• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
একুশে – নতুনভোরের প্রত্যাশা

একুশে – নতুনভোরের প্রত্যাশা

মো: কামাল হোসেন

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দোলাচলে কালের আবর্তে মহাকালের গর্ভে দগদগে ক্ষত চিহ্ন রেখে গেলো একটি বছর ২০২০। স্বপ্ন আর সম্ভাবনা নিয়ে যাত্রা শুরু হচ্ছে নতুন বছরের। না পাওয়ার সব গ্লানি মুছে নতুন বছর অর্জন আর প্রাচুর্য্যে, সৃষ্টি আর কল্যাণে হেসে উঠবে-এই প্রত্যাশা সবার। সময়ের স্রোতে মিশে যায় মানুষের স্মৃতি-বিস্মৃতির বহমান ধারা। বছর শেষে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসেব-নিকেশ যেমন থাকে, তেমনি থাকে নবউদ্যমে নবযাত্রার সংকল্পও। অতীতের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের সঙ্গে প্রয়োজন ভবিষ্যৎ যাত্রার রূপরেখা প্রণয়ণ। সেটা যেমন ব্যক্তি পর্যায়ে তেমনি সামাজিক, রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও।

বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়ের সামনে দাঁড়িয়ে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরে পদার্পণের অপেক্ষায়। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করবে বাংলাদেশ। তার আগে ২০২০ সালে আমরা উদযাপন করছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। এ উপলক্ষে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জন্মশতবর্ষের শুরু থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পর্যন্ত ‘মুজিব বর্ষ’ হিসেবে উদযাপনের সিদ্বান্ত থাকলেও কোভিড-১৯ মহামারির কারণে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করা যায়নি। সে কারণে সরকার মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের মাধ্যমে মুজিববর্ষের সময়কাল ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত বর্ধিত করে প্রজ্ঞাপণ জারি করেছে। সব মিলিয়ে সামনের দিনগুলোতে জাতীয় ইতিহাসের অনন্য সব অধ্যায় উদযাপনের মধ্য দিয়ে সময় পার করবে জাতি। আগামীর পথে বাংলাদেশের এই যাত্রা শুভ হোক।

জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি পালন- বাঙালি জাতির জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন ‘বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ‘একটি স্বাধীন, সার্বভৌম সুখী, সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার।’

সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন,“বাংলাদেশ ২০২১ সালে স্বাধীনতা লাভের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করতে যাচ্ছে। এই মহান উৎসব উদযাপনের লক্ষ্যে, আমরা বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত এবং একটি মর্যাদা সম্পন্ন জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে চাই যাতে কেউ আমাদেরকে দরিদ্র ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ দেশ হিসেবে উল্লেখ করে অবহেলা করতে না পারে।”

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই দীপ্ত উচ্চারণ আমাদের স্বপ্ন দেখায় নতুনভোরের। সেই ভোরের শুরু হোক একুশ সালের প্রথম সকাল হতেই। সকল বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে একুশ সাল আসুক আমাদের জাতীয় জীবনে পয়মন্ত হিসেবে।

ঘটনাবহুল ২০২০ সাল বিশ্বে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে রয়ে যাবে আলোচনার অংশ হিসেবে। বেশ ধুমধামে শুরু হয়েছিল ২০২০ ইংরেজি নতুন বছর। তখনও কেউ অনুধাবন করতে পারেনি কতটা ভয়ংকর থাবা নিয়ে হাজির হচ্ছে বছর টি। ধারণা করা হয় ২০১৯ সালেই চীনের উহানে ছড়িয়ে পড়েছিল মরণঘাতি ভাইরাস কোভিড-১৯। ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম যখন ‘অজানা’ একটি ভাইরাস সংক্রমণের খবর প্রকাশিত হয়, তখন মানুষ ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারেনি যে সেই ভাইরাসটি পরের দিনগুলোতে পুরো পৃথিবীকে ওলট পালট করে দেবে। শুরুর দিকে যখন ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার খবর প্রকাশিত হওয়া শুরু করে তখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশের কর্তৃপক্ষই সংক্রমণটিকে ততটা গুরুত্বের সাথে নেয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে যখন লাফিয়ে লাফিয়ে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা দুটোই বাড়তে থাকে, তখন পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি দেশ বিভিন্ন রকম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে থাকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে। বিশ্বে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ইতোমধ্যে ৭ কোটি ৮০ লাখ ছাড়িয়েছে। মৃত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ ৩০ হাজারের বেশি (২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত)। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয় মার্চের আট তারিখে, সে হিসাবে দশ মাস পূর্ণ হচ্ছে। বাংলাদেশে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী মারা গেছে ৭৩৯৮ জন। আক্রান্তের সংখ্যা ইতোমধ্যে পাচ লাখ ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির পূর্বাভাস বিষয়ক একটি বিশেষজ্ঞ দলের অভিমত আগামী জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ কিংবা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে করোনা সংক্রমনের দ্বিতীয় ঢেউ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছাতে পারে। তবে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়ে করোনা সংক্রমন ও মৃত্যু দুইই কমানো সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞগণ মত দিয়েছেন।

বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস ছিল পরাধীনতার। হাজার বছরের সেই গ্লানি থেকে এ জাতি মুক্ত হয়েছে যার নেতৃত্বে, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই তো তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা।সেই মহান ব্যক্তির জন্মশতবার্ষিকী, গোটা জাতির জন্য এ এক আনন্দঘন দিন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অসাধারণ সময়। সেদিন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে প্রিয় স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন। সারা বাংলাদেশ যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল তেজগাঁও বিমানবন্দর ও রেসকোর্স ময়দানে। বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ক্ষণগণনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান উদযাপন হতে থাকে যাতে নতুন প্রজন্মের কাছে জাতির পিতার নির্মোহ ও সাহসী জীবনকে তুলে ধরার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা উদযাপিত হবে। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ইতিহাসে প্রথম বিশেষ অধিবেশন বসে। সংসদীয় রাজনীতিতে এটাও এক মাইলফলক।

অভ্যন্তরীণ অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ দেশের অর্থনীতির সক্ষমতাকে নির্দেশ করে। প্রধানমন্ত্রীর সাহস প্রদর্শন দেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থানকেই নির্দেশ করে, যা কোভিড-১৯-এর মধ্যেও প্রমাণিত হয়েছে। যখন পরিবর্তিত সময়ের সাথে লড়াইয়ে অনেক শক্তিশালী অর্থনীতি হিমশিম খাচ্ছে তখন বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ভাল করছে। এর সকল কৃতিত্বের দাবীদার আমাদের প্রধানমন্ত্রীর যিনি প্রমাণ করেছেন সততা এবং নিষ্ঠা থাকলে সবকিছুই করা সম্ভব। ৪১তম স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে পদ্মা সেতুটি এখন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সরকার ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে যে ২০২২ সালের ২৬  মার্চ দেশের স্বাধীনতা দিবসে সেতুটি চালু করা হতে পারে। ২০২২ সালের স্বাধীনতা দিবসে সেতুটি চালু করতে পারলে এটি হবে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। পদ্মা সেতুটি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘকালীন আকাঙ্ক্ষার ফসল। এটি কেবল ভ্রমণের সময় হ্রাস করবে না, বরং এই অঞ্চলে ব্যবসা এবং বিনিয়োগের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। খুলনা ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন স্থানে মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প নির্মিত হবে। এটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে মংলা ও পায়রা বন্দরের মধ্যকার সংযোগকে আরও জোরদার করবে। এটি আঞ্চলিক যোগাযোগকে আরও শক্তিশালী করবে। ২০২০ সালে পদ্মাসেতু সম্পূর্ণরুপে দৃশ্যমান হওয়া জাতির জন্য বড় অর্জন হিসেবেই লেখা থাকবে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হওয়ায় সরকার কোভিড-১৯ এর মাধ্যমে সৃষ্ট ‘‘নিউ নরমাল’’ জীবনযাত্রা মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ ভালোভাবেই গ্রহণ করেছে। মহামারি চলাকালীন  বিভিন্ন পরিষেবাকে অনলাইনে রূপান্তর করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নির্দেশনার আলোকে সরকার বিভিন্ন নীতি ও কৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির আওতায় ১১ বছরে গড়ে ওঠা তথ্য প্রযুক্তি অবকাঠামোই এ কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে কাজে লেগেছে বলে মনে করেছেন তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৫ এপ্রিল করোনাভাইরাসের আর্থিক ক্ষতি কাটাতে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন। এর মধ্যে শিল্প ঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ২০ হাজার কোটি টাকা, রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা, রফতানি উন্নয়ন ফান্ড ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, প্রিশিপমেন্ট ঋণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা, গরিব মানুষের নগদ সহায়তা ৭৬১ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে দশ টাকা কেজিতে চাল দেয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা। এছাড়াও করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।এর আগেও বিভিন্ন সময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আনতে সরকারের তরফ থেকে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা মহামারীর দ্বিতীয় দফা প্রাদুর্ভাবকে (সেকেন্ড ওয়েভ) সামনে রেখে আর্থিক প্রণোদনার একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন।

২০২১ সালে প্রত্যাশা:

বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোক, অর্থাৎ প্রায় ২৩০ কোটি মানুষ তাদের ঘরে বসে সময় কাটাচ্ছেন বা কাটিয়েছেন। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এত বেশি সংখ্যক মানুষ একই সময়ে একটানা, এত দীর্ঘকাল ঘরে বন্দী থাকার নজির আর নেই। এক অদৃশ্য ভাইরাসের আক্রমণে তছনছ হয়ে গেছে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বব্যবস্থা। এই অবস্থা থেকে কখন মুক্তি মিলবে তার কোন সুস্পষ্ট ধারণা কেউ দিতে পারছেন না। কিন্তু করোনাভাইরাস পরবর্তী বিশ্ব সম্পর্কে যেসব বিশেষজ্ঞ এবং ফিউচারোলজিস্ট এরই মধ্যে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন, তারা সবাই একটা বিষয়ে একমত যে পৃথিবী আর আগের মতো নেই। গত কয়েক মাসে যা ঘটেছে, তার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। এই মহামারির পর পাল্টে যাবে আমাদের কাজ-প্রাত্যহিক জীবন-ভ্রমণ-বিনোদন থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতি-রাষ্ট্র-সমাজ সবকিছু। ভ্যাকসিন চলে আসায় নজিরিবিহীন এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের একটা আশাবাদ তৈরি হয়েছে। পৃথিবীতে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ সাধারণ মানুষকে করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু করেছে। সব কিছু ঠিক থাকলে ২০২১ সালের জানুয়ারির শেষ বা ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে সিরাম ইন্সটিটিউট থেকে করোনাভাইরাসের  টিকা বাংলাদেশ পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বিশ্বে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা রাখা দেশগুলোর তালিকায় বেশ ভালো অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ব্লুমবার্গ প্রকাশিত ‘কোভিড রেজিলিয়েন্স র‌্যাংকিং’-এ ডিসেম্বরে ২০তম অবস্থানে রয়েছে দেশটি। আর তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশ। ভারত-পাকিস্তানের ঠাঁই হয়েছে র‌্যাংকিংয়ের নিচের সারিতে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, সৌদি আরবের মতো দেশগুলোর চেয়েও এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক আঘাত মোকাবেলায় সক্ষমতাসহ বিভিন্ন সূচকের ওপর ভিত্তি করে গত কয়েক মাস ধরে করোনা সহনশীল দেশের আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিং প্রকাশ করছে ব্লুমবার্গ। নভেম্বরে ২৪তম স্থানে ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু চমৎকার দক্ষতা দেখিয়ে ১ মাসের ব্যবধানে চারধাপ উপরে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণে দারুণ সফলতা দেখিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং টিকা নিতে পারলে মরণ ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই সহজ হয়ে যাবে বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন। চাই যত দ্রুত সম্ভব এ পৃথিবী হোক করোনামুক্ত।

করোনাভাইরাস মহামারি পরবর্তী বিশ্বে অর্থনীতির অবস্থা কী দাঁড়াবে সেটা নিয়েই সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা। অনেকের ধারণা, মহামারি হয়তো নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে, কিন্তু এটা করতে গিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির যে মারাত্মক ক্ষতি এর মধ্যে হয়ে গেছে, তা কাটাতে বহু বছর লেগে যাবে। করোনাভাইরাস মহামারি কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে । এক্ষেত্রে আশা দেখাচ্ছে পোশাকখাত ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ২০৬৪ মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এথেকে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের গতি স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। ২০২১ সালে অর্থনীতির চাকা আরও সচল হবে সে প্রত্যাশা নিয়েই এগোতে হবে।

ইতিহাসবিদ ইয়োভাল নোয়া হারারির মতে, করোনাভাইরাস পরবর্তী বিশ্বে আরেকটি বড় প্রবণতা হবে, কট্টর জাতীয়তাবাদের উত্থান। প্রত্যেকটি রাষ্ট্র নিজেকে সুরক্ষিত করতে চাইবে অন্যের মুখের ওপর দরোজা বন্ধ করে দিয়ে। এ কারণে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নিজস্ব সুরক্ষা বলয় গড়তে হবে। বাংলাদেশের খাদ্য সয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন হতে পারে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। পর্যায়ক্রমে সকল ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে যাতে করে বৈশ্বিক যে কোন সংকটে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি সফলতার সাথে সে সংকট মোকাবিলা করতে পারে।

বিশ্বের বহু মানুষ এখন ঘরে বসেই কাজ করছেন। প্রযুক্তি বেশ সহজ করে দিয়েছে ব্যাপারটি। অনেক স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পাঠদান করছে অনলাইনে। বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেওশিক্ষার্থীদের জন্য টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এবং অনলাইন পাঠদান চালু করাসহ সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখে এবং অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা যাতে পড়াশোনায় নিযুক্ত থাকে সেজন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সরকারের অনেক সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌছে গেছে ডিজিটাল বাংলাদেশের বদৌলতে। অনলাইন ভিত্তিক কেনাকাটা বেড়েছে কয়েকগুণ। করোনাকালে অনেক উদ্যোক্তা তাদের ব্যবসা বাড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৬ কোটি ২৯ লাখ মোবাইল গ্রাহকের মধ্যে ১০ কোটি ১১ লাখ ৮৬ হাজার গ্রাহক এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। মোবাইলে আর্থিক সেবা, রাইড শেয়ারিং, ই-কমার্সসহ বেশ কিছু সরকারি সেবা এখন হাতের নাগালে। এ ছাড়া আগামী বছরের প্রথমার্ধে পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল সেবা (ফাইভজি) চালুর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডাটা অ্যানালিসিস, ইন্টারনেট অব থিংকস, ব্লকচেইনের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে পা রাখবে বাংলাদেশ। উচ্চগতির মোবাইল ইন্টারনেট কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্প ও সেবা খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। এ রকম আশা জাগানিয়া সংবাদ একুশে আমাদের অগ্রযাত্রাকে তরান্বতি করবে তাতে সন্দেহ নেই।

করোনাভাইরাসে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ একটি খাত হচ্ছে বিমান চলাচল এবং পর্যটন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হলে এবং করোনাভাইরাসের টিকার কার্যকারিতা কাংখিত মাত্রায় সফলতা না পেলে, এই দুটি খাতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। তার মানে কাজ বা বিনোদনের জন্য যে ধরণের বাধাবিঘ্নহীন ভ্রমণে এখন মানুষ অভ্যস্ত তা অনেক পাল্টে যাবে। বিমান ভ্রমণ অনেক ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়াবে। আন্তর্জাতিক পর্যটন ধসে পড়বে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের গ্রাহক অধিকাংশ স্থানীয়। বিমান পরিবহনের কারণে এর ক্ষতির আশংকা কম হলেও সামগ্রিক অবস্থার ওপর প্রভাব পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পর্যটন আকর্ষণ বাড়াতে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। বিপুল সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান গড়ে ওঠেছে পর্যটনকে ঘিরে। তাই পর্যটনের উন্নয়নে এবং বেকার সমস্যার সমাধানে এখাতকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঢেলে সাজাতে হবে।

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করে নতুন প্রজন্মকে নৈতিক ও মানবিকগুণের অধিকারী হতে হবে নতুন বছরে এটা প্রত্যাশা করি। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে ধারণ করে দেশপ্রেম লালন করে প্রত্যেক নাগরিককে যার যার অবস্থান থেকে দেশের সার্বিক কল্যাণের জন্য কাজ করে যেতে হবে। তবেই আমরা বিনির্মাণ করতে পারব বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ।

প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে বিদ্যমান সমস্যা সমাধান ও নতুন সম্ভাবনা তৈরি করোর উদ্যোগ নিতে পরিকল্পনা প্রণয়ণ করতে হবে। রোহিঙগা সমস্যার শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে আরওসূদূর প্রসারী পরিকল্পনা সাজাতে হবে।

করোনাকালে দেশে যে সকল প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছে তাদের আবার কর্মে ফেরার উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি নতুন শ্রম বাজারে আমাদের শ্রমিকের প্রবেশ সহজ করতে কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে।

স্কুল, কলেজ,বিশ্ব বিদ্যালয়গুলো করোনা পরবর্তী সময়ে আবার কার্যক্রম শুরু করবে। কোমলমতি শিশুদের হাতে নতুন বই পৌছে যাবে এ প্রত্যাশার পাশাপাশি আরও প্রত্যাশা করি সমাজে শিশু ও নারী নির্যাতন,সন্ত্রাসী-রাহাজানি ইত্যাদি বন্ধ হবে। কৃষক তার ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবে। সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে সক্ষম হবে। থাকবেনা ঘুষ আর দূর্নীতির ন্যায় উন্নয়ন অন্তরায়। নতুন বছরে প্রত্যাশাগুলো পূর্ণতা পাক। সকলকে নতুন ইংরেজি বছরের শুভেচ্ছা।

ফেসবুকে লাইক দিন

তারিখ অনুযায়ী খবর

এপ্রিল ২০২৪
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
« মার্চ    
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
দুঃখিত! কপি/পেস্ট করা থেকে বিরত থাকুন।