• ঢাকা
  • রবিবার, ১লা পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
মহামারী কি ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠবে?

ছবি প্রতিকী

১৯১৮ সালের মহামারীর পর বিংশ শতাব্দী দুটি বড় ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর সাক্ষী হয়েছে। একটি ১৯৫৭ সালের এশিয়ান ফ্লু (এইচ২এন২), যা কিনা পৃথিবীব্যাপী প্রায় ১১ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে এবং অন্যটি হলো ১৯৬৮ সালের তথাকথিত হং কং ফ্লু (এইচ৩এন২)। যাতে বিশ্বব্যাপী দশ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল, যাদের বেশির ভাগেরই বয়স ৬৫। পরের ফ্লু এক বছর পর ফিরে এসেছিল মৌসুমি অসুখ হিসেবে। যদিও এর প্রভাব ও প্রাণঘাতী স্বভাব হ্রাস পেয়েছিল।

সেই সময়ের পত্রিকা থেকে অন্তত যে বিষয়টি অনুধাবন করা যায় তা হলো মহামারীর রাজনৈতিক মাত্রা ছিল বেশ অস্পষ্ট কিংবা সংক্ষিপ্ত। এর সঙ্গে আমরা যদি কভিড-১৯-এর তুলনা করি, যেখানে স্পষ্টতই মধ্য জুলাই ২০২০ পর্যন্ত ছয় লাখ মানুষ মারা গেছে বলে দাবি করা হয়েছে, যদিও বেশির ভাগ দেশের প্রকাশিত ডাটার সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। পাশাপাশি এটাও অনেকটা নিশ্চিত যে এ বছরের মহামারীতে মৃতের সংখ্যা ১৯৫৭ ও ১৯৬৮ সালকে ছাড়িয়ে যাবে।

এটাও অনেকটা স্পষ্ট যে এর অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিণতি কিছুটা আলাদা ধরনের। এটাকে বলা যায় যেমনটা ব্রিটিশ রক্ষণশীল দার্শনিক জন গ্রে দাবি করেছেন, ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্টের কম কিছু না।

রাষ্ট্রের আপেক্ষিক নিষ্ক্রিয়তা

একপর্যায়ে এ ধরনের দাবির অন্তর্নিহিত কারণ অনেকটাই স্পষ্ট হয়। ১৯৫৭ ও ১৯৬৮ সালের মহামারীর সময় রাষ্ট্রের বড় ধরনের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়নি। আরো একটি বিষয় স্পষ্ট, যে পরিসংখ্যান সংক্রমিত ও মৃত্যুর সংখ্যার হিসাব রাখে, তা সে দুই মহামারীতে অনেক বেশি আনুমানিক ছিল।

পাশাপাশি এটা অস্পষ্ট যে সে সময় এমন কোনো গুজব ছিল কিনা, যেখানে মহামারীটিকে জৈবিক যুদ্ধের ইচ্ছাকৃত কিংবা অপ্রত্যাশিত কোনো ফলাফল হিসেবে দেখানো হয়েছে। অবশ্য এমন গুজব বিস্তৃত আকারে ছিল বলে দেখা যায়নি। এছাড়া ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে রাষ্ট্র ও জনগণের কেউই বড় আকারের হস্তক্ষেপের আশা করেনি।

প্রাথমিকভাবে এ ষড়যন্ত্রতত্ত্বের অনুপস্থিতির ব্যতিক্রম ঘটে ১৯৯২ সালে, যখন নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে জানায়, ১৯৭৭ সালের তথাকথিত রাশিয়ান ফ্লু সম্পর্কে অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করতেন যে ১৯৫০-এর একটি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস চীনের ল্যাবে সংরক্ষণ করা ছিল, যা কিনা ১৯৭৭ সালে কোনোভাবে পরিবেশে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।

১৯৫৭ ও ১৯৬৮ সালের মহামারীর ক্ষেত্রে জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া কেন আমাদের কাছে অপেক্ষাকৃত কম মনে হচ্ছে, মারাত্মক মৃত্যুহার সত্ত্বেও? এখানে সম্ভাব্য কিছু কারণ ছিল। একটি হচ্ছে দুটি মহামারীর অর্থনৈতিক প্রভাব অপেক্ষাকৃত সীমিত ছিল। যদিও ১৯৫৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপিতে ধস নেমেছিল। এর বিপরীতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক প্রধান রঘুরাম রাজন বলেছেন, এ বছর পাশ্চাত্যের দেশগুলো জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় ২-৩ শতাংশ (ইতিবাচক) থেকে ৪ কিংবা ৫ শতাংশ পর্যন্ত নেতিবাচক হয়ে উঠবে এবং চীনের প্রবৃদ্ধির বর্তমান পরিসংখ্যানও বেশ হতাশাজনক।

সীমিত প্রত্যাশা

আরেকটি কারণ হলো ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশক উভয় সময়েই সরকারের কাছে সীমিত সংস্থান ছিল সামাজিকভাবে হস্তক্ষেপ করার জন্য। যদিও এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সক্ষমতা বেড়েছে হস্তক্ষেপ চলাকালেই। কিন্তু খুব অসমান্তরাল উপায়ে।

এছাড়া অন্য কারণ হচ্ছে মিডিয়ার অবস্থান পরিবর্তন। তারা ১৯৫৭ ও ১৯৬৮ সালের মহামারীর সংবাদ প্রকাশ করেছে কেবল এপিসোডিক্যালি এবং প্রায়ই তা ছিল অস্বচ্ছ এবং টেকনিক্যাল ভাষায়। যা বর্তমান পরিস্থিতির চেয়ে বেশ ভিন্ন। আমরা এখন সারাক্ষণ সংবাদ পাচ্ছি। অনেকগুলো সাইট প্রতিনিয়ত আপডেট দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

অন্য কথায়, মধ্য শতাব্দীর মহামারী সরকারি নিষ্ক্রিয়তা খুব অল্প রাজনৈতিক মূল্যই বহন করত (সম্ভবত একেবারেই না)। কিন্তু ২০২০ সালের পরিস্থিতি ভিন্ন। এই সত্য ছাড়াও আরো সূচক আছে যা প্রমাণ করে কভিড-১৯ তিনটি মহামারীর মাঝে সবচেয়ে মারাত্মক। সামাজিক বিধিনিষেধ মানা না হলে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি হতে পারত।

পরিসংখ্যানের বার্তা

যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো চীন এখন আন্তর্জাতিকভাবে বাজারজাত করছে নিজেদের মহামারী মোকাবেলা করার মডেল। একইভাবে বিভিন্ন সরকারের মাঝে তুলনা করা এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তাদের প্রস্তাবিত সমাধানগুলোকে নাগরিকরা গ্রেড দিচ্ছে।

উদহারণস্বরূপ সবচেয়ে বিশৃঙ্খল ও উদ্ভট অসমন্বিত নীতি দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে, যা সে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার দুর্বল বিজ্ঞাপন হতে পারে।

অন্যদিকে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে বিশ্বব্যাপী ডাটা ও সংবাদ পরিচালিত হয় বিভিন্ন এজেন্সি দ্বারা, যার কিছু আবার সরকারি। এটা আমাদের নিয়ে যায় অনিবার্যভাবে দ্বিতীয় রাজনৈতিক মাত্রার দিকে, যা ষড়যন্ত্রতত্ত্বগুলোর বিস্তৃত প্রচারের শর্ত, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে। যা বিস্তৃতভাবে দুটি ভাগে বিভক্ত।

একটা সময় যার প্রথম ভাগ ইতালিয়ান দার্শনিক গিওর্গিও আগামবেনের মতো প্রভাবশালী দার্শনিকদের দ্বারা স্বীকৃতি পেয়েছিল। তিনি দৃঢ়ভাবে জানিয়েছিলেন, কভিড-১৯ প্রতি বছর যে মৌসুমি ফ্লু হয়েছিল তার চেয়ে বেশি মারাত্মক নয়। যা কোনো মনোযোগ বাদ দিয়ে অনেক জীবন দাবি করে বসে। আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের কিছু অংশে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। যা ছিল কভিড-১৯ ল্যাবে তৈরি এবং এটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

এসব পরিচালিত করেছে তৃতীয় রাজনৈতিক মাত্রার দিকে। যা কভিড-১৯-এর বিস্তৃতির সময় অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ে রক্ষণাত্মক জাতীয়তাবাদে অবদান রেখেছিল। যা আবার সম্পর্কিত ছিল জোনোফোবিয়ার সঙ্গে। এছাড়া ইউরোপিয়ান সংহতিও মহামারীর শুরুর দিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

এছাড়া এই মহামারীর ফলে পেশিবাদী জাতীয়তাবাদ ফিরে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। এমনকি ব্রেক্সিটিয়াররা যুক্তি দেখাতে পারেন যে তারা ঠিক ছিলেন, যদিও ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে অনেক অভিবাসী ডাক্তার ও নার্স রয়েছেন। এমন অবস্থা বিশ্বের আরো অনেক জায়গায় দেখা গেছে।

আমরা ২০২২ সালে কোনো ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড দেখতে পাব না। বরং দুনিয়াটা হবে সীমিতকরণ ও বিস্তৃতির; দেশগুলো পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হবে কিন্তু তাদের মধ্যে থাকবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ২০২০-এর এই মহামারী তাই সম্ভবত কোনো টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠবে না।

লেখক: ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক

স্ক্রলইন থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর

ফেসবুকে লাইক দিন

তারিখ অনুযায়ী খবর

ডিসেম্বর ২০২৪
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
« নভেম্বর    
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১  
দুঃখিত! কপি/পেস্ট করা থেকে বিরত থাকুন।