বাংলাদেশি ডিজিটাল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ই-ভ্যালির কার্যক্রম নিয়ে নানা রকম অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। টাকা নিয়ে সময়মতো চাহিদানুযায়ী পন্য না দেওয়াসহ ই-কমার্স ওয়েবসাইট ই-ভ্যালির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেছেন গ্রাহকরা।
ই-ভ্যালি কিভাবে ব্যবসা করে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিষয়টি খোলাসা করে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আবদুন নূর তুষার ফেইস বুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন।
পাঠকদের জন্য তুষারের পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
‘আসুন ই ভ্যালির বিষয়টা বুঝি।
তাদের নিজেদের কোন পণ্য নাই। তারা ভেন্ডরদের পণ্য বেচে দেয়। কিন্তু ভেন্ডর কে সেটা আপনি জানতে পারবেন না।
আপনার কাছ থেকে টাকা নেয়। বলে যে আপনাকে তার বিনিময়ে ১৫০% ক্যাশ ব্যাক দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়।
তার মানে ১০০ টাকায় একটা পণ্য বেচলো। মনে করেন সেখানে তার লাভ ৩০ টাকা। সে আপনাকে পণ্যটি দিলো আর সাথে ১৫০ টাকার ভাউচার দিলো।
এখন এই ভাউচার দিয়ে আপনাকে তাদের কাছ থেকেই পণ্য কিনতে হবে।
তাহলে সে আপনাকে আসলে টাকা দিলো না।
একটা প্রতিশ্রুতি দিলো। যার নাম ভাউচার।
আপনি এই ভাউচার পরবর্তি পণ্যের দামের সাথে সমন্বয় করতে পারবেন ৬০% হারে। একটা ১৫০ টাকার পন্যে তাকে আপনি তাহলে আরো নগদ ষাট টাকা দেবেন। আর ৯০ টাকা সমন্বয় করবেন ভাউচার থেকে। সেই পণ্যে আপনি আর এরকম বিরাট ক্যাশব্যাক পাবেন না।
তাহলে কি দাড়ালো বিষয়টা?
প্রথম বার সে আপনাকে আসলে টাকা ফেরত দিলো না, দিলো একটা ভাউচার। পরের বারে টাকাটা সমন্বয় করে দিলো যার মধ্যে আপনি আবার তাকে দিলেন নগদ ৬০ টাকা।
আর এই পন্যেও তার ৩০% লাভ ছিলো।
প্রথমে সে লাভ করেছিলো ৩০ টাকা।
হিসাব টা এরকম:
জমা – ১০০
খরচ ৭০
মোট আয় ৩০
দ্বিতীয়বার ১৫০ টাকা
জমা ৬০
পণ্যের আসল দাম ৩০% লাভ বাদ দিলে
১০৫ টাকা।
অর্থাৎ ১০০ +১৫০ = ২৫০ টাকার বাজার মনে করে আপনি তাকে দিলেন ১০০+ ৬০ = ১৬০ টাকা নগদ
সে আপনাকে দিয়েছে ১৭৫ টাকা দামের মাল।
প্রথম বার ৭০ টাকা, দ্বিতীয়বার ১০৫ টাকা।
দেখলে মনে হবে যে তার লস হচ্ছে। আসলে হচ্ছে না কারন সে সব পণ্যে ক্যাশ ব্যাক দেয় না। এই হিসাবটা দেখিয়েই সে সবাইকে বুঝ দেয়।
মনে রাখতে হবে যে সে আপনাকে কখনোই কোন নগদ ফেরত দেয় নাই।
বরং আপনি তাকে নগদ ১৬০ টাকা দিয়েছেন। সে তার খরচকে ১৬০ টাকার নিচে নিতে পারলে অথবা অন্য কোনভাবে ১৫ টাকার বেশী আয় করতে পারলেই কিন্তু ব্যবসায় লাভ।
ভাউচারটাকে রিডিম করতে বলে পুরোটা একসাথে। ফলে আপনাকে আরো বেশী মূল্যের পণ্য অর্ডার দিতে হয়। তখন আপনি তাকে আরো ক্যাশ দেন। কিন্তু বেশী মূল্যের পণ্যগুলিতে সে মার্জিন বাড়িয়ে রাখে তখন আপনার পকেট থেকে পয়সা বের করে নেয়।
যেমন ১৫০ টাকার ভাউচার পুরোটা রিডিম করতে আপনাকে ২৫০ টাকার পণ্য অর্ডার করতে হবে।
এবার অংকটা ১৫০ টাকায় না নিয়ে ১৫০০ টাকায় নিয়ে যান। তাহলে ১৫০০ টাকা রিডিম করতে আপনাতে আরো বাড়তি ১০০০ টাকা দিতে হবে।
তার মানে প্রথম অর্ডারে তাকে দিয়েছিলেন। ১০০০ পরের অর্ডারে দিলেন আরো ১০০০ । তার কাছে টাকা ঢুকতেই থাকে।
একটা ভাউচার দিয়েছিলো যেটা কেবল ইভ্যালির সাথেই ক্যাশ করা যায়। সবাই ভাউচার রিডিম করে না। আর ভাউচার রিডিম সাধারনত বেশী হয় খাবার, প্রসাধনী এমন পণ্যে যার মধ্যে লাভের পরিমান বেশী। সে যেসব পণ্যে ভাউচার রিডিম করা যায় বলে অ্যালাও করে সেসব পণ্য হলো যেখানে ৫০% বা তারও বেশী প্রফিট আছে। যেমন কাচ্চি বিরিয়ানি। তাই তার ভাউচার ফেরার আগেই সে ১ মাস দুমাস ৩০% লাভের টাকা এনজয় করে। তারপর ভাউচার জমা হলে আবার সে নগদ পায় । তখনো আবার একমাস দেড় মাস টাকাটা ব্যবহার করে। অনেক সময় পণ্য সরবরাহ করে না। বলে যে পণ্যটি নেই।
এবার চিন্তা করেন যে যদি পন্যের দামে হেরফের করে রাখা হয়?
যেমন ২ মেগাপিক্সেলের ওয়েবক্যাম ১০০% ক্যাশব্যাক সহ ইভ্যালিতে ৩৩০০ টাকা দাম। বাজারে এই ওয়েবক্যামের খুচরা দাম ১৬০০ টাকা। আমি নিজে অনলাইন থেকে কিনেছি ।
এই পণ্যে ১০০% ক্যাশ ব্যাক। কিন্তু আসলে সে শুরুতেই নিয়ে রেখেছে ১০০% এর বেশী লাভ।
এবার পরের বার যখন সে আরো ৪০% নিচ্ছে। আরো লাভ করছে ও প্রথম বারের লাভ থেকে সামান্য কিছু দরকার হলে ফেরত করছে। সে কেবল সেসব পণ্যতেই বিরাট ক্যাশব্যাক দেয় যেখানে তার লাভ ৬০% বা তার বেশী।
আপনারা তার ওয়েবসাইটে ক্যাশব্যাক এর জায়গায় গেলেই বুঝতে পারবেন।
সে পণ্য সামনে রেখে দেখিয়ে টাকা নিচ্ছে। পণ্য দিচ্ছে দেরীতে। সেই পণ্যের অনেকগুলি লোক ঠকানো।
পণ্যের দাম যতো বেশী , ডেলিভারী করে ততো দেরীতে। আর তখন পণ্য সরররাহের জন্য ১ মাস বা তারও বেশী সময় নেয়। এই সময় এই টাকাটা সে যে কোন ট্রেডিং ব্যবসায় খাটালে, ডলার কেনাবেচা করলে বা বেআইনী পেমেন্টে ব্যবহার করলে কামাতে পারে বহুগুণ বেশী।
চুক্তির মধ্যেও তারা এটা কবুল করিয়ে নেয় যে তারা গ্রাহককে পণ্য সরবরাহ করতে বাধ্য না। প্রয়োজনে টাকা ফেরত দেবে। টাকা ফেরত তো দেয় না। যদি দিতেও হয় তখন কেবল দ্বিতীয়বারের ৪০% ফেরত দিলেই হয়।
এটা হলো ঝিনাইদহের কাজলের মতো পণ্য সামনে রেখে নগদ টাকা সংগ্রহের স্কীম। সে টাকা নিয়ে অন্যকাজে ব্যবহার করছে।
সে গণমাধ্যমে নাটকসহ নানা অনুষ্ঠান স্পন্সর করছে বাকিতে। ফলে তার ইমেজ বেড়ে যাচ্ছে।
গণমাধ্যমে সে প্রতিটি চ্যানেলে যদি ২০ লাখ টাকা বাকি করে , তাহলে সে ৩০ টা চ্যানেলে ৬ কোটি টাকা বাকি করেছে। এভাবে সে বাকিতে বিজ্ঞাপন দেয়ায় সিদ্ধহস্ত হয়েছে।
আর আরেকটা মজার বিষয় দেখবেন। তার নিজের ছবি বা কোন রকম পাবলিসিটি সে করে না। কোম্পানীর সাথে ডিল করে ঠকলে কোম্পানী বুঝবে আর গ্রাহক বুঝবে।
দুনিয়ার সব বিলবোর্ডে ইভ্যালি লিখে রেখেছে কিন্তু দেখবেন সেখানে ওয়েব ইউ আর এল নাই। মামলা হলে সে বলবে আমি তো কাউকে আমার ওয়েবে যেতে বলি নাই। তারা নিজে থেকে গেছেন।
এবার একটা হাইপোথেটিকাল কেস বলি।
ইভ্যালিতে আপনি একই পণ্য যতো খুশী অর্ডার করতে পারবেন। ফলে অনেকেই রিসেল করার জন্য পণ্য কেনে। অর্থাৎ আপনি দশটা মোটরসাইকেল কিনতে চাইলেন। কারন আপনি এগুলো বেচবেন। ইভ্যালি তখন আপনার এই দশটি পণ্যের একসাথে আদেশটিকে ডিলারের মতো ব্যবহার করে উৎপাদনকারীরর কাছ থেকে বেশী কমিশন নেয়। এটা কোন অন্যায় না। তবে এটাকে কিভাবে ব্যবহার করে সেলস এর লোকজন সেটা বোঝার চেষ্টা করেন। ধরা যাক রানার তাদের সেলসকে বললো এমাসে প্রতি বাইকে দশহাজার টাকা ছাড়। দুশ বাইক টার্গেট। তাহলে কমিশন দেয়া হবে সেলসকে আরো ১০%। সেলসের লোকজন নিজেরাই ইভ্যালিতে অর্ডার দিয়ে এটা কিনে ফেলে। কিনে কমিশন নিয়ে নেয়। পরে এই বাইক যখন অন্য সময় সেল অর্ডার আসে ডিসকাউন্ট চলে যাওয়ার পরে তখন সাপ্লাই করে দেয় । বহু রেগুলার ডিলারও তাদের পড়ে থাকা টাকা দিয়ে এই কাজ করে। যাতে বছর শেষে রিসোর্টে গিয়ে সেলস কনফারেন্সে পুরস্কার পাওয়া যায়। কোম্পানীগুলিতে নানারকম অসাধু কাজ করা হয় যা আরেকটি আলোচনার বিষয় হতে পারে।
এটা একটা মাছের তেলে মাছ ভাজার এক নব্য এম এল এম ।
একটা ক্লাসিক ফ্রড স্ক্যাম।
অন্যরাও নানা পদ্ধতিতে মানুষ ঠকাচ্ছে।
দারাজ কে নিয়েও বলেছিলাম। তারা ক্রেতাকে সরাসরি ঠকায় না তবে ক্রেতাকে হয়রানী করে ও নানা ভাবে ভোক্তা অধিকারকে ক্ষুন্ন করে। এটাও প্রতারণা। কাউকে কোন সেবা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে না দেয়াও ক্ষতি ও প্রতারণামূলক কাজ।
লোকঠকানোর এই মহোৎসবের কারনে বাংলাদেশে সঠিক ভাবে ই ব্যবসা দাঁড়াচ্ছে না।
অনলাইনে পণ্য বিক্রিতে ক্রেতা স্বার্থ সংরক্ষণে সরকারের কোন মাথা ব্যাথা না থাকায় এরকম নানা ঠগবাজি আছে।
(ফেইসবুক পোস্টের বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ) সুত্রঃ দেশ রুপান্তর