করোনাভাইরাসের কারণে চরম সঙ্কটে পড়েছেন দেশের দুগ্ধজাত শিল্পের যোগানদাতা ডেইরি খামারিরা।
একদিকে গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধি, অন্যদিকে মিষ্টিজাতীয় দোকানগুলো বন্ধ ও বাজারে আগের মত দুধের চাহিদা না থাকার কারণে দুধের ন্যায্য দাম না পাচ্ছেন না খামারিরা। ফলে উভয় সঙ্কটে পড়েছেন প্রায় সাড়ে ৩ লাখ খামারি।
খামার সংশ্লিষ্টদের দাবি সঙ্কট উত্তরণে এখনই পদক্ষেপ না নিলে পথে বসে যাবে হাজার হাজার ক্ষুদ্র খামারি। কারণ চাহিদা না থাকায় ৫০ টাকা লিটারের দুধ বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকায়। অন্যদিকে গরুর বিভিন্ন খাদ্য যেমন-খৈল, ভুষি ইত্যাদির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ থেকে ১২ টাকা করে। বড় খামারিরা কয়েক মাস চালিয়ে নিতে সক্ষম হলেও ক্ষুদ্র খামারিরা বিপদে পড়েছেন।
গো-খাদ্যের যোগান দিতে না পারায় এরই মধ্যে প্রান্তিক পর্যায়ে খামারিরা গরু বিক্রি করতে শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। তবে সেখানে ঠিক মতো দাম পাচ্ছেন না। যে গরুর দাম ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা তা বিক্রি করতে হচ্ছে দুই লাখ টাকায়। তাই সঙ্কট মোকাবিলায় দ্রুত সরকারের হস্তক্ষেপ চান খামারিরা।
খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে তিন লাখ দুগ্ধ খামার রয়েছে, যেখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় সোয়া কোটি মানুষ। যাদের জীবন-জীবিকা এই দুগ্ধ শিল্পের ওপর নির্ভর করে। বর্তমানে দেশে বার্ষিক প্রায় ৯৯ লাখ মেট্রিক টন দুধ উৎপাদন হচ্ছে, যা মোট চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ। দেশের এ পরিস্থিতিতে বড় একটি অংশ অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। তাই সরকার ও দেশের দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতের কোম্পানিগুলোর সহযোগিতা না পেলে অচিরেই প্রায় ৫০ শতাংশ খামার বন্ধ হয়ে যাতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. এমরান হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে দেশে মিষ্টিজাতীয় দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা দুধ বিক্রিতে বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। বাধ্য হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার খামারিদের পানির দামে দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে। আবার অনেক খামারি দুধ বিক্রিও করতে পারছেন না। এ বিষয়ে সরকারের মন্ত্রীসহ বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। আসলে এ মুহূর্তে অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার নেই।’
তরল দুধ পাউডার দুধে রূপান্তরিত করে সমাধান করা যায় কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে মূলত তরল দুধ থেকে পাউডার দুধ উৎপাদন করে মিল্কভিটা, ব্র্যাক ও প্রাণের মত কোম্পানি। সমস্যা হচ্ছে তাদের পর্যাপ্ত উৎপাদন ক্ষমতা ও পাউডার দুধ রাখার মত গোডাউন নেই। পাউডার মিল্ক চাইলেই তৈরি করে যেকোনো গোডাউনের সংরক্ষণ করা যায় না। আবার এ মুহূর্তে বিশেষ ধরনের এ গোডাউনের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। তাই প্রান্তিক খামারিদের প্রণোদনা ছাড়া এই সেক্টরের উন্নতি করা সম্ভব নয়। এমন প্রণোদনা দেওয়া যাতে যেসব খামারি গরু কিনে আবার খামার করতে চায় তাদের সেই ব্যবস্থা করে দেওয়া।’
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘খামারে উৎপাদিত দুধ সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সংরক্ষণের জন্য মিল্কভিটাকে মন্ত্রণালয় থেকে ইতিমধ্যে অনুরোধ জানানো হয়েছে। সংরক্ষণসহ ভোক্তার কাছে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দুধ পৌঁছে দেওয়ার কাজে প্রাণ, আড়ং, আকিজসহ বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে আমি সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। পাশাপাশি মিষ্টির দোকানসমূহ খোলা রাখার ব্যবস্থা গ্রহণে দোকান মালিক সমিতির সহযোগিতা কামনা করছি।’
ক্ষুদ্র খামারি উজ্জল হোসেন বলেন, ‘আমার খামারে পাঁচটি গরু আছে। সরকারি উদ্যোগে যদি এই মুহূর্তে গো-খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় তাহলে অন্তত আমাদের মতো ক্ষুদ্র খামারিরা সঙ্ককটকালীন সময় টিকে থাকতে পারবে। ভবিষ্যতে প্রণোদনা দিলেও তা দিয়ে নতুন করে আবার খামার শুরু করা কঠিন কাজ। অন্যদিকে খামার শুরু করলেও সঠিক সময় দুধের কাঙ্খিত উৎপাদন সম্ভব হবে না।’
এ বিষয়ে ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো এমরান হোসেন একমত পোষণ করে বলেন, ‘যদি গো-খাবার সংগ্রহের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা করা যায়। তাহলেও কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। মূলত আমাদের সঙ্কট দুই দিকে। এক দিকে দুধে বিক্রি করতে পারছি না, অন্যদিকে গো-খাবারে দাম বেড়ে গেছে।’
দুধ বিক্রি করতে না পেরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে গরুর খামার থেকে প্রতিদিন এলাকার বিভিন্ন জায়গায় বিনামূল্যে দুধ দিচ্ছেন ইমরান হোসেনে নামে এক খামারি। তিনি জানান, ওই খামারে প্রতিদিন ১ হাজার ৯৫০ কেজি দুধ উৎপাদন হয়।
প্রায় একই একই সমস্যা কথা জানিয়েছেন কুষ্টিয়া জেলা ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশন ও
বরিশাল বিভাগীয় ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনসহ খামার সংশ্লিষ্ট সংগঠন।
তাদের তথ্যানুসারে, করোনাভাইরাস জনিত সমস্যার আগেও পাইকারি হিসেবে প্রতি লিটার দুধ ৪৫ থেকে ৫০ টাকা বিক্রি হলেও এখন খুচরা বাজারে ২০ থেকে ৩০ টাকা লিটার দরে বিক্রি হচ্ছে। তাও মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে জোর করে দিতে হচ্ছে। এরপরও বিপুল পরিমাণ দুধ অবিক্রীত রয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে মিষ্টিজাতীয় দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা দুধ বিক্রিতে বেশ অসুবিধায় পড়েছেন।
সংবাদসুত্রঃরাইজিংবিডি