বিদায় আরিয়ান
—————————————————————
।।রেজাউল করিম।।
আরে তুই খা। আরে না না দোস তুই খা। টিফিনের রুটি ছিঁড়ে মুখের কাছে এনে পীড়াপীড়ি করতো সে।
এই খাওয়া না খাওয়ার পীড়াপীড়ি অভিমানের জন্ম দিতো দুই বন্ধুর। গাল ফুলিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে দিকে তাকিয়ে থাকত সে।
ও বেশিরভাগ সময় জানালার পাশেই বসত। আমি ওর বেঞ্চে পাশাপাশিই বসতাম। তখন আমরা ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র।
নব্বই দশকে ফরিদপুরের স্বনামধন্য পুলিশ লাইন স্কুলে তখন আমরা ছিলাম সহপাঠী ও পরস্পরের বন্ধু। কিন্তু ওর নামের সাথে আমার নামের মিল থাকায় আমারা হয়েছিলাম পরস্পরের মিতে ( দোস্তো)।
আমার সেই মিতের নাম দেওয়ান মো. রেজাউল করিম আর আমি মুহাম্মদ রেজাউল করিম। সবাই ওকে ডাকনামে ডাকতো সোহেল।
সোহেল রোজই টিফিন আনতো। আমি আনতাম মাঝে মাঝে।
জানলা থেকে মুখ সরিয়ে গাল ফুলানো সোহেল আমাকে বলতো চল নামাজ পড়ে আসি। আমি সায় দিয়ে বলতাম, চল দোস। বাকী রুটিটা বাক্সবন্দি করে আমরা পুলিশ লাইনের পুকুর ধারের মসজিদে নামাজ আদায় করে ক্লাসে ফিরতাম।
ক্লাস শেষে সেই বাকী রুটিটা ছিঁড়ে ওর মায়ের হাতের রান্নার কুচিকুচি কাটা আলু ভাজি দিয়ে দু’জনে খেয়ে যে যার বাসায় ফিরেছি। ও কমলাপুরে। আর আমি লক্ষীপুর।
সে সময় অহিদ,রিয়াজ, তরুন, আজাদ,রাশেদ,আলীম, তাপু, স্বরসতি,মর্জিনা,হাওয়া, প্রিন্স, মারুফ, কনা,কলি, রতন,রুবেল, আ:জলিল, জুম্মান- আমরা ছিলাম যেন হরিহর আত্মা।
স্যারদের ভয়ে ক্লাসে গুটিসুটি মেরে থাকলেও বাইরে এসে হৈ হৈ রই রই সময় কেটেছে আমাদের। ভদ্র ও নম্র স্বভাবের হওয়ায় সোহেল ছিলো আমাদের প্রিয়জন । যা আছে এখনো।
নাটক,উপস্থিত বক্তৃতা,মার্চপাস্ট, ডিসপ্লে সবই কিছুতেই আমরা ছিলাম অগ্রসর ও পাশাপাশি। আমাদের তৎকালীন হেডস্যার ছিলেন আ: রাজ্জাক স্যার ও পরবর্তীতে আসেন মহিউদ্দিন আহমেদ স্যার। কঠোর শাসন করলেও শিক্ষকরা আমাদের সন্তানসম ভালোবাসতেন। টের পাই আজও আমরা অন্তরের বীণাতারে।
পুলিশ লাইনের পাঠ চুকিয়ে যে যার মত পছন্দের স্কুলে ভর্তি হয়। আমার মিতে
চলে যায় জিলা স্কুলে আমি ফরিদপুর উচ্চ বিদ্যালয়( হাই স্কুল)।
এরপর কলেজ জীবনে দু’জনে রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হলেও বিভাগ ভিন্ন হওয়ায় দেখা সাক্ষাত হতো কদাচিৎ।
কলেজ জীবনের রঙিন দিন শেষে করে বাস্তব জীবনে হুমড়ি খেয়ে দল ছুট ব্যাস্ততার চাকরি,ব্যবসা আর সংসারে মায়াজালে আটকা পরেছি বাঁধাধরা নিয়মের বেড়াজালে।
একযুগের বেশি আমার মিতের সাথে দেখা নেই। মিতে ব্যাংকার,আমি শিক্ষক ও সাংবাদিক। মিতে ছুটি পায় কম। ঈদের ছুটিতে কমলাপুরের বাড়িতে আসে ঠিকই কিন্তু আমার সাথে দেখাই হয় না। গোস্বা থাকে আমার মনে মনে।
গোস্বা আজ ভাঙ্গলো আমার মিতের বুকের সাথে বুকে বুক মিশেয়ে শুধুই অশ্রুজলে।
মিতে আজ কাঁদে না, হাসেও না শুধু অপলক তাকিয়ে আছে কফিনে রাখা ১১বছর বয়সী একমাত্র পুত্র সন্তান আরিয়ানের মুখপানে চেয়ে।
আরিয়ানের মা আরিফা করিম তার নাড়ীছেঁড়া ধন আরিয়ানের মুখ থেকে কাফনের কাপড় সরিয়ে নাকে কানে তুলে গুঁজে আর্তনাদ করে বলছে “আমার আরিয়ানকে কবরে রাইখো; কিন্তু খেয়াল রেখো ওর শরীর যেন পানিতে ভিজে না ওর ঠাণ্ডা লাগবে রে…”
বাকরুদ্ধ আমি সবার মতোই হু হু করে কাঁদি; মিতে বয়ে নিয়ে যায় সন্তানের লাশ নিজের কাঁধে করে। এবার হামলিয়ে কাঁদে মিতে আরিয়ানের খাটিয়ার ভারে।
সম্রাট শাহজাহান এর কথাটি এবার মনে পরে আমার -‘পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভার হলো পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ।’
আলীপুরের গোরস্তানে কামিনী ফুলতলায় খোড়া কবরে মাটির ঢেলা গুঁজে দিয়ে আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম শ্রাবণের গোমরামুখী
পশ্চিম আকাশের দিকে।
টিফিনের রুটি ভাগ করে খাওয়ানো আমার মিতের জনম দুঃখির ভাগের ভাগীদার হয়ে গেলাম রে বাপ আরিয়ান। ভালো থাকিস বাপ।
ঘরেফেরা অভিমুখে আমার অব্যক্ত আর ব্যথিত মরমে শুধুই ধ্বনিত হয়:
“তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি
যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।
শত কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি,
গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।
এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে,
গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।”
বিদায় আরিয়ান।
রাজধানীর আদমজী স্কুল এন্ড কলেজ এর পঞ্চম শ্রেণি ছাত্র আরিয়ান ও তার মা ফরিদপুর টেপাখোলার মেয়ে আরিফা করিম ডেঙ্গি ফিভার (ডেঙ্গু জ্বর) এ আক্রান্ত হয়ে সম্প্রতি ঢাকাস্থ ইবনেসিনা হাসপাতালে ভর্তি হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার রাত সাড়ে বারোটায় সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে আরিয়ান চলে যায় না ফেরার দেশে।
✒️রেজাউল করিম
ফরিদপুর।
৩০ জুলাই, ২০২১।