রাজশাহীর বাঘায় ৫শ বছরের ঐতিহাসিক ঈদ মেলা। ২০ রমযানের পর থেকে শুরু হয় এ মেলার আয়োজন এবং ঈদের পরেও প্রায় মাস ব্যাপী চলে এ মেলা। বাঘাবাসী নয়, উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষের বাড়তি বিনোদনের স্থান এ মেলাটি । এছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকেও হাজারও মানুষ আসেন এ মেলায়।
জানা যায়, রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী বাঘা উপজেলা পুরাকৃতী সমৃদ্ধ উপজেলা হিসেবে প্রসিদ্ধ। প্রায় ৫শ বছর যাবত চলে আসছে এ মেলা। ঈদের ১০ দিন আগ থেকেই শুরু হয় মেলায় আয়োজন। প্রতি বছর মাজার পরিচালনা কমিটি এ মেলার ইজারা দেন। মাস ব্যাপী চলে এই মেলা। কোনো কোনো বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে এ মেলার স্থায়িত্ব আরো বেড়ে যায়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, আব্বাসীয় বংশোদ্ভূত হযরত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহদৌলা (রহ.) ও তার ছেলে হযরত আবদুল হামিদ দানিসমন্দ (রহ.) এর ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন বাঘায়। আধ্যাত্মিক এ দরবেশের ওফাত দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ঈদ-উল-ফিতরে শাওয়াল মাসের ৩ তারিখে ধর্মীয় ওরস মোবারক উৎসবকে কেন্দ্র করে বাঘা ওয়াকফ এস্টেটের উদ্যোগে বিশাল এলাকা জুড়ে আয়োজন করা হয় এ মেলার।
বিভাগীয় শহর রাজশাহী থেকে ৫০ কিলোমিটার পূর্ব সীমান্তের মানুষগুলোর আনন্দ এ ঈদ মেলাকে ঘিরে। এ এলাকার মানুষের আবেগ, পুরনো স্মৃতির পটভূমিতে নতুন করে আঁচর কাটে ঈদ মেলা। বছর ঘুরে তাই এই দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকে সবাই। যাদের স্বজনরা সীমান্তের ওপারে থাকেন, তারা বছরের নির্দিষ্ট এ সময়টা বেছে নেন একে অপরের সঙ্গে দেখা করার। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাদের বসবাস ছুটে আসেন তারাও।
পাঁচশ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ মেলায় লাখো মানুষের সম্মিলন ঘটে। গ্রামের মেঠো পথ ছুঁয়ে ধনী-গরিবের মিলনমেলায় পরিণত হয় এই মেলাকে ঘিরে। দূরের জেলা থেকেও মেলায় আসেন বহু মানুষ। শুরু থেকেই ঈদ মেলায় নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন ব্যবসায়ীরা। এখানে স্টলের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। বেচাকেনা শুরু হয় ঈদের ১০ দিন পূর্ব থেকে। তবে সরগম হয়ে উঠে ঈদের দিন থেকে এক টানা ১৫-২০ দিন। পাওয়া যায়, রকমারি মিষ্টি, খেলনা, মনোহারি সামগ্রী, লোহা ও কাঠের তৈরি বিভিন্ন আসবাবপত্র, মাটির তৈরি তৈজসপত্রসহ সদরঘাটের পান। মেলাকে ঘিরে আয়োজন করা হয়, শিশু কিশোর দের জন্য নাগরদোলা, সার্কাস, মৃত্যুকূপ ও মোটরসাইকেল খেলা। এছাড়া বিভিন্ন খেলাধুলারও আয়োজন করা হয়।
শুধু তাই নয় মেলা প্রাঙ্গণে ওরস মোবারককে ঘিরে সারারাত চলে ভক্তদের জিকির, সামা কাওয়ালি। ভক্ত ও আগ্রহী মানুষরা এতে যোগ দেন দূর-দূরান্ত থেকে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে পাপ মোচন ও পুণ্য লাভের আসায় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ বাঘায় আসেন পবিত্র ওরস মোবারকে অংশ নিতে ও মাজারে নামাজ আদায় করতে।
এলাকবাসী জানান, মূলত ওরসকে কেন্দ্র করেই মেলার আয়োজন। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে ঈদুল ফিতরের উৎসব মানেই বাঘার ‘ঈদ মেলা’।
এলাকাবাসীরা বলেন, শিল্প মহিমার বিস্ময়কর স্থাপত্য নকশার অনন্য নিদর্শন বাঘা শাহী মসজিদের ভেতরে প্রবেশ পথের উত্তরে বাঁ দিকে হযরত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহেদৌলা (রহ.) এর মাজার শরিফ। শাহী মসজিদের উত্তরে খানকা বাড়ির ভেতরে তার ছেলে হযরত শাহ আবদুল হামিদ (রহ.) এর মাজার শরিফ আছে। আর একটু উত্তর পার্শ্বে গেলে পাওয়া যাবে জাদুঘর। ইতিহাস অনুযায়ী এখানে ছিল উপমহাদেশের প্রথম ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়, এছাড়াও মাজার শরীফের পাশে আছে বিশাল এক দীঘি। বাঘা শাহী মসজিদ এখানকার ঐতিহাসিক নিদর্শন। এ মসজিদের ছবি রয়েছে দেশের ৫০ টাকার নোটে। ওরস ছাড়াও সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার মনবাসনা পূরণের জন্য হাজার হাজার দর্শনার্থীর আগমন ঘটে বাঘা শাহী মসজিদ ও মাজার শরিফে।
স্থানীয়রা জানায়, বাঘার ঈদ মেলাকে ঘিরে ভারত থেকে অনেক মানুষ আসেন। ঈদের আগের দিন ভারত থেকে জামাইসহ মেয়েরা চলে আসেন বাপের বাড়ি। মেলায় ঘুরে কিছুদিন থেকে সবার সঙ্গে ঈদ উদযাপন করে আবার ফিরে যান। বাবা-মা ও স্বজনরাও অপেক্ষা করেন ঈদ এলে তার মেয়ে আসবে। কিন্তু এবার বিশ্ব মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে এবার এই মেলা হচ্ছে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ওয়াকফ এস্টেটের মতোয়াল্লী মুনসুরুল ইসলাম জানান, ঈদ মেলার জৌলুস প্রতি বছরই বাড়ছে। বাড়ছে লোক সমাগমও। ঈদ মেলার জন্য বাঘার মানুষ অপেক্ষা করেন সারা বছর। মেলা দেখতে আসেন পর্যটকরাও। এতে লাখো মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় এ মেলা।
তিনি আরো বলেন, করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এই বছর ৫০০শত বছরের পুরনো এই মেলার আয়োজন করা হয়নি।