কর্মস্থলে একা ঈদ করাটা চিকিৎসকদের জন্য নতুন কোন অভিজ্ঞতা না। চিকিৎসক ছাড়াও এমন অনেক পেশাজীবী রয়েছেন রয়েছেন যাদের উৎসবের সময়গুলোতের কর্মস্থলে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে প্রতিবছর ঈদের নতুন পাঞ্জাবি পরেই যে যার কর্মস্থলে উপস্থিত হতেন। সহকর্মীদের সঙ্গে কোলাকুলি-কুশল বিনিময় সেড়ে ঢিলেঢালাভাবে চলতো কাজকর্ম। এবছর প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন, ভয়াবহ ছোঁয়াচে ভাইরাস করোনার সংক্রমণ জনমনে বাড়িয়েছে আতঙ্ক। এমন আতঙ্ক-উদ্বেগে নেই উৎসবের উচ্ছ্বাস।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. আতিকুল হক। এই মহামারীতে তিনি ঢামেকের করোনা ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি তার ঈদ উদযাপনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলাম তখন বেশ কয়েকটি ঈদ পরিবার ছাড়া একাই হাসপাতালে কাটিয়েছি। পরিবার ছাড়া ঈদ করার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু এবারের ঈদ অন্যরকম। অন্যান্যবছর একা থাকলেও ঈদের আমেজ ছিল। অন্তত আশেপাশের মানুষের মাঝে ঈদের আমেজ বেশ ভালোই টের পাওয়া যেতো। এবার সব কেমন থমথমে।’
আতিকুল হক বলেন, ‘কিছু মানুষ এর মধ্যেও হয়তো ঈদের কেনাকাটা করতে পেরেছেন। কিন্তু আমার ধারণা তারাও ঠিক উদযাপনের আমেজটা পাচ্ছেন না। মহামারীর সময়ে এটাই হওয়ার কথা। ঈদ যেমন তেমন হোক, খুব করে চাইছি ঈদের পর সংক্রমণ প্রকট হওয়ার যে আশঙ্কা আমরা করছি তা যেন কমের উপর দিয়ে যায়।’ তিনি সবার জন্য নিরাপদ ঈদ উদযাপনের শুভকামনা জানান।
সারাদেশের হাসপাতালগুলোতেই করোনাওয়ার্ডে চিকিৎসকদের ঈদ এবছর নিরানন্দের। স্বাস্থ্যকর্মীরা আজ ঈদের দিনেও পিপিই পরে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে এর মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যে যার মতো শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। গতকাল রোববার চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ড থেকে কয়েকজন চিকিৎসক বোর্ডে লিখে ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। এমন একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। করোনা ওয়ার্ড সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন কঠিন বাস্তবতায় রোগীরা সুস্থ হলেই চিকিৎসকদের ঈদ। আর এই যুদ্ধকালে উৎসব করে ঈদ উদযাপন করার সুযোগতো নেই। তবে যে যার মতো সুযোগ বুঝে ফোনে বা ভিডিও কলে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন।
হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্যান্য বারের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ঈদের ছুটির সময়গুলোতে বেশির ভাগ হাসপাতালেই রোগীদের ভিড় তেমন থাকে না। ঈদের ছুটি শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহর ফাঁকা হতে শুরু করে, সেই সঙ্গে রাজধানীর হাসপাতালগুলোর চিরচেনা দৃশ্যও বদলে যায়। সেসময় হাসপাতালের বেডগুলো বেশিরভাগই শূন্য হতে থাকে। অনেক রোগীই ঈদ উদযাপনের জন্য আগে ভাগেই হাসপাতাল ছেড়ে যান। সে কারণে ঈদের সময় সরকারি ছুটির দিনগুলোতে রোগী না থাকায় চিকিৎসকদের ব্যস্ততাও থাকে না সেভাবে। অবশ্য এই ছুটির দিনগুলোতেও জরুরি বিভাগের চিকিৎসা প্রায় সব হাসপাতালেই চালু থাকে।
তবে এবারের পরিস্থিতি আগের কোনবারের সঙ্গেই মিল নেই। নভেল করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই সারা পৃথিবীই নতুন এক বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। দেশে এই ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার শুরু হওয়ার পর থেকেই চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর ছুটি বাতিল করেছে সরকার। শুধু তাই নয় হাসপাতালগুলোতে জনবল বাড়াতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দুই হাজার চিকিৎসক ও পাঁচ হাজার নার্স। তবে এ বছর ঈদের দিনে ছুটি মেলেনি দায়িত্বে থাকা চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট কোন পেশাজীবীদের। সবাইকে তাদের ‘রোস্টার’ অনুযায়ী হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করতে হবে, চালু রাখতে হবে রোগীদের সেবাদান।আর কভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে দায়িত্বপালনরতদের সুযোগ নেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের। হাসপাতালের দায়িত্ব শেষে তাদের কোয়ারেন্টিইন পালনের জন্য থাকতে হবে হাসপাতালে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আগেই বলে রেখেছে, চিকিৎসা সেবার কোন রকম ব্যত্যয় হলে আর তার অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন তারা। গত ২৬ মার্চ থেকে চলছে সরকারি ছুটি চলছে। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ও চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য বিভাগসহ সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে ঈদ উপলক্ষে সরকারের অন্যান্য দফতরের ছুটি মিললেও স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো ছুটি নেই।স্বাস্থ্য বিভাগের আওতায় ৪২টি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ৬৪টি জেলা সদর হাসপাতাল, ৩৯২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বিশেষায়িত হাসপাতাল, ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র সব চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। খোলা রয়েছে বেসরকারি সব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানও। চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরাও মেনে নিয়েছেন এই বাস্তবতা। এই মহামারী সামাল দিতে তারা ছুটি নেওয়ার কথা মনেও আনেননি বলে কয়েকজন চিকিৎসক জানান বণিক বার্তাকে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান জানান, চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ স্বাস্থ্য বিভাগের সবার ছুটি গত ২৬ মার্চ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাতিল করা হয়েছে। কোন হাসপাতালই রোগী ফিরিয়ে দিতে পারবে না। ২৪ ঘন্টা স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা চালু থাকতে হবে।