দুই কিশোরের একটি দেয়াল পত্রিকা ও অন্যান্য-সোহেল মাহাবুবুর
১৯৮৮ সনে আমরা কিশোর ছিলাম। আমি তখন ফরিদপুর হাই স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ি আর রিপন ভাই ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছে। কলেজে ভর্তি শেষ এই রকমই একটি সময়। আমাদের ভিন্ন স্কুল মাঝে একটি দেয়াল। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছে ইতিমধ্যেই। দুজনেরই নিয়মিত শিশু একাডেমী ও ইসলামী ফাউন্ডেশনের প্রায় সকল প্রতিযোগিতায় অংশ নেই ও পুরস্কার পাই। রিপন ভাই খুব অমায়িক মানুষ, তার প্রশ্রয়েই আমার মত উরণচন্ডী একজন মেধাবী ছাত্রের বন্ধু বনে যাই।
এমন একটি সময়ে শিশু একাডেমির মৌসুমী প্রতিযোগিতার ঘোষণা আসে। সেখানে “দেয়াল পত্রিকা লিখন” এর মধ্যে একটি। রিপন ভাই খুবই উৎসাহী সেখানে অংশ নিতে কিন্তু তিনি স্কুল শেষ করে ফেলেছেন আর এটিতে সর্বোচ্চ স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীরা অংশ নিতে পারবে। আমরা পরামর্শ করে ঠিক করলাম যে আমরা কোনো একটি সংগঠনের ব্যানারে প্রতিযোগিতায় অংশ নেব আর প্রতিযোগীর নাম হিসেবে আমার নাম ব্যবহার হবে কিন্তু মূল সকল কাজ রিপন ভাই করবেন। সেই মত নিউ মার্কেটের মদিনা স্টোর থেকে আর্ট পেপার, গাম আঠা, রং পেন্সিল নানা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বাই সাইকেলে সোজা কমলাপুর রিপন ভাইদের বাসায়।
এই বাসার প্রতিটি মানুষ আমাকে ভালোবাসে। আমি এখানে নিজ গৃহের ছায়া পাই। রিপন ভাই এর হাতের লিখা চমৎকার। তিনি একটি দেয়াল পত্রিকার সমস্ত ম্যাটেরিয়াল প্রায় একাই লিখে ফেললেন, আমি মনে হয় দুই একটা ছড়া লিখে দিয়েছিলাম। সব গুলো কনটেন্টে এক এক জন কাল্পনিক লেখকের নাম জুড়ে দেয়া হল। রিপন ভাইয়ের প্রায় একার সাহিত্য প্রতিভার ভাগ পেয়ে গেল ভুতুড়ে লেখকরা। এবার প্রচ্ছদের ছবি আঁকতে হবে। আমরা দুজনে প্রায় সবই পারি শুধু ছবিটা বাদ দিয়ে!
শরণাপন্ন হলাম কমলাপুরের কামরুল ভাইয়ের। কামরুল ভাই পৌরসভায় তখন চাকুরী করেন, কিন্তু তিনি দারুন আকিয়ে। অর্থের বিনিময়ে কর্ম চুক্তিতে তিনি রাজি হলেন। রিপন ভাই এরইমধ্যে সব লিখার কাজ শেষ করে এনেছে। কামরুল ভাইকে আর্ট পেপার হস্তান্তর করা হল। কিন্তু তিনি আজ করি কাল করি বলে প্রচ্ছদের কাজ আর শেষ করেন না। একদিন তাকে চেপে ধরে বাড়িতে গিয়ে প্রচ্ছদ আকিয়ে আনি। অনিন্দ সুন্দর সেই প্রচ্ছদ। দেয়াল পত্রিকার নাম “বর্ষণ” তার মাঝে স্থান পেয়েছে। আমরা দুজনেই খুশি। উপজেলা, জেলা, আঞ্চলিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় আমরা ১ম হই। এবার বিভাগীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় ঢাকা যেতে হবে। আমি ও রিপন ভাই দুজনেই পত্রিকা নিয়ে ঢাকায় হাজির। আমাদের সাথে জিলা স্কুলের বিতর্কের দল যাচ্ছে। ওরাও বিভাগীয় পর্যায়ে লড়বে। সেই দলে আছে, গিয়াসউদ্দিন বুলবুল, সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়া, হাবিবুর রহমান রাজু আর মনিরুল আবেদীন পাপ্পানা। এরা চারজনই তুখোড় বিতার্কিক। ছাত্র হিসেবেও ওরা দারুন প্রতিভাবান ছিল ও পরবর্তী কর্ম জীবনে অত্যন্ত সফল হয়। যাই হউক, এরা আমাদের দুজনেরই স্নেহাস্পদ ছিল। আমরা সবাই ঢাকা শিশু একাডেমির মিলনায়তনের দোতলায় ঢালাই বিছানায় আশ্রয় নিলাম। টয়লেট এর মধ্যেই গোছলের ব্যবস্থা। বমি এসে যায়, তাই কার্জন হলের পুকুরে গোছল। আমাদের খাবার খরচ দেয়া হলো দিন প্রতি ৩০ টাকা। সেই টাকা দিয়ে সকালে পাঁচ, দুপুরে দশ, রাতে দশ পনের টাকা করে খরচ করি। সবাই মিলে এক সাথে ঢাকা মেডিকেলের ক্যান্টিনে খেতে যাই। একদিন আমাদের ঢালাই বিছানা জুতো দিয়ে মাড়িয়ে দিল টাঙ্গাইলের এক ছেলে। সে কোনো দুঃখ প্রকাশ না করায় আমাদের ঝগড়া লেগে গেল। দুঃখ প্রকাশ না করে উল্টো আমাদের মারতে এলো। এক পর্যায়ে পাশে থাকা চেয়ার দিয়ে ঝেড়ে দিলাম বারি। তাতে সে কুপোকাত। তারপর সব শান্ত। দশ বছর পরে টাঙ্গাইল বেড়াতে যাই। আর অদ্ভুত কইনসিডেন্ট হিসেবে ওই ছেলেদের বাড়িতে গিয়ে উঠি। গিয়ে দেখি দেয়ালে ওই ছেলের ছবি টাঙানো। তখন সে বাড়িতে আমার দুপুরের দাওয়াত। আমি খেতে খেতে শৈবালের মা কে সেই মারামারির গল্প বলে ফেলি। তিনি আমাকে তরকারি বেড়ে দিতে দিতে বলেন শত্রুর পাতে ভাত বাড়ছি!
ঢাকা ডিভিশনাল প্রতিযোগিতায় হাসেন খান ও অন্যান্যরা বিচারক হিসেবে এলেন। বিজ্ঞ বিচারকগণ কিশোরগঞ্জ এর দেয়াল পত্রিকাকে বিজয়ী ঘোষণা করলেন। আমরা হলাম দ্বিতীয়। বিভাগীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় হওয়ায় জাতীয় পর্যায়ে সুযোগ পেলাম। জাতীয় পর্যায়ে জিলা স্কুলের দলও উঠেছে। ঢাকার দল ভিকারুননিসা স্কুলের মেয়েদের সঙ্গে ওদের দারুন ভাব হয়েছে। ওদের কাছে গেলে ওরা মেয়েদের নাম ধরে ধরে পরিচয় করিয়ে দেয়। আমরা মেয়েদের “আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া” সম্ভাষণ শুনে চলে আসি। ওদের আড্ডা বিরামহীন। আমরা এক সাথেই আছি। একদিন খেতে যাবো, বুলবুল আমাদের সাথে গেল না। মাঝ পথে গিয়ে শুনি বুলবুলের টাকা ফুরিয়ে গেছে। মনটা খারাপ হল। আমাদের অঘোষিত লিডার রিপন ভাই ফিরে গেলেন। তিনি বুলবুলকে নিয়ে পুনরায় খেতে গেলেন। একটি পরিবারের কর্তার ভূমিকা পালন না করলে ওই ছোট্ট ছেলেটিকে সেদিন অভুক্ত থাকতে হত।
এরই মাঝে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নিতে নানা বিভাগের ছেলেমেয়েরা আসতে শুরু করেছে। খুলনা থেকে বিজয়ী হয়ে এসেছে আমার মামাতো বোন লিবিদের দল। লিবি খুব স্মার্ট মেয়ে। চোখে মুখে কথা বলে। আমাদের পিচ্চিরা মুহূর্তেই ভিকারুননিসা ত্যাগ করে খুলনার দিকে মনোনিবেশ করে ফেলে। ওই বিচ্ছু গুলো আমাদের চেয়ে হাজার গুণ ইচড়ে পাকা। তারা খাতির জমানোর মন্ত্র জানে। মামাতো বোন আমার, আর টাংকি মারে বুলবুল, সাইফুল😢। কি আর করা।
জাতীয় পর্যায়ে আর আমাদের টিকে থাকা হয় না। আমরা শূন্য হাতে ফরিদপুরে ফিরে আসি। কিন্তু এই যাত্রায় অনেকগুলো ঘটনা ঘটে যায়। রিপন ভাই আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ট বন্ধুতে পরিণত হন। বুলবুল সাইফুল দের সাথে দারুন আত্নীক সম্পর্ক সৃষ্টি হয় যা আজও চলমান। আর ফরিদপুর ফিরে আসার পর বরিশাল থেকে শিউলি নামের এক কিশোরীর পত্র মিতালীর আহবান সম্বলিত চিঠি পাই। সেই পত্রমিতালি বহুদিন বলবৎ ছিল। আর পরে জেনেছি যে আমার ঠিকানা শিউলিকে দিয়েছিল এই বুলবুল ও সাইফুল। শিউলিও সেখানে বিতর্ক করতেই গিয়েছিল।