‘সাইয়েদা আল-হুরা’ কথাটির অর্থ একজন মহামান্য নারী, যিনি স্বাধীন ও সার্বভৌম এবং যিনি অন্য শাসকের কাছে মাথা নত করেন না। মধ্যযুগে এই উপাধি পেয়েছিলেন ইয়েমেনের এক নারী শাসক। বলছি, রাষ্ট্রনায়ক আরওয়া আল-সালেহির কথা!
মধ্যযুগের ইয়েমেনের এক মুসলিম নারী শাসক। যিনি ইয়েমেন শাসন করেছেন প্রায় ৫০ বছর! তাঁর শাসনকালকে ইয়েমেনের স্বর্ণযুগ বিবেচনা করা হয়।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে ইয়েমেনে মুসলিম নারী শাসকের কথা শুনতে কেমন জানি ঠেকছে, কারণ মূলত দুটো—ইয়েমেনের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা আর একটি মুসলিম রাষ্ট্রে মধ্যযুগে এক নারীর প্রায় ৫০ বছর শাসন বিস্ময় জাগায় বৈকি!
সত্যি কথা বলতে, মরক্কোর নারীবাদী লেখক ফাতেমা মেরনিসির ‘দ্য ফরগটেন কুইন অব ইসলাম’ বইটি পড়ার আগ পর্যন্ত আরওয়া আল-সালেহির কথা জানতাম না। এক কথায় মুসলিম নারী শাসকদের ওপর অনবদ্য একটি বই এটি।
মুসলিম নারী শাসকের নামের তালিকায় আরওয়া আল-সালেহির নামের উল্লেখ তেমন একটা দেখতে পাইনি। ইতিহাসের পাতায় যেন হারিয়ে গেলেন তিনি। ফাতেমা মেরনিসির মতো গুটিকয়েক সচেতন সমাজ গবেষকের বইয়ের পাতায় তাঁর উল্লেখ রয়েছে কেবল।
আরওয়া আল-সালেহির শাসনকাল আর এই বিদুষী নারীর কথা জানার আগে বিশ্বের অন্য মুসলিম নারী শাসক আর ইসলামের প্রাথমিক সময়ের কথা একটু বলতে চাই। মুসলিম নারীদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শক্তি সাহস, ক্ষমতা, শিক্ষা এত কম আলোচিত হয়েছে যে আজকের তরুণ-তরুণীরা হয়তো সেসব জানতেই পারে না। তাদের পূর্বসূরি নারীরা ছিলেন অত্যন্ত উঁচু স্তরের—শুধু ধর্মীয় জীবনেই নয়, সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি ও দেশ শাসনে তাদের ছিল উজ্জ্বল ঈর্ষণীয় ভূমিকা ও স্থান।
ভারতবর্ষে মুসলিম নারী শাসক হিসেবে রাজিয়া সুলতানা আর চাঁদ সুলতানার নাম সমাদৃত। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় হজরত আয়েশা (রা.) ও হজরত ফাতেমা (রা.) যে অদম্য সাহসিকতা নিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার খেদমত করেছেন তা বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছেন একজন নারী হজরত খাদিজা (রা.)। হজরত আয়েশা (রা.) হাদিস বর্ণনা, ইসলামী আইন, ফিকহ, ইতিহাস, কবিতা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন।
যুদ্ধ, সাহিত্যচর্চা, শিক্ষায় মুসলিম নারীরা সমান পারদর্শী ছিলেন। উমাইয়া যুগে নারীরা সামাজিক স্বাধীনতা ভোগ করত। উমাইয়া পরবর্তী আব্বাসীয় যুগে পুরুষের সঙ্গে নারীরাও শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতেন। বিশেষত সংগীত বিদ্যায় তারা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিলেন। এ কথা সবারই জানা হজরত আয়েশা (রা.) ও হজরত উম্মে সালমা (রা.) ওহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ফুফু সুফিয়া বিনতে আবদিল মুত্তালিব (রা.) খায়বর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উম্মে আতিয়া আনসারি (রা.) মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে সাতটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উমাইয়া বিনতে কায়েস কিফারিয়া খায়বর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
ভিন্ন ভাষায়ও সাহিত্যচর্চা অব্যাহত ছিল মুসলিম নারীদের। ফারসি সাহিত্যে মুসলিম নারীদের রয়েছে বিশেষ অবদান। ‘আদিবুল মামালিক’ ফারহানি বিশ শতকের প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ মহিলা কবি। শুধু কাব্য জগতে নয়, নারী স্বাধীনতা ও নারী অধিকার সম্পর্কে তিনি বেশসংখ্যক প্রবন্ধও রচনা করেন। এ জন্য তাঁকে ‘আদিবাতুজ জামান’ (কালের গৌরব) আখ্যায় ভূষিত করা হয়। এগারো শতাব্দীতে মামলুক শাসনামলে তত্কালীন মুসলিম নারীরা দামেস্কে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১২টি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পূর্ণরূপে মুসলিম নারীদের দ্বারা পরিচালিত হতো।
আরওয়া আল-সালেহি প্রায় দীর্ঘ ৫০ বছর ইয়েমেন শাসন করেছেন । সময়কালটা মনে করা হয় ১০৬৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১৩৮ খ্রিস্টাব্দ, তার মৃত্যু অবধি। তিনি সালেহি রাজবংশের শাসকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন এবং শিয়া ইসলামের ইসমাইলি সম্প্রদায়ে সম্মানজনক উপাধি ‘হুজা’য় ভূষিত হওয়া প্রথম নারী। তাকে জনপ্রিয়ভাবে সাইয়েদা আল-ওরাহ ‘দ্য নোবেল লেডি’, আল-মালিকা আল-হুরার ‘দ্য নোবেল কুইন’ এবং শেবার ছোট্ট রানী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
মুসলিম নারী শাসক হিসেবে আরওয়া আল-সালেহি ইতিহাসে এক অনন্য অবস্থান অর্জন করেছেন। যদিও মুসলিম বিশ্বে অনেক নারী শাসক ছিলেন, কিন্তু আরওয়া আল-সালেহি হচ্ছেন সেই বিরল নারীদের একজন, যার নামে ইয়েমেনের মসজিদগুলোতে খুতবা নেয়া হতো।
আরওয়া জন্মগ্রহণ করেন ৪৪০ হিজরিতে বা ১০৪৮ খ্রিস্টাব্দে, হারাজ নামক স্থানে, যা ইয়েমেনের ইসমাইলিদের প্রাণকেন্দ্র ছিল। তিনি ছিলেন ইয়েমেনের তত্কালীন শাসক আলী আল-সালেহির ভাগ্নী। ১৭ বছর বয়সে আরওয়া তার চাচাতো ভাই আহমদ আল-মুকাররম বিন আলীকে বিয়ে করেন। তাঁর সময়ের ইতিহাসবিদরা আরওয়াকে ধর্মপ্রাণ, সাহসী ও স্বতন্ত্র চরিত্রের অধিকারী বলেই ব্যাখ্যা করেন। কবিতা, গল্প ও ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। তাকে অত্যন্ত বুদ্ধিমান হিসেবেও বর্ণনা করেছেন তত্কালীন লেখকরা। তিনি কুরআন ও হাদিসের বিজ্ঞান বিষয়ে অত্যন্ত জ্ঞানবান ছিলেন।
১০৬৭ সালে আলী ইবনে আল-সালেহি মারা যাওয়ার পরে আরওয়ার স্বামী আহমদ ইয়েমেনের শাসক হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় আর প্রত্যক্ষভাবে শাসন করতে পারেননি। তিনি তার সব ক্ষমতা আরওয়ার হাতে দিয়েছিলেন।

আরব বিশ্বে ইয়েমেন ব্যতিক্রমী, এমন নয় যে অনেক নারী সেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন, কিন্তু এই জন্য যে দুজন নারী মালিকা আসমা (আরওয়ার শাশুড়ি) এবং মালিকা আরওয়া উপভোগ করেছেন প্রশ্নাতীতভাবে রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতা এবং মসজিদের খুতবায় তাদের নামে ঘোষণা করা হতো। আর কোনো নারীরা এই সম্মান পাননি ইসলামের আবির্ভাবের পরে। মালিকা আসমা ছিলেন মালিকা আরওয়ার শাশুড়ি। আসমা বিনতে শিহাব আল-সালেহি, যিনি হিজরি ৪৮০ অর্থাৎ ১০৮৭ খ্রিস্টাব্দে মারা যান, শাসন করেছিলেন ইয়েমেন তার স্বামীর সঙ্গে।
এটি প্রায়ই ঘটে যে মহিলারা দায়িত্ব গ্রহণ করেন, যাদের সঙ্গে তারা জীবন ভাগ করে নিয়েছিলেন এবং তাদের থেকে রাজনৈতিক শক্তিও উপভোগ করেন। কিন্তু এটি মুসলিম সাম্রাজ্যের আরব অংশে ব্যতিক্রমী যে মালিকা আসমা ও মালিকা আরওয়ার নামে মসজিদে খুতবা প্রচার করা হতো তাদের শাসনকালে।
প্রশ্ন জাগতেই পারে মনে ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার মানদণ্ড তত্কালীন সময়ে কেমন ছিল? ফাতেমা মেরনিসি তাঁর বইতে দুটি মানদণ্ডের উল্লেখ করেছেন—একটি শুক্রবার মসজিদে খুতবায় শুরু হওয়া রাষ্ট্রপ্রধানের নাম ঘোষণার মাধ্যমে আর অন্যটি রাষ্ট্রপ্রধানের নামে খোদাইকৃত মুদ্রা। মধ্যযুগের মুসলিম নারী শাসক ও রাষ্ট্রপ্রধান আরওয়া আল-সালেহির এই দুটি মানদণ্ডেই উত্তীর্ণ থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
‘দ্য ফরগটেন কুইন অব ইসলাম’-এ ফাতেমা মেরনিসি সুলতানা রাজিয়াসহ আরো ১৫ জন মুসলিম নারী শাসকের কথা উল্লেখ করেছেন তারা হলেন মামলুক নারী শাসক শাজার আল-দুর্র, ইন্দোনেশিয়া, মঙ্গোলীয় ও মালদ্বীপের রানীরা। তবে মুসলিম নারী শাসক হিসেবে তাদের কারো নামই মসজিদে খুতবায় উচ্চারিত হতো না।
ফাতেমা মেরনিসি তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন, পশ্চিমা বিশ্বের কেউই এই নারী শাসকের কথা জানে না, এমনকি মুসলিম বা আরব বিশ্বের কেউ তাকে মনে রাখেনি। তিনি আরো বলেছেন, ‘আমার অনেক ইতিহাসবিদ বন্ধু আছে, আমি তাদের যখন বলেছি আরওয়ার কথা, সবাই আমাকে বলেছে ফাতেমা তুমি মনে হয় ভুল করছ। আরব বিশ্বে এ রকম হওয়ার কথা নয়।’ একজন সমসাময়িক ইয়েমেনি ইতিহাসবিদ, আবদুল্লাহ আল-থাওর স্পষ্টতই এটি নিশ্চিত করেন ইয়েমেনের ইতিহাসে মালিকা আরওয়ার রাজত্বকাল বিশেষ সমৃদ্ধির ও শান্তিপূর্ণ ছিল।
সানাতে (ইয়েমেনের রাজধানী) রানী আরওয়ার নির্মিত বিশাল মসজিদটি প্রসারিত হয়। জিবলাতে (আরওয়ার শাসনকালে রাজধানী জিবলাতে স্থানান্তর করা হয়েছিল) তার নতুন প্রাসাদ ও মসজিদ নির্মিত হয়। রানী আরওয়া মসজিদ—এখন ইয়েমেনের প্রাচীনতম মসজিদ এবং ইউনেস্কোর বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তর্ভুক্ত। তাকে এমন ‘একজন ইয়েমেনি নারী হিসেবে বর্ণনা করা হয়, যিনি তার নীতিগুলো মেনে চলতেন, তাঁর নাগরিকদের ভালোবাসতেন এবং তাদের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন’। রানী আরওয়া স্মৃতিসৌধ, ভবন, রাস্তা, মসজিদ, স্কুল নির্মাণ করে তার দেশকে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ করেছিলেন।
১১৩৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আরওয়া ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি জিবলায় যে মসজিদটি তৈরি করেছিলেন তার পাশে তাকে কবর দেয়া হয়েছিল। তার সমাধিটি পরে তীর্থস্থান হয়ে ওঠে। সানার কুইন আরওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয়েছে তার নামে।
একজন পর্যটক হিসেবে ইয়েমেন ভ্রমণ আমার লিস্টে কোথায় ছিল আমি জানি না। তবে রানী আরওয়া আল-সালেহির কথা এবং বর্তমান ইয়েমেনে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোর কথা জেনে ইয়েমেন ভ্রমণ মাস্ট ভিজিটের তালিকায় যুক্ত করেছি। করোনা-পরবর্তী বিশ্ব এবং ইয়েমেনের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি কবে সেই স্বপ্ন পূরণ করবে, কে জানে! কিন্তু স্বপ্ন বুনতে বাধা কোথায়!
আমার মতো নিশ্চয়ই পাঠককেও আন্দোলিত করেছেন মধ্যযুগের এই নারী শাসক ‘সাইয়েদা আল-হুরা’ খ্যাত ইয়েমেনি রাষ্ট্রপ্রধান আরওয়া আল-সালেহি!
তথ্যসূত্র
Fatema Mernissi, The Forgotten Queen of Islam, ১৯৯৩
Dr Farhad Daftary, Sayyida Hurra: The Isma’ili Sulayhid Queen of Yemen. Women in the Medieval IslamicWorld, ১৯৯৮
এলিজা বিনতে এলাহী: পর্যটক ও শিক্ষক