শনাক্ত হওয়ার সাড়ে তিনমাস পরেও দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অথচ দেশি-বিদেশি গবেষকেরা পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, এই সময়ের মধ্যে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, কিছুদিন আগে তুলে নিলেও সরকার ভিন্ন আঙ্গিকে লকডাউনের পথে হাঁটছে। তবে কি গবেষকেরা যে আভাস দিয়েছিলেন তা ভুল?
জুন থেকে করোনা সংক্রমণ কমবে, আর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসবে জুলাইয়ে— জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এরকম পূর্বাভাস দিয়েছিলেন।
সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, জুলাইয়ের শুরুতে সবকিছু স্বাভাবিক হবে এরকম একটি সময়চিত্র ঠিক করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জমাও দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা সে সব পূর্বাভাস মানেনি।
ওই সময় বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মে মাসের শেষ নাগাদ কমতে শুরু করবে।
এখন তিনি বলছেন, “আমরা প্রজেকশন বলি বা মডেলিং বলি, সেগুলোতে আমাদের কিছু পূর্বশর্ত বা অ্যাসাম্পশন থাকে। সেক্ষেত্রে সেই পূর্বশর্তগুলো যদি প্রতিপালিত না হয়, তাহলে কিন্তু সেটা ঘটবে না। ”
এ প্রসঙ্গে বলেন, “আমাদের এখানে ভালো কোয়ারেন্টিন হয়নি, আইসোলেশন হয়নি, লকডাউনটাও ভালো হয়নি। ফলে সংক্রমণ কমার যে ধারণা সেটাও বাস্তবে হয়নি। ”
যুক্তরাষ্ট্রে ৭০ দিনে প্রথম এক লাখ রোগী শনাক্ত হওয়ার পর সেটা দ্বিতীয় লাখে পৌঁছেছে মাত্র পাঁচ দিনে। ব্রাজিলেও ৭০ দিনে প্রথম লাখ, দ্বিতীয় লাখ ১১ দিনে।
ভারতে ১১১ দিনে প্রথম লাখ শনাক্ত হওয়ার পর দ্বিতীয় লাখে পৌঁছাতে সময় নেয় মাত্র ১৫ দিন। বাংলাদেশ কোন দিকে যাচ্ছে?
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ রিসার্চ সেন্টারের প্রধান মো. রিদওয়ানুর রহমান মনে করছেন, বাংলাদেশ এখন অনিয়ন্ত্রিত সংক্রমণের দিকে যাচ্ছে। ফলে সংক্রমণের গ্রাফ চট করে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। বলেন, “বাংলাদেশে এখন কিন্তু শুধু সংক্রমণই দেখতে পাচ্ছি, রোগ দেখা যাচ্ছে না। আর যেসব রোগী চিহ্নিত হচ্ছে, তারা প্রত্যেকেই কিন্তু চার-পাঁচজন করে রোগী রেখে হাসপাতালে এসেছে। ”
আরও বলেন, “কন্টাক্ট ট্রেসিং না হওয়ায় এই সংক্রমিত লোকগুলো ঠিকভাবে চিহ্নিত হচ্ছে না। তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে আমরা এখন অনিয়ন্ত্রিত সংক্রমণের মধ্যে আছি। ফলে গ্রাফটা চট করে নামবে না। অনির্দিষ্টকাল ধরে হাই লেভেলে এটা চলতেই থাকবে যদি না ক্রাশ প্রোগ্রাম না নেওয়া হয়। ”
সরকার এখন বিভিন্ন জেলায় রেডজোন ভিত্তিক লকডাউনের পথে হাঁটছে। রাজাবাজার, কক্সবাজার, গাজীপুরের পর আরও ১৫টি জেলায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এসব জেলার নির্দিষ্ট কিছু এলাকা লকডাউনের আওতায় থাকছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বে-নজির আহমেদ মনে করেন, লকডাউন এবং টেস্টসহ অন্যান্য কার্যক্রম ঠিকভাবে চললে ৪২ দিনের মাথায় এর একটা সুস্পষ্ট প্রভাব দেখা যাবে।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে রেডজোন মাত্র দশ শতাংশ এলাকায়। বাকী এলাকাগুলোতে সংক্রমণ মারাত্মক নয়। এখন সেটা সারা বাংলাদেশে এক হাজারটা এলাকা হতে পারে। ”
“এখন এক হাজার জায়গায় আমরা যদি এক হাজারটা টিম একসঙ্গে কাজ করি একনাগাড়ে ১৪ দিন, ২৮ দিন এবং এভাবে ৪২ দিন, তাহলে আমরা কিন্তু অল্প জায়গা হলেও বড় একটা ইম্প্যাক্ট দেখতে পাবো। অর্থাৎ সংক্রমণটা কমে যাবে। ”
বে-নজির আহমেদ অবশ্য যত দ্রুত সম্ভব একসঙ্গে সব এলাকায় এই পদক্ষেপ নিতে বলছেন।
তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রিদওয়ানুর রহমান আবার রেডজোন প্রক্রিয়াতেই গলদ দেখছেন। এবং ছোট ছোট এলাকা ধরে লকডাউন কাঙ্খিত ফল দেবে না বলেই মনে করেন।
তিনি বলেন, “আমরা যে সংখ্যার উপর নির্ভর করে এলাকা নির্ধারণ বা জোনিং করছি, সেটা হচ্ছে হেলথ সিস্টেম ডাটা। এই হেলথ সিস্টেম ডাটা হচ্ছে প্যাসিভ ডাটা। অর্থাৎ মানুষ নিজেই ঠিক করেছে যে আমি টেস্ট করবো। আমাদের হেলথ সিস্টেম নিজে টেস্ট করে দেখতে যায়নি যে, মোহাম্মদপুরে কত পার্সেন্ট সংক্রমণ আছে, মিরপুরে কত আছে। ”
“এটা দেখে যদি জোনিং করা হতো তাহলে সেটা এপ্রোপিয়েট ডাটা ভিত্তিক হতো। এজন্য জোনিংয়ে এখন বড় এলাকা ধরে লকডাউন না করলে খুব একটা ফল আসবে না। ”
এ দিকে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলছেন, সংক্রমণ যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে, জোনভিত্তিক লকডাউনে এর রাশ টেনে ধরা যাবে। বলেন, “আমাদের এখানে যারা টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটিতে আছেন, যারা জনস্বাস্থ্যবিদ তাদের মতামত নিয়েই এটা করা হচ্ছে। তাদের ধারণা এমন যে, এটা (লকডাউন) আমরা যদি ছোট ছোট এলাকা ধরে করি তাহলে সংক্রমণটা কমানো সম্ভব হবে। ”