দেশে করোনার আঘাতটা ছিল ৮ মার্চ ২০২০। অজানা এক ভীতি, শঙ্কা আর অস্থিরতা বাসা বেধেছিল দেশের প্রত্যেকটি মানুষের অন্তরে। কারন ছোঁয়াচে এ ঘাতক ব্যধিটির প্রতিষেধক ছিল নেই। সমাধান একটাই, মানুষকে সচেতন করে করোনা মোকাবেলা করা। সেই যুদ্ধ অবশ্য এখনো চলছে। সময়ের সাথে বেড়ে চলেছে আক্রান্তের সংখ্যা, বেড়েছে কাজের ব্যাপ্তি।
সরকারী নির্দেশনা মেনে তার বাস্তবায়ন, মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে তাদের নানা রকম সমস্যা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহনের কাজটি করতে হচ্ছে। স্বাস্থ্যঝুঁকি জেনেও কাজ করতে হচ্ছে মানুষের জন্য। এ কারনে দূরত্ব বেড়েছে পরিবারের সাথে। দিন শেষে একমাত্র সন্তানকে ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে ধরার আঁকুতিতে ছেদ ঘটিয়েছে ভয়ঙ্কর করোনা। তবে দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবেলার। বলছিলেন ফরিদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ মাসুম রেজা।
একজন আদর্শ শিক্ষক বাবার সন্তান তিনি। দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতার শিক্ষা পেয়েছেন পরিবার থেকেই। তাছাড়া ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহন করে চলছি। এখন দায়িত্বশীল পদে থেকে রাষ্ট্রের নির্দেশনা পালনের পাশাপাশি মানবিক কাজগুলো চালিয়ে যাচ্ছি। সে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে করোনার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এ যুদ্ধের সহযোগী হিসেবে যুক্ত রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী ও সামাজিক সংগঠন তরুছায়া ফাউন্ডেশনের একটি স্বেচ্ছাসেবকদের দল। তাদের পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ সহযোগীতা নিয়ে মোকাবেলা করা হচ্ছে করোনা পরিস্থিতি। জানালেন ইউএনও মোঃ মাসুম রেজা।
করোনা মোকাবেলায় কার্যক্রম সম্পর্কে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, সরকারি নির্দেশনার পর থেকেই উপজেলা জুড়ে করোনা প্রতিরোধে জীবানুনাশক ছিটানো শুরু হয়। পাশাপাশি করোনা মোকাবেলায় সচেতনতামুলক মাইকিং এবং এ সংক্রান্ত প্রচারপত্র বিলি শুরু করা হয়। দ্রুত সময়ে সব জায়গায় সেবা পৌঁছে দিতে খোলা হয় করোনা সংক্রান্ত তথ্য ও সহায়তা কেন্দ্র। মুঠোফোনে সেবা দিতে ও নিতে উপজেলা থেকে হেল্পলাইন নম্বর দেয়া হয়। একদল তরুণ স্বেচ্ছাসেবক সহায়তা কেন্দ্রটি দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে।
করোনা সংক্রান্ত তথ্য ও সহায়তা কেন্দ্র চালুর পর থেকে তৃণমুল পর্যায় থেকে নানা শ্রেনি পেশার মানুষ তাদের সমস্যার কথা জানিয়ে হেল্পলাইনের নম্বরে আবেদন জানাতে থাকেন। সেই সাথে কোন পরিবারের কে করোনা আক্রান্ত হয়েছে? দেশের কোন জেলা থেকে কবে কে গ্রামে ফিরলেন? সব তথ্যই ঘরে বসে জানার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তথ্যকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্তরা মুঠোফোনের অপরপ্রান্ত থেকে আবেদনের ধরন রেজিষ্টারভুক্ত করছে। সেসব তথ্য যাচাই বাছাই করে অগ্রাধিকার বুঝে তার সমাধান পৌঁছে দেয়া হচ্ছে সেবা প্রত্যাশীদের ঘরে ঘরে। তবে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের চেয়ে অভাবী মানুষের খাবার, চিকিৎসার সমস্যা নিয়েই হেল্পলাইনে আবেদন আসছে বেশি।
করোনা সংক্রান্ত তথ্য ও সহায়তা কেন্দ্রের উদ্যোক্তা ইউএনও মাসুম রেজা মনে করেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় চলমান লকডাউন ও যানবাহন চলাচল সীমিত হওয়ায় বিপাকে পড়ে সাধারন খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ। মুলত আয় রোজগার বন্ধ হয়ে পড়ায় সমস্যা তৈরী। এসব মানুষ সামাজিক সম্মানের ভয়ে অনেক সময় হাত পেতে সাহায্য নিতে চান না। তাঁদের কথা বিবেচনা করেই তথ্যসহায়তা কেন্দ্রটি চালু করা হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের যথেষ্ট সুফলও মিলছে।
দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ-করোনার মতো সংকট মোকাবেলা শুধু প্রশাসনের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সংকটে সকলের পাশে সেবা পৌঁছে দিতেই সামাজিক সংগঠন তরুছায়া ফাউন্ডেশনের সদস্যের স্বেচ্ছাসেবক টিম কাজ করছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। তারা বিদেশ ফেরত কিংবা ঢাকা, নারায়নগঞ্জ ও গাজীপুরসহ করোনা সংক্রমন জেলা থেকে গ্রামে ফেরা ব্যক্তিদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে। পাশাপাশি তাদের হোমকোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করে খাবার-চিকিৎসাসহ নানা রকম সেবা দিয়ে যাচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগীতা দিয়ে যাচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে চিকিৎসা সেবার জন্য অনলাইনে অভিজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা চিকিৎসা প্রদানের জন্যেও প্লাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবকদের পাশাপাশি ইউএনও ছুটছেন হতদরিদ্র, মধ্যবিত্ত কিংবা চিকিৎসা সেবা নিতে ইচ্ছুক মানুষের কাছে। সরকারি দায়িত্বে বাইরে থেকেও করোনাকালে মানুষকে খাবার, অভাবী পরিবারের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের চিকিৎসার দায়িত্ব বহন, গেরদা ইউনিয়নের বাখুন্ডা এলাকায় নিগ্রহের শিকার একটি বেদে সম্প্রদায়কে হোমকোরাইন্টাইনে রেখে খাবার সরবরাহের কাজগুলো করেছে মানবিক দায়িত্ববোধ থেকেই।
সর্বশেষ কৃষকের মেরুদন্ড সোজা রাখতে ধানকাটা শ্রমকিদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করে তাদের কাজে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বাইরের জেলা থেকে ফরিদপুরে ধান কাটতে আসা শতাধিক শ্রমিকের খাবার-চিকিৎসা ও আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করেছে ইউএনও মোঃ মাসুম রেজা। কাজ শেষে বাড়ি ফেরা শ্রমিকদের হাতে তুলে দিয়েছেন যাতায়াত খরচের টাকাসহ তাদের পরিবারের জন্য ঈদ সামগ্রী।
কৃষি ও কৃষকের প্রতি ভালোবাসা প্রতিফলন ঘটেছে তার এ কর্মকাণ্ডে। সর্বশেষ তিনি স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্যোক্তার প্রসার ঘটাতে করোনা পরিস্থিতির মাঝেও স্বেচ্ছাসেবীদের সাথে মতবিনিময় করে তাদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা সৃষ্টি করে দিবেন বলে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। কারন উপজেলা থেকে স্বেচ্ছাসেবী ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা উদ্যোক্তা হলে দ্রুতই দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।
ইউএনও মাসুম রেজা জানান, সরকারি দায়িত্বের বাইরেও মানবিক কাজগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পরিবারকে সময় দিতে পারি কম। তারপরও করোনাকালে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে নিরন্তর। দিন শেষে যখন বাসায় ফিরি তখন দেখি একমাত্র সন্তান আরহাম ঘুমিয়েছে। সাথে সন্তানের মাও। দরজা খোলার আওয়াজে কখনো শিশুটির ঘুম ভাঙ্গলে দৌঁড়ে আসে আমাকে জড়িয়ে ধরতে। অনেক সময় ইচ্ছা থাকা সত্বেও পারিনি। তবে মনটা ওদের জন্য খারাপ হতো। দেশের মানুষের জন্য কাজ করছি সামনের দিনেও করে যাবো।