বিজয় পোদ্দার, ফরিদপুর: ফরিদপুরে এ বছর মৌসুমী ফল লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রত্যাশার চেয়ে অধিক লিচু ফলনে চাষীদের মুখে হাসি ফুটেছে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারনে সীমিত সময় বেঁধে দেওয়া বাজারের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে চাষীরা। ফরিদপুরের বিভিন্ন হাট-বাজারে ফরিদপুর জেলার ৩টি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের সুস্বাধু লিচু এখন ছয়লাভ। ভোর ৬টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত বিভিন্ন থানার বাজারে লিচুর হাট বসে। সেখান থেকে ফল ব্যবসায়ীরা প্রকারভেদে লিচু ক্রয় করে তা আবার বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করছে।
ফরিদপুর সদরের ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের শিবরামপুর লক্ষ্মী দেশের হাট, মধুখালী উপজেলার গোপালদী, বোয়ালমারী উপজেলার জাহাপুর এলাকায় এ বছর লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। ফরিদপুরের বাজার দখল করে থাকা রাজশাহী ঈশ্বরদীর লিচুর স্থানে স্থানীয় লিচু সাধারণ ক্রেতাদের মন জয় করেছে। লিচুও সুস্বাধু ও স্বাস্থ্য সম্মত হওয়ার কারণে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। বিভিন্ন থানা থেকে ফরিদপুর শহরের হাজী শরীয়তুল্লাহ বাজারে ভোর ৬টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত লিচুর হাট বসে। এক হাজার টাকা থেকে এক হাজার ছয়শত টাকা পর্যন্ত লিচুর মূল্য নির্ধারিত হয়। শত আকারে প্রতি একশত লিচু ১৪০/- থেকে ১৬০/- টাকায় বিক্রয় হচ্ছে পাইকারী। কিন্তু লিচু চাষীরা সমস্ত লিচু সীমিত সময়ের বাজারে বিক্রয় করতে পারছে না। করোনার কারনে সাধারণ ক্রেতারা খুব একটা বাজারে আসছে না। অন্যদিকে প্রতিদিনের বাজারে আনা অর্ধেক লিচু পরের দিন বাজার সময়ে সঠিক মূল্য পাচ্ছে না। এর পেছনে কারণ হিসেবে রয়েছে একদিন পরের লিচু রঙ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ক্রেতারা আকর্ষণ হারায়। ফরিদপুর সদরের ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামের লিচু চাষী দেবেষ ঘোষ বলেন, এ বছর ব্যাপক ফলন হয়েছে আমাদের ইউনিয়নে প্রায় ৩০ হাজারেরও অধিক লিচু গাছ রয়েছে। প্রকারভেদে লিচুর মূল্য ভালই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সরকারের বেঁধে দেওয়া সীমিত সময়ের বাজারে আমরা সঠিকভাবে উৎপাদিত লিচু বিক্রয় করতে পারছি না। এতে বেশীর ভাগ চাষী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। লিচু চাষে কী ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করে ঈশ্বরদীর মতো লিচু ফলালেন এই প্রশ্নে তিনি বলেন দীর্ঘদিন যাবৎ ফরিদপুরে লিচু ফলন হয়। কিন্তু গত ১ যুগ ধরে আমরা চেষ্টা করে আসছিলাম স্থানীয়ভাবে ঈশ্বরদীর লিচু ফলাতে পারি কিনা? কৃষি নিয়ম পদ্ধতি মেনে বছরে ২ বার গাছে ঔষধ ও সার প্রয়োগের মাধ্যমে পরিচর্যার পাশাপাশি পরিশ্রম করে আমরা এই পর্যায়ে এসেছি। কোন কৃষি ঋণ বা সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, না আমরা কোন কৃষি ঋণ বা সহযোগিতা পাইনি।
এ বিষয়ে ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী জানান, ফরিদপুরে লিচু চাষ বেড়েছে। কিছু কমার্শিয়াল চাষীও বেড়েছে। জেলায় এ বছর ২১০ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়েছে। ফরিদপুর সদর, বোয়ালমারী ও মধুখালী উপজেলার জাহাপুরে সবচেয়ে বেশী লিচু চাষ হয়েছে। ১৬২৮ মেঃটন লিচু ফলন হওয়ার কথা রয়েছে এ বছর। রাজশাহীর ঈশ্বরদীতে মোজাফফরি বা ঈশ্বরদীর লিচু চাষ হয়। এই প্রজাতির লিচুই ফরিদপুরে চাষ হচ্ছে। কোন চাষীকে কৃষি দেওয়া হয়েছে কিনা? প্রশ্নে তিনি বলেন লিচু চাষে কোন ঋণ দেওয়া হয়নি। তবে করোনা ভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্থ চাষীদের ৪% সুদে ঋণ দেবার বিষয়ে সরকার সার্কুলেশন ঘোষণা করেছে। বিশেষ নির্দেশনাও রয়েছে সরকারের দেশের কৃষি উদ্যোক্তাদের রক্ষায়। সীমিত সময়ের বাজার-কে বাড়ানো যায় কিনা? এ বিষয়ে তিনি বলেন দেখুন দেশে করোনা পরিস্থিতি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই সময় না বাড়িয়ে সীমিত আকারেই রাখা ভালো। তবে কৃষি পণ্য বাজারজাত করণের প্রশ্নের বিষয়টি ভাবা যেতে পারে।
লিচু বাজারজাতকরণ ও পাইকারী ব্যবসায়ী হাজী শরীয়তুল্লাহ বাজার মেসার্স নূর ফল ভান্ডারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যতীশ সরকার জানান, ফরিদপুরে এখন ভালো মানের লিচু ফলন হচ্ছে। ফরমালিন মুক্ত স্বাস্থ্য সম্মত এসব লিচু চাষীরা সরাসরি আমাদের বাজারে নিয়ে আসছে। আমরা তাদের কাছ থেকে পাইকারী ভাবে ক্রয় করে তা আবার ক্ষুদ্র ফল বিক্রেতাদের মাধ্যমে বিভিন্ন হাট-বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছি। কিন্তু আমাদের ক্রেতা সাধারণ কম তাছাড়া বিকেল ৪টা পর্যন্ত বাজার ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ ফল বিক্রয় করা সম্ভব হয়না। পরের দিনের মুজুদকৃত ফল ভালো দাম পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে আমাদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। শহরের ফল ব্যবসায়ী মোঃ সাইদুর রহমান বলেন, কেমিক্যাল মুক্ত ফলের নিশ্চয়তা নিয়ে আমরা ব্যবসা করছি। সরাসরি লিচু চাষীরা গাছ থেকে লিচু সংগ্রহ করে বাজারে নিয়ে আসছে। এই লিচু বিক্রয়ের মাধ্যমে ফরিদপুরের হাজারও ক্ষুদ্র ফল বিক্রেতা জীবিকা নির্বাহ করছে। আমাদের দাবী সীমিত সময়ের বাজার ব্যবস্থাকে বৃহত্তর স্বার্থে বাড়ানো যায় কিনা? অন্যদিকে ফরিদপুরের বৃহত্তম কাঁচা বাজার হাজী শরীয়তুল্লাহ বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নূর ইসলাম মোল্যা বলেন, করোনা ভাইরাসে ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দা অবস্থায় রয়েছে। আমরা প্রতিদিন সরকারের স্বাস্থ্য বিধি মেনে বিশেষ স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে ফরিদপুরের এই খাদ্য সরবরাহের বাজারকে সক্রিয় রেখেছি। কেননা মানুষের বেঁচে থাকারও প্রয়োজন আছে আবার সতর্কও থাকতে হবে। সময় বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন এটা উর্ধ্বতন নীতি-নির্ধারকদের বিষয়। তবে কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রে একটু সময় বাড়লে মৌসুমী ফলের চাষীদের জন্যও ভালো, ব্যবসায়ীদের জন্যও ভাল।