একটা সময় ছিল যখন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নানা ধরনের কটূক্তি আর উপহাস করে ডাকা হত। সমাজে কথা বলার, সমভাবে সব জায়গায় অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল সীমিত। মানুষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য দান, আর্থিক সহায়তা করত। সে সকল সহায়তা, সহমর্মিতা পাবার আশায় মানুষের দ্বারে দ্বারে প্রতিবন্ধীরা ঘুরত। অবস্থা যে সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে তা নয়, তবে পরিবর্তনের ছোয়া লেগেছে । প্রতিবন্ধী মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদনসহ অন্যান্য মৌলিক ধারণাগুলোর বাস্তবিক রূপায়ন সম্ভব হয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর। ২০১৩ সালে সরকার ২টি যুগান্তকারী আইন প্রণয়ন করেছে; প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩ এবং এনডিডি সুরক্ষা আইন -২০১৩ । সম্প্রতি ২০১৯ সালে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা ২০১৯ প্রণয়ন করেছে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধীতার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের সঠিক পুনর্বাসন সেবা দিয়ে তাদেরকে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য ৬৪ টি জেলা ও ৩৯টি উপজেলায় স্থাপন করা হয়েছে । ২০০৯-২০১০ অর্থ বছরে কর্মসূচির মাধ্যমে শুরু হওয়া এ ধরনের সেবা কেন্দ্র এসডিজির মূল থিম ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’-কেই প্রতিনিধিত্ব করছে । প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি ৩২ টি মোবাইল রিহ্যাবিলিটেশন ভ্যানের মাধ্যমে দূরবর্তী স্থান এবং যে সকল উপজেলায় সেবা কেন্দ্র নাই সে সকল স্থানে সেবা দিয়ে যাচ্ছে ।
৬৪ টি জেলা ও ৩৯টি উপজেলাতে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রগুলো নিম্নলিখিত বিশ্বমানের সেবা বিনামূল্যে দিয়ে আসছে ।
০১. অটিজম, নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত শিশুদের জন্য, অটিজম, নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার কর্নারের মাধ্যমে বিশ্বমানের সেবা প্রদান ।
০২. দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে বিনামূল্যে দৃষ্টি মাত্রা পরীক্ষার ব্যবস্থা । প্রয়োজন মাফিক বিনা মূল্যে সাদা ছড়ি, স্মার্ট সাদা ছড়ি প্রদানের ব্যবস্থা।
০৩. শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য রয়েছে বিনা মূল্যে ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপি প্রভৃতির ব্যবস্থা । প্রয়োজন মাফিক হুইল চেয়ার, কর্নার চেয়ার, ট্রাই সাইকেল, ওয়াকিং ফ্রেম, অ্যালবো ক্র্যাচ, ক্র্যাচ প্রভৃতির ব্যবস্থা ।
০৪. শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে অত্যধুনিক মেশিনের সাহায্যে শ্রবণ মাত্রা পরীক্ষার ব্যবস্থা । রয়েছে বিনামূল্যে অত্যাধুনিক হিয়ারিং এইডের ব্যবস্থা ।
০৫. বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রেখে সে সকল প্রতিষ্ঠানের সেবা প্রতিবন্ধীদের পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা।
০৬. নিয়মিত কাউন্সিলিং, সাইকোথেরাপির ব্যবস্থা। কেন্দ্রে আগত প্রতিবন্ধী শিশুর অভিভাবকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।
০৭. প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে আগত মায়েদের জন্য ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের মাধ্যমে সেবা প্রদান ।
০৮. মোবাইল থেরারি ভ্যানের মাধ্যমে দূরবর্তী গ্রাম, ইউনিয়নে গিয়ে সেবা প্রদান ।
প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের কর্মকর্তা- কর্মচারীদের আচরণ সেবাগ্রহীতাদের মানসিক যন্ত্রণা লাঘবে কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে । প্রত্যেক অভিভাবক তার বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুকে নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে এলে তারা অনেকটাই স্বস্তিবোধ করে। নিজেদের মনোবল দৃঢ় করতে পারে । কিন্তু প্রতিনিয়ত এক অজানা শংকা তাদেরকে গ্রাস করে- আমরা যখন থাকব না, কী হবে আমাদের সন্তানের!
প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের প্রতি প্রতিটি বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর অভিভাবকের প্রত্যাশা অনেক বেশি এবং তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তারা চায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র এমন ভাবে গড়ে উঠুক যেখানে প্রতিটি বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু তার চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন, কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে। এখানে কর্মরত কর্মীদের প্রাতিষ্ঠনিক দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি, প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র পরিচালনার জন্য যুগোপযোগী আইন, নীতিমালা প্রণয়ন করা হলে বিদ্যমান সেবা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে । সেই সঙ্গে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ বিনির্মাণে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে ।
লেখক: প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তা, প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র পীরগঞ্জ, রংপুর