হারুন আনসারী, ফরিদপুর
ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ তথা বিএসএমএমসি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর অত্রাঞ্চলের সাধারণ মানুষের জন্য এখানে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসা সেবা লাভের সুযোগ হয়। বিশেষত মেডিকেল কলেজ থাকায় দেশখ্যাত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণের চিকিৎসা সেবা মিলে এই হাসপাতালে। এভাবে হাসপাতালটি চিকিৎসা সেবায় বিরাট অবদানও রেখে চলেছে। চলমান করোনা সংকটে এই হাসপাতালের পুরাতন ভবনটিকে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল করা হয়। এরপর স্থাপন করা হয় ব্যয়বহুল একটি অক্সিজেন প্লান্ট। চালু করা হয় এই হাসপাতালের ১৬ বেডের সেই আলোচিত আইসিইউ ইউনিট। যেখানে ৩৭ লাখ টাকায় এক সেট পর্দা কেনার খবর সারাদেশে তোলপাড় তুলে। দেশব্যাপী পর্দাকান্ডে সমালোচিত এই হাসপাতাল ঘিরে নানা সমালোচনা ও সংকট রয়েছে। অথচ এখানে মানসম্মত চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠায় সরকার শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে চলেছে। এখানে একটি নিউক্লিয়ার মেডিসিন সেন্টার তথা পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। রয়েছে ২০ বেডের একটি ট্রমা সেন্টার। একটি ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনের কাজও শুরু হয়েছিলো। কিন্তু অব্যবস্থাপনায় হাসপাতালটি সুনাম হারাচ্ছে। একদিকে বহির্বিভাগ ও অন্তঃবিভাগে প্রচুর রোগির চাপ এবং অন্যদিকে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালদের দৌরাত্মে এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগিদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। একটি সংঘবদ্ধ চক্রের খপ্পরে হাসপাতালটিকে ঘিরে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতাল পরিচালনায় কর্তৃপক্ষের রয়েছে দায়সারা উদাসিন ভাব।
পাঁচশো সতের বেডের হাসপাতালটিতে প্রয়োজনের তুলনায় এক তৃতিয়াংশ চিকিৎসকও নেই। নার্স, ওয়ার্ড বয়, ক্লিনার ও আয়াসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য পদও শূন্য। হাসপাতালটিতে মাস্টার রোলের কর্মচারী ও দালালদের দৌরাত্মের শিকার হচ্ছে রোগিরা। এজন্য সামর্থ্যবানেরা ছুটছেন বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। যেখানে এই সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরাই সময় করে রোগি দেখছেন। এনিয়ে ভুক্তভোগিদের মাঝে চরম ক্ষোভ রয়েছে।
আড়াই শ’ বেডের ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চালু হয় ‘৯৪ সালে। ‘১৭ সালে হাসপাতালটি নতুন বর্ধিত ভবনসহ পাঁচশো বেড হাসপাতালে উন্নীত হয়। গত বছর এটিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নামে পরিবর্তন করা হয়।
হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এই হাসপাতালে চিকিৎসকদের মঞ্জুরিকৃত প্রথম শ্রেণির ১৮৪টি পদ রয়েছে যার মধ্যে ১১৯টি পদই শূন্য। ৬৫ জন রয়েছেন যাদের প্রায় সকলেই প্রাইভেটভাবেও রোগি দেখেন। মেডিকেল কলেজের ইন্টার্নি চিকিৎসক এবং নার্সরাই সময়-অসময়ে ভরসা বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
হাসপাতালে নার্স, ওয়ার্ড বয়, আয়া ও ক্লিনারের পদ রয়েছে ৪২৫টি। ২৯টি রয়েছে শূন্য। এসব পদে শূন্যতা এবং কর্মরতরা নিয়মিত বেতন না পাওয়ায় রোগিদের দুর্ভোগ পোহাতে হয় বলে কর্তৃপক্ষ বলছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এই হাসপাতালের অন্তঃবিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগিদের শুরু থেকেই ভোগান্তিতে পড়তে হয়। হাসপাতালটির দুটি ভবনেই রয়েছে জরুরি বিভাগ। এক ভবনের জরুরি বিভাগে গেলে রোগিদের অন্য ভবনে যেতে বলা হয়। জরুরি বিভাগে পাওয়া যায়না কোন সাহায্যকারী। ওয়ার্ড বয় ও আয়ারা বিভিন্ন ওয়ার্ডে ব্যস্ত থাকে। ফলে রোগির স্বজনদের নিজেরই স্ট্রেচার বা হুইল চেয়ার জোগাড় করে রোগিকে ওয়ার্ডে নিতে হয়। টাকা ছাড়া রোগির স্ট্রেচার টানেনা কর্মচারিরা। রোগিকে এক্সরে বা অন্য কোন পরীক্ষানিরীক্ষা বা অন্য কোন কারণে বেড থেকে স্থানান্তর করাতে হয় স্বজনদেরই। যেসব রোগির স্বজন বলতে কেউ থাকেনা তারা বিনা চিকিৎসায় কাতরায়। এসব স্বজনহারা রোগিদের দুর্ভোঘ লাঘবে ফরিদপুরে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে উঠেছে। তবে অসুস্থ রোগিরা তাদের সাথে সবসময় যোগাযোগ করতে পারেনা। অফিস সময়ের পরে হাসপাতালের এক্সরে, সিটি স্ক্যানসহ বিভিন্ন প্যাথলজি বিভাগ বন্ধ থাকায় দুপুরের পরে রোগিদের এসব পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে হয় হাসপাতালের বাইরের প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে। দিনের পর দিন এভাবেই চলছে এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা। হাসপাতালের নতুন ভবনের প্রবেশ মুখে অপরিচ্ছন্ন ও দুর্গন্ধময় পরিবেশ। লিফট বেশিরভাগ বেশিরভাগই বিকল থাকে।
এই হাসপাতালে গত এক বছরে বহির্বিভাগে এক লাখ বাষট্টি হাজারেরও বেশি রোগি এবং অন্তঃ বিভাগে প্রায় ৪৫ হাজার রোগি চিকিৎসা নেয়। এই বিপুল পরিমাণ রোগির অধিকাংশ নিদারুণ অভিজ্ঞতার শিকার হন। একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে হাসপাতালটি ঘিরে। প্রতিষ্ঠার পর হতে এখানে অনেকে বছরের পর বছর একই কর্মস্থলে চাকরি করছেন। তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে অনৈতিকতা ও দুর্নীতির অভিযোগ। পর্দাকান্ডের ঘটনায় অনেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন।
দেখা গেছে, হাসপাতালটিকে ঘিরে এক ধরনের নেতিবাচক মানসিকতা তৈরি করা হয় চিকিৎসা নিতে আসা রোগিদের মনে। হাসপাতালে ডাক্তার ভালভাবে রোগি দেখবে না কিংবা সুস্থ হতে অনেক দেরি হবে এমন সব কথা ছড়িয়ে এক শ্রেণির দালাল প্রতিনিয়ত রোগিদের ভাগিয়ে নেয় প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এখানের টয়লেটগুলোর পরিবেশ নোংরা হতে থাকে। নয়নাভিরাম ১১ তলা নতুন ভবন চালুর পরপরই টয়লেটের প্রবেশমুখে বিভিন্ন ওয়ার্ডের বর্জ্র স্তুপ করে রাখা শুরু হয়। এখন এসব আবর্জনার স্তুপ ঠেলে বাথরুম ও টয়লেটে প্রবেশ করাই কষ্টকর। ফলে সেগুলো অকেজো। চরম নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সেখানে। বিভিন্ন ওয়ার্ডে টয়লেটের কোনটিতে নেই দরজা, কোনটি পানি জমে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অনেকগুলো পরিত্যাক্ত হয়ে গেছে। রোগি ও স্বজনদের অভিযোগ, এসব পরিস্কারের কথা বললে তাদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করা হয়। সমস্যা তৈরি করা হয়।
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. আসাদুল্লাহ বলেন, এই হাসপাতালের ৭০ জন ক্লিনার গত সাতমাস বেতন পায় না। একারণে তাদের এসব কাজের ব্যাপারে আমরা বাধ্য করতে পারিনা। কি কারণে তারা বেতন পাচ্ছেন না তা জানা যায়নি। হাসপাতালটিতে রোগিদের খাবার, মনিহারি ও কাপড় ধোলাইয়ের টেন্ডার হয়না। গত নভেম্বরের এব্যাপারে জানতে গেলে পরিচালক বলেছিলেন, নভেম্বরের মধ্যেই টেন্ডার করা হবে। তারা চিঠি দিয়েছেন। তবে তারপর দুই মাস চলে গেলেও এসব টেন্ডার হয়নি। হাসপাতালে কোটি কোটি টাকায় কেনা মূল্যবান চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম পড়ে অকেজো। পরিচালক বলছেন, মামলা থাকায় এ মেরামত করতে পারছেন না। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, হাসপাতালটিতে মেডিসিন, রেসপিরেটরি মেডিসিন, সাইকিয়াট্রি, গ্যাস্ট্রোএন্ট্রারোলজি, ডার্মাটোলজি, নিউরোলজি, কার্ডিওলজি, সিসিইউ, ইএনটি, চক্ষু, শিশু, গাইনি এন্ড অবস, ক্যাজুয়ালিটি, অর্থো-সার্জারি, শিশু সার্জারি ইউরোলজি, নিউরোসার্জারী, বার্ন এন্ড প্লাস্টিকসার্জারি এবং নেফ্রোলজি ওয়ার্ডের পাঁচশো বেড রয়েছে। তবে এসব ওয়ার্ডের অধিকাংশেরই চিকিৎসক নেই।
অন্যদিকে, শহরের আনাচে কানাচে বেপরোয়াভাবে গজিয়ে ওঠা প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টারের সামনে বিএসএমএমসব হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদপদবী ব্যবহার করে বড় বড় সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা যায়। এসব প্রাইভেট মেডিকেল সেন্টারে রোগি ধরার বড় ফাঁদ এসব সাইনবোর্ডই। আবার অনেক রোগি অভিযোগ করেন, সরকারি হাসপাতালে রোগিকে সেভাবে সময় দিতে পারবেন না বলে অনেক চিকিৎসকই রোগিদের প্রাইভেট সেক্টরের হাসপাতালে যেতে পরামর্শ দেন। এমাসে একজন অ্যাপেন্টিসাইড রোগিকে ভাগিয় নিয়ে তার পায়খানার নালি কেটে ফেলা হয়। অথচ মেডিকেল হাসপাতালটিতে রোগিদের সুবিধার্থে এক্সরে, আল্ট্রাসনোগ্রাম, সিটি স্ক্যান, এম আর আই, ইসিজি,প্যাথলজি, বায়োক্যামেস্ট্রি, ইউরিন এমসিআই, ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিণিং, মেজর সার্জারি মাইনর সার্জারি পরীক্ষার সুবিধা রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অজুহাতে এসব পরীক্ষার সুবিধা রোগিরা পায়না। এতে প্রাইভেট বাণিজ্য দিনে দিনে ফুলেফেঁপে উঠেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. সাইফুর রহমান বলেন, এই হাসপাতালে শুধু ফরিদপুরই নয়, অত্রাঞ্চলের রোগিরা চিকিৎসা নিতে আসেন। যেকারণে রোগিদের প্রচন্ড ভিড় রয়েছে। সেই অনুপাতে আমাদের জনবল নেই। এ সমস্যা নিরসনের জন্য বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি। পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় চিকিৎসা ব্যহত হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কেউ গেলে আমরা তাদের বাধা দিতে পারিনা। এছাড়া চিকিৎসকেরা এখানে সময় দেয়ার পরেই সেখানে প্রাইভেট রোগি দেখেন। তারা সেখানে রোগি দেখতে পারবেন না এমন কোন বিধান নেই।
পরিচালকের বক্তব্য বিধিবহির্ভূত নয় তবে ফরিদপুরে চিকিৎসা সেবা নিয়ে প্রকাশ হয়ে পড়া একের পর এক কান্ডে সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে অবস্থিত একটি প্রাইভেট হাসপাতালে এক নবজাতকের ভূমিষ্টের সময় তার কপাল কেটে ফেলা হয়। এর মাত্র কদিন পর আরেক নবজাতকের হাতের হাড় ভেঙে ফেলা হয়। তার আগে এই হাসপাতালে দেড় বছর আগে অপারেশন করা এক গৃহবধুর পেট থেকে অপারেশনের গজ আটকে রাখার কাঁচি পাওয়া যায়। এসব ঘটনার শিকার রোগিদের জীবন এখন বিপন্ন। এ অবস্থায় সরকার হাসপাতালে রোগিদের সুবিধার্থে নানামুখী উদ্যোগ নিলেও জনমনে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
ফরিদপুরের বিএসএমএমসি হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসকের সাথে আলাপকালে তারা নিষাধাজ্ঞা ধাকায় সরাসরি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তারা সকলেই জানিয়েছেন, সরকার জনগণের চিকিৎসার স্বার্থে এখানে যেসকল সুযোগসুবিধা স্থাপন করেছেন তা অত্রাঞ্চলের অন্য কোন হাসপাতালে নেই। এখানে পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্র ১৯৯৭ সালে চালু হওয়ার পর থেকে গত বছর পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ টাকার বেশি রাজস্ব পেয়েছে সরকার। অন্যান্য বিভাগ ও ওয়ার্ডগুলোতেও মূল্যবান যন্ত্রাংশ রয়েছে। তবে এসব ব্যবস্থাপনায় রয়েছে চরম গাফিলতি। একটি চক্র এসবই অকেজো করে অবৈধভাবে মুনাফা লাভ করতে মুখিয়ে থাকে।