শেষ অপশন। ধরেন একটা পাড়া লকডাউন করা হলে ৫ হাজার মানুষের কর্ম স্থবির হয়ে গেল, তখন তাদের কর্মভার কীভাবে ম্যানেজ হবে? তিনি বলেন, আমি বলব যে আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো সমাধান হচ্ছে, যাতে আমরা আক্রান্ত না হই, সেটা খেয়াল রাখা।
বাংলাদেশে করোনাভাইসের প্রকোপ বাড়তে শুরু করলে গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। মহামারি করোনার কারণে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি আগামী ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে এবার পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনী পরীক্ষা এবং মাধ্যমিক স্তরের বার্ষিক পরীক্ষা নেয়নি সরকার। আর অষ্টমের সমাপনী এবং এসএসসি ও সমমানের ফলাফলের ভিত্তিতে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হবে। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছিলেন আগামী বছর এসএসসি-সমমান পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতি ও সিলেবাস শেষ করতে মাধ্যমিক পর্যায়ের কিছুসংখ্যক বিদ্যালয়ে শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম শুরু হতে পারে।
করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে নিজেদের সক্ষমতা নির্ণয়ের পাশাপাশি সতর্কতামূলক প্রচার-প্রচারণায় জোর দিচ্ছে সরকার। গণপরিবহন থেকে শুরু করে সর্বত্র যেন মাস্ক ব্যবহার করা হয় সেজন্য সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং অন্য মন্ত্রণালয়গুলো এই প্রচার-প্রচারণায় জোর তাগাদা দিচ্ছে। সচেতনতামূলক প্রচারণা এবং মাস্ক পরতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে।
‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ বাস্তবায়নের জন্য সচিবালয়সহ সরকারি দফতরগুলোতে পোস্টার-ব্যানার সাঁটানো হয়েছে। মাস্ক পরায় উৎসাহিত করছেন কর্মকর্তারা। গণপরিবহনে যাতে সবাই মাস্ক পরে সেজন্য তৎপরতা চলছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমাদের বিআরটিএ থেকে যখন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয় তখন দেখা হয় সবাই মাস্ক পরছে কি না। চালক, হেলপার, যাত্রীরা ঠিকমতো মাস্ক পরেছেন কি না, দেখা যায় কেউ কেউ মাস্ক পকেটে রাখেন। যখন অভিযান চালানো হয় তখন পকেট থেকে বের করে মাস্ক পরেন। এর জন্য সবার সচেতনতা দরকার।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের করোনা পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। টিকা আসার আগ পর্যন্ত নতুন এই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের মূল উপায় হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। মাস্ক পরা, কিছু সময় পরপর সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া, জনসমাগম এড়িয়ে চলা ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা। কিন্তু এই স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলার ক্ষেত্রে ঢিলেঢালা ভাব দেখা যাচ্ছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দেওয়া প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, শীতে সংক্রমণ বাড়বে সেই আশঙ্কা মাথায় রেখে নানা রকম প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এতদিনে আমাদের চিকিৎসকরা জানেন কীভাবে এই রোগের চিকিৎসা করতে হবে। শুরুতে মাত্র কয়েকটি ল্যাবরেটরিতে টেস্ট হতো, সে সংখ্যা এখন অনেক বেশি, ১১৭টি ল্যাবে পরীক্ষা হচ্ছে। মাঝখানে সংক্রমণ কিছুটা কমে আসায় আমরা ভেবেছিলাম আমাদের প্রস্তুতি কিছুটা সঙ্কুচিত করে নিয়ে আসব। এখন আর সেটা করা হচ্ছে না।
তিনি বলেন, রোগীর সংখ্যা বাড়ার আগে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে চায় সরকার, সেজন্য এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে সরকার কঠোর হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে ঢাকা এবং খুলনাসহ কয়েকটি জেলায় মাস্ক ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়ার জন্য কারাদণ্ড ও জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে গত ৮ মার্চ। তা ২৬ অক্টোবর ৪ লাখ পেরিয়ে যায়। এর মধ্যে গত ২ জুলাই ৪ হাজার ১৯ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়, যা এক দিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যু হয়। ৪ নভেম্বর তা ৬ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে ৩০ জুন একদিনেই ৬৪ জনের মৃত্যু হয়, যা এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু।
জনস হপকিন্স বিশ^বিদ্যালয়ের তালিকায় বিশে^ শনাক্তের দিক থেকে ২৪তম স্থানে আছে বাংলাদেশ আর মৃতের সংখ্যায় রয়েছে ৩৩তম অবস্থানে।