মধুর আলিঙ্গন
(একটি ভ্রমণকাহিনী)
—————————————————-
।।রেজাউল করিম।।
————————————————
আমি কিন্তু রোজই মদ খাই। লম্বা ট্রেন জার্নিতে খেতে আরো ভালো লাগে। ডোন্ট মাইন্ড। ড্যু ইউ টেক ইট ?
গভীর রাতে চলন্ত ট্রেনের ভেতরের আবছা আলোছায়ায় এমন প্রস্তাবে আমি রীতিমতো ভরকে গেলাম।
লম্বাটে সুঠাম দেহের লোকটা বোতল এগিয়ে আনলো আমার সামনে। ছিপি খুলে হা করে গলায় ঢেলে নিলো যেন আগুনে পানি দিয়ে নিভিয়ে নিলো।
হাত বদল করে পাশের বন্ধুটিকে খেতে দিলো সেই অমৃত সুধা। গরগর করে পরিচয় জানালো কী যেন কী এক ডিফেন্সের লোক।
তাদের উল্টো পাশে লোয়ার বাথে আমার পাশে বসা স্ত্রী কেয়া বিপদগ্রস্থ ও অস্বস্তিতার ভ্রুকুটি করলো আমাকে।
এসি ট্রেনে আমরা তখন যেন ঘামছিলাম। ছোট্ট চার বছর বয়সী অসুস্থ মেয়েটি তখন ঘুমিয়ে পরেছে মায়ের কোলে।
মধ্যরাত প্রায় দুটো বাজে।
আমাদের যাত্রা পথের গন্তব্য কাডপাডি স্টেশন। ভেলোর। তামিলনাড়ু প্রদেশের সিএমসি হাসপাতাল।
অচেনা পথ,অচেনা সহযাত্রী, সামনে বসা তাও আবার দুই মদ্যপ। ভয়ে কুচকে আছি। কখন কী করে বসে।খানিকক্ষণ বকবক করে তারা নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুমিয়ে পরলো মিডল বাথে।
কিন্তু আমরা ঘুমাতে পারছি না। মাতাল দুটো আবার জেগে উঠে কী না কী করে।
জানালার কাছে বসা সবুজ পাঞ্জাবি পরিহিত শান্ত স্বভাবের দাড়িওয়ালা মানুষটিকে আমি বললাম এক্সিউজ মি ডিয়ার।
কেরালা ভাষায় কী যেনো তিনি বললেন বুঝলাম না কিছুই। আমি তাঁকে বললাম -ইংলিশ প্লিজ।
তিনি প্রশ্ন করলেন How can I help you? Any problem you feel?
আমি তাঁকে ইংরেজিতে বোঝালাম
আমরা স্বামী- স্ত্রী । এই ছোট বাচ্চা নিয়ে চিকিৎসার জন্য আপনাদের ভারতে এসেছি। CMC হাসপাতালে যাবো। আপনি কি আমাদের সাহায্য করতে পারবেন।
সদাশয় লোকটি সম্মতি জানিয়ে আমাদের অভয় দিলেন “ডোন্ট ওরি, আই উইল হেল্প ইউ।” তারপর তিনি তাঁর হাত ইশারায় তার বক্ষ ও কপালে ক্রুশ চিহ্ন আঁকলেন বুঝলাম তিনি ক্রিশিয়ান ধর্মাম্বলী।
আমি ইশারায় ঐ মাতাল দুজনের ভয়ের আশংকা জানালাম। তিনি বললেন, “ডোন্ট বদার অ্যবাউট দোজ গাইজ। আই এ্যাম বিসাইড ইউ।”
আমাদের আতংক কাটলো। তিনি তাঁর ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েকে বললেন “গো টু আপার বাথ ফর স্লিপিং।”
তখন আমার স্ত্রী কেয়া কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভঙ্গিতে আলতো করে আমার হাত চেপে আর একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
সদাশয় লোকটি লোয়ার বাথের নিজের সিটটি ছেড়ে দিয়ে সিটের পাশের লোহার সিঁড়ি বেয়ে আপার বাথে তিনি তার মেয়ের বিপরীতে গিয়ে শুয়ে পরলেন।
আমাদের জন্য নিজের সিট ছেড়ে দেয়ায় আমাদের ভক্তি আরো বেড়ে গেলো তাঁর প্রতি।
আমরাও শুয়ে পরলাম। মিডল বাথের দুই মাতালের নাক ডাকার শব্দ ট্রেনের ঝি কু কুক শব্দের সাথে মিলিয়ে গেলো সহসাই।
হকারদের বাজখাই আর সুরেলা আওয়াজ “ব্রেড অমলেট,ব্রেড অমলেট, চা , কফি, কফি” শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙ্গলো।
তখন সকাল দশটা। ভারতীয় সময়ে ঘড়ি মিলিয়ে নিলাম। মাতালদ্বয় তখনো নাক ডাকছেন।
পাহাড়, বন, খোলা উদ্যান, বিস্তৃর্ণ মাঠ, সবুজ গাছপালা, মহিষের পাল, ঝলমলে রোদে ট্রেনের জানালার সদ্য ওয়াশ করা কাঁচে আরো ঝলমল করছিলো। মাঝে মাঝে এয়ার ফ্রেশনার ছড়িয়ে দেয়ায় আমাদের কামরাটি তখন ঝরঝরে হয়ে উঠলো।
মেয়ের ঘুম ভাঙ্গলো। নাস্তা খেলাম ব্রেড অমলেট সাথে গরম কফিতে চুমুক। তখন ডিসেম্বরের শীতের সকাল।
ক্রিশ্চিয়ান ভদ্রলোকটি নীচে নামলেন। ফ্রেশ হয়ে তাঁর মেয়েকে নিয়ে বাসা থেকে তৈরি করে আনা রুপালি কাগজ মোড়ানো পরাটা আর চিংড়ি ফ্রাই দিয়ে নাস্তা করলেন।
মিডল বাথে এখন আর সাড়া শব্দ নেই।
আমাদের ডানপাশের সিঙ্গেল সিটের হাফপ্যান্ট পরা সুদর্শন ছেলেটি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে ল্যাপটপে গান বাজিয়ে গেম খেলছিলেন। আমার মেয়েকে মাম্মা বলে কাছে নিয়ে ল্যাপটপের গেমের অংশীদার করলেন তিনি।
ট্রেন চলছে ঝি কু কুক,ঝি কু কুক।
ক্রিশিয়ান লোকটির সাথে এবার পরিচয় পালায় আমি জানালাম “আই এ্যাম রেজাউল করিম, মাই ওয়াইফ ইজ কেয়া এন্ড মাই ড্যায়ারেস্ট বেবি ইজ অতশী।”
তিনি জানালেন যে তিনি একজন “ফাদার”। দুঃখিত তাঁর পুরো নামটা মনে নেই আমার। তবে তিনি গীর্জায় সানডে তে বয়ান করেন তাই তিনি ফাদার।
মজার বিষয় হলো ফাদার আমায় জানালেন আমরা যে CMC হাসপাতালে যাচ্ছি তিনি সেই হাসপাতালের গীর্জারই ফাদার। আমার মনে হচ্ছে দয়াময় আল্লাহ যেন ভিন্ন আঙ্গিকে সাক্ষাত ফেরশতার পাশে আমাকে বসিয়েছেন ।
এরিমধ্যে হুড়মুড় করে মোহভাঙ্গা মাতালদ্বয় হুশ ফিরে পেয়ে নেমে গেলেন কোন স্টেশনে জানিনা। যাবার বেলায় শুধু হেসে বলেছিলেন “উই আর ড্রাঙ্ককার্রড বাট নট ডিস্টার্ব এ্যানিবডি। বাই। ”
আমি তাদের নেমে যাওয়ার সময় দেখলাম মাতাল হলেও ঠিক স্টেশনেই নেমেছে। আমার মেয়েটিকে হাত নাড়িয়ে বললেন “বাই বেবি।”
পরের দিন ভোর সাড়ে চার টার দিকে আমাদের ডিপার্চার। অর্থাৎ ট্রেন থেকে নামতে হবে।
আমি ফাদারকে তা বলে রাখলাম। ফাদার ঘড়িতে টাইম এলার্ম দিয়ে রাখলেন ৪টায়।
উঠেছিলাম শালিমার স্টেশন থেকে ইলেকট্রিক ট্রেন চলেছে দুর্বার গতিতে প্রায় ২৭০০ কিলোমিটার।
দুই রাত একদিন। ফাদার সঙ্গ দিয়েছে। ফাদারের মেয়ে এ্যানি আমার অতসীকে নিয়ে হাতের কড়ায় মিছামিছু দুধ ভাত রেখে
পিসু পিসু খেলছে। সে যে কী আনন্দ ভ্রমনে পথ ফুরিয়ে গেলো আমাদের!
বিদায় বেলায় ফাদার আমাদের মেয়ে অতসীকে কোলে তুলে নিয়ে
কাডপাঢি স্টেশনে নামিয়ে দিয়েছেন।
আর তাঁর বিদায় অশ্রু দিয়ে ট্রেন ছাড়ার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত অপলক দৃ্ষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চোখের কোণা দিয়ে চুইয়ে পরা জল বার বার মুছেছেন ফাদার ।
আমি নির্বাক আর স্তম্ভিত হয়ে হাত নেড়েছি কেরালাগামী ধাবমান ট্রেনের সেই বগিটির দরজায়। যতক্ষণ ফাদারকে দেখা যায়।
যাইহোক, যেকোন বিদায়ই বিষাদময়। ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর ট্রেন ভ্রমনে নেমে যাবো আমরা একেক স্টেশন।
মজার ব্যাপার কী জানেন, ফাদারের সাথে আমার আবার দেখা হলো দুদিন বাদেই।
রবিবার CMC (Christian Medical) হাসপাতালে সাদা জুব্বা মাথায় পাগড়ী, হাতে বাইবেল নিয়ে ঢুকছিলেন এক সফেদ লোক।
প্রথমে আমার মতিভ্রম হলেও আমি আন্দাজ করে চিৎকার করে ডাকি ফা দা র…।
তিনি চিৎকার লক্ষ্য করে সোল্লাসে “কা রি ম, কা রি ম,” বলে দৌড়ে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে চেপে রেখে করেন মধুর আলিঙ্গন।
[চলবে]
✅ ২০১২ সালের ভারতের শালিমার স্টেশন থেকে ছবিটি আমার এন্যালগ ক্যমেরায় তোলা । মেয়ে অতসীর বয়স এখন ১৪ বছর। ১০ বছর পর এ্যালবাম থেকে ছবিটি এনে বলেছে বাবা এই যে ফাদারের ছবি।
😰স্মৃতিকাতরতায় ছবিটি চোখের সামনে অনেক দৃশ্য ভাসিয়ে আনলো। উপস্থাপন করলাম আমার সহৃদয়বান পাঠকের কাছে।
লেখক – সাংবাদিক রেজাউল করিম