ষোল বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে অসংখ্যবার দল থেকে ছিটকে গেছেন, আবার দোর্দণ্ড প্রতাপে ফিরে এসেছেন। অসংখ্য প্রত্যাবর্তন রাজকীয় ঢঙে রাঙিয়েছেন; সবার আদরের ‘মহারাজা’ খ্যাত সৌরভ গাঙ্গুলি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর শেষ বারের মতো ফেরা নিয়ে আজকের লেখা শুরু করি।
শচীন, সৌরভ, দ্রাবিড়, লক্ষণ- এই চার স্তম্ভের জন্য ভারতীয় দলের মন্ত্রমুগ্ধ বনে গেছেন গ্রেগ চ্যাপেল! বিশেষ করে সৌরভের অধিনায়কত্বে বিমোহিত এই অজি! ভারতীয় দলের কোচ হওয়ার ইচ্ছা সেখান থেকেই। সেটার প্রকাশও করেছেন ইনিয়ে-বিনিয়ে। চাওয়া সত্য হলো চ্যাপেলের। ভারতের কোচ হয়ে আসলেন সৌরভের চাওয়াতেই।
কিন্তু এসেই অল্পদিনে এই সম্পর্কের টানাপোড়েন লেগে যায়। সৌরভে চ্যাপেলের মুগ্ধতাও বেশীদিন স্থায়ী হয় না। সৌরভের ক্রিকেট দর্শনের সাথে বনিবনা হচ্ছে না বলেই তিক্ততার শুরু। জিম্বাবুয়ে সফরে থাকাকালীন এক মেইলে চ্যাপেল বোর্ডকে সৌরভের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা উল্লেখ করেন। আরো উল্লেখ করেন সৌরভ মানসিক এবং শারীরিক ভাবে ফিট নয় এবং দলের প্রতি তার মনোভাব ঠিক নেই। যে মেইল ফাঁস হওয়ার মাধ্যমে সৌরভ-চ্যাপেল সম্পর্ক তিক্ততার চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এদিকে তখন পারফরম্যান্সে তথৈবচ সময় পার করছিলেন সৌরভ। দুইয়ে মিলিয়ে অধিনায়কত্ব হারালেন। বাদও দেওয়া হলো দলের অন্যতম এই ক্রিকেটারকে।
দলের বাইরে থাকলেন টানা দশ মাস। এদিকে ভারতও দিকপাল হারিয়ে খারাপ সময়ের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। যথারীতি আবার আশ্রয় সৌরভে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তাদের মাটিতে সিরিজ চলছে। সেখানে সৌরভ যাবেন টেস্ট সিরিজের জন্য। আনন্দে আত্মহারা বেহালা হয়ে পুরো কলকাতা! দল থেকে বারবার ‘ছুড়ে ফেলার’ দিনগুলিতে সৌরভের সতেজতার কারিগর হয়েছিলেন এই মানুষগুলিই। আকণ্ঠ সমর্থন দিয়ে গেছেন তাদের প্রিয় মহারাজাকে। একটা প্রস্তুতি ম্যাচে ১৩ চারে ৮৩ রানের ইনিংসে খেলে ফেরার ইঙ্গিত দেন। প্রথম টেস্টে দলে ঢুকলেন নভোজিত সিং সিধুর ইনজুরিতে। প্রথম ইনিংস বিপর্যয়ের মুখে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৫১ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন সৌরভ। দ্বিতীয় ইনিংসেও করেন ২৫ রান। সেই টেস্ট জিতে নেয় ভারত। সতের বছর পর দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে টেস্ট জয়ের স্বাদ পেল ভারত। সৌরভ ফেরেন সৌরভের চিরচেনা রূপেই। বাদ পড়ার একবছর নিজের সাথে নিজে লড়াই চালিয়েছেন। নিজেকে ভেঙেছেন। আবার গড়েছেন। ভাঙা-গড়ার সেই দিনগুলির সাক্ষী করেছেন প্রিয় ইডেনের আলো-বাতাস-পানিকে। প্রতিমুহূর্তে ইডেন দেখেছে বেহালার রাজকীয় ছেলেটার ফেরার চরম তাড়না। শিরা উপশিরায় প্রবাহমান সেই তাড়না সৌরভ উগড়ে দিয়েছিলেন পরিশ্রমে।
টেস্ট-ওয়ানডে মিলিয়ে সেঞ্চুরি করেছেন আটত্রিশটি। কত ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলেছেন। দুর্দান্ত ইনিংসে দলের হাল ধরেছেন, সেও না জানি কতবার! কিন্তু ৫১ রানের ইনিংসটাই সৌরভের কাছে অমূল্য মনে হয় এখনো। পৃথিবীর যে প্রান্তেই খেলেন সেটা লর্ডস কিংবা জোহানেসবার্গ সৌরভের হাতে ব্যাট মানে; নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেওয়া সেই মানুষগুলোর কল্পলোকে কিংবা আলপনায় প্রিয় তারকার সবচেয়ে সুন্দর এক চিত্র তৈরি হওয়া। তারা দেখেন হাজার হাজার মাইলে দূরে বেহালার ছেলেটা ব্যাট করছে এখন। শান্ত কিন্তু রাগী। স্থির কিন্তু তেজী। সমাহৃত কিন্তু ছটফটে। সৌরভ প্রেমে মজে থাকা ছেলেটা হয়তো মাকে বলছে – মা দেখ……দেখ! কি সুন্দর দেখাচ্ছে আমাদের ছেলেটাকে। বিদ্যুৎ বেগে আরেকটা বল ছুটে যাচ্ছে বাউন্ডারির বাইরে। গোটা ভারতবর্ষ উঠে দাঁড়িয়েছে এত রাতে, বলটা কোথায় গেল একটু দেখবে বলে! ধর্ম ভুলে, জাতি ভুলে একসঙ্গে। খোকা মাকে বলে, প্রাণের দাদা চিরকাল রইবে প্রাণে।
দ্বিতীয় টেস্টে ব্যাট হাসে না সৌরভের। ভারত ম্যাচটা হারে বিশাল ব্যবধানে। পরদিন ৩১ ডিসেম্বর। কেপটাউনে রং আর আলোর জোয়ার। নতুন বছরের শুভেচ্ছায় উৎসবের অন্য আমেজ। ভারতীয় দল নতুন বছরের উদযাপনে থাকলেন ওয়াটার ফ্রন্টে। কেপটাউনের টেবল মাউন্টেনকে পেছনে রেখে জল আর পাহাড়ের এক অপূর্ব নৈসর্গিক চিত্র সেখানে। সৌরভ সেদিনও যেন বড্ড একা। বন্ধু বলতে শচীন পুত্র অর্জুন। তাকে সঙ্গে নিয়ে টেবল মাউন্টেনের দিকে তাকিয়ে থাকা। আগুনের পরশমনিকে ছুঁয়ে নেওয়া ওই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। তৃতীয় টেস্টে খেলেন যথাক্রমে ৬৬ এবং ৪৬ রানের দুটি ইনিংস। সিরিজে ভারতের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তালিকায় সৌরভের নামটা দেখে একদমই আশ্চর্য হবেন না!
দীর্ঘ চৌদ্দ মাস পর ফিরলেন ওয়ানডে দলেও। নাগপুরে সে ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলেন ৯৮ রানের ম্যাচজয়ী ইনিংস। এরপর এলো শ্রীলঙ্কা। সৌরভ এবার ম্যান অফ দ্য সিরিজ হলেন। দীর্ঘ ছয় বছর পর এই পুরস্কার জিতলেন সৌরভ। মাথা ‘নিচু’ হয়ে গিয়েছিল গুরু গ্রেগ চ্যাপেলের। এক বাঙ্গালির জেদ আর অধ্যাবসায়ের কাছে হার মানলেন অজি কোচ চ্যাপেল।
খারাপ দিনগুলিতে সৌরভের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল প্রিয় ইডেন। ক্যারিয়ারের এত বছর কাটিয়ে সেখানেই কিনা একবারও দু’হাত উঁচিয়ে সেঞ্চুরি উদযাপন করা হয়নি! দাদার চিরচেনা দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়নি ঘরের মানুষদেরই! এতো ইডেনের আক্ষেপ। বেহালার মহারাজার আক্ষেপ। আক্ষেপ গুছাতে সৌরভের চেয়ে ভালো আর কেই-বা পারেন! অবশেষে ৯৮তম টেস্টে ইডেন সাক্ষী হলো দাদার সেঞ্চুরি দৃশ্যের। প্রায় বারো বছরের অপেক্ষা ঘুচলো।
সেই ১৯৯৯ বিশ্বকাপেই ওয়ানডের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির কাছাকাছি চলে যাওয়া। অথচ সেই সৌরভের কিনা টেস্টেই নেই কোনো ডাবল সেঞ্চুরি! বেঙ্গালুরুতে ৯৯তম টেস্টে করে ফেললেন সেটাও। থামলেন ২৩৯ রানে। রানের হিসেবে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তখন পঞ্চম সর্বোচ্চ। পেছনে ফেলেছেন সুনীল গাভাস্কার এবং ভিনু মানকাডকে। ক্যারিয়ারের পুলকিত সময়টাও কাটিয়েছেন এই সময়ে। ১৯৮৬ সালের পর প্রথমবার ইংল্যান্ডের মাটিতে সিরিজ জয়ে রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ৪৯.৮০ গড়ে করেছিলেন ২৪৯ রান। একই বছর রানের ফোয়ারা ছুটিয়ে ওয়ানডে (৪৪.২৮ গড়ে ১২৪০ রান) এবং টেস্ট (৬১.৪৪ গড়ে ১১০৬ রান) দুই ফরম্যাটেই হাজার রানের কৌটা অতিক্রম করেছিলেন ‘ফুরিয়ে’ যাওয়া সৌরভ।
ভারতীয় দলে সৌরভের অগ্রগ্রামীতা ছিল এমনই কণ্টকাকীর্ণ। বর্ষিকাপঞ্জের পাতা উল্টোতে উল্টোতে ফেরা যাক ১৯৮৯-৯০ সিজনের রঞ্জি ট্রফিতে। সৌরভের ক্যারিয়ারের শুরুর সময়টায়। ৫৬তম রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে ইডেন গার্ডেনে বেঙ্গল মুখোমুখি হবে দিল্লির। বেঙ্গল দলে ডাক পেলেন সৌরভ। তাকে নিতে বাদ দেওয়া হয়েছে নিয়মিত পারফরমার স্নেহাশিস গাঙ্গুলিকে। স্নেহাশিস সেবারই প্রথম বাদ পড়লেন। পারফরম্যান্স নয় বরং সৌরভকে জায়গা ছেড়ে দিতে। তাও একদম ফাইনাল ম্যাচে! ঘটা করে স্নেহাশিস গাঙ্গুলির এতো ব্যাখা দিচ্ছি কেন? কারণ আছে বৈকি। স্নেহাশিস যে সৌরভেরই অগ্রজ ভাই! যার হাত ধরে সৌরভের ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয়েছিল। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সেটিই সৌরভের প্রথম ম্যাচ। মনোজ প্রভাকরের বলে আউট হওয়ার আগে পাঁচ চারে ২২ রান করেন সৌরভ। অভিষেকেই রঞ্জি ট্রফি জয়কে এখনো জীবনের সেরা মুহূর্ত মনে হয় সৌরভের। পরের কয়েক সিজনে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে রানের ফল্গুধারা বইয়ে ডাক পান ভারতীয় দলে। অভিষেক ওয়ানডেতে তিন রান করতেই বাদ পড়ে যান দল থেকে। এক-দুই ম্যাচ কিংবা সিরিজের জন্য নয়। পাক্কা চার বছর নীল জার্সিটা গায়ে তোলার সুযোগ হয়নি!
সৌরভ ফেরেন। সবার আদরের মহারাজার বেশেই ফেরেন। চার বছর পর ফিরে ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসে সেঞ্চুরিতে রাঙিয়ে তোলেন অভিষেক টেস্ট। হ্যারি গ্রাহাম এবং জন হ্যাম্পশায়ারের পর তখনকার তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেকে লর্ডসে সেঞ্চুরি করেন সৌরভ। কিন্তু ১৩১ রানের ইনিংসটি অভিষেকে লর্ডসের সর্বোচ্চ ইনিংস হয়েই টিকে রয়েছে। পরের ম্যাচে ট্রেন্টব্রিজে আবার সেঞ্চুরি করেন সৌরভ। মেঘলা আবহাওয়ার নিচে খেলেন ১৩৬ রানের ইনিংস। যার ফলে প্রথম দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি করা তৃতীয় ক্রিকেটার হয়ে যান সৌরভ। যেন বলতে চাইলেন চার বছর আমায় বসিয়ে রেখে ভুল করেছো! সর্বজনীন দাদা হয়ে ওঠার সেই শুরু।
ক্রিকেট স্বর্ণযুগের নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে দৃশ্যপটে হাজির হয় শচীন-সৌরভ জুটির রোমাঞ্চ। সেসব গল্প শুনতে শুনতেই তো ক্রিকেটের সাগরে ডুবেছে পরবর্তী প্রজন্ম। সেই শচীন-সৌরভ জুটির ক্যানভাসে লেখা হয়েছে ১২,৪০০ রানের গল্পগাঁথা। আটত্রিশটি সেঞ্চুরি জুটি সেসব গল্পের একেকটা অধ্যায়। পঁয়তাল্লিশটি অর্ধশত রানের জুটি যেন অসমাপ্ত আত্মজীবনী!
ক্রিকেট নব্বই দশককে স্মৃতিচারণার অতীত করে পা রাখে একুশ শতকে। এমন সময় ফিক্সিংয়ের অভিযোগে টালমাটাল ভারতীয় ক্রিকেটের নৌকা। যার নেপথ্যে সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন। অধিনায়কত্বে হতাশই করে চলেছেন শচীন টেন্ডুলকার। সেবার অস্ট্রেলিয়া সফরে টেস্টে ৩-০ তে হেরেছে দল। ট্রাই সিরিজ মিলিয়ে চৌদ্দ ম্যাচের মাত্র একটিতে জয়। শচীন প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন অধিনায়কত্ব ছাড়ার। প্রিয় সতীর্থ সৌরভকে সেই সফরেই বলে রেখেছিলেন ‘প্রস্তুত থেকো’। ভারতের পরবর্তী অধিনায়ক তুমিই হচ্ছো। সৌরভের যেন বিশ্বাসই হয় না! ভারতবর্ষের পূর্ব ক্রিকেটীয় ইতিহাস সৌরভের বিশ্বাসে বাঁধা দেয়! শচীন বললেন আমাকে তো জিজ্ঞেস করা হবে, আমি তোমার নাম-ই বলবো। এই মুহূর্তে তুমিই সঠিক ব্যক্তি।
সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ হারের পর অধিনায়কত্ব ছাড়েন শচীন। গুরু দায়িত্ব এসে বর্তায় সৌরভের কাঁধে। প্রথম এসাইনমেন্টেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জেতান ভারতকে। এমন সময়ে আবার ফিক্সিংয়ের কথা কানে আসে সৌরভের। এবার শুনতে পান প্রোটিয়া অধিনায়ক এবং ক্রিকেটার হ্যান্সি ক্রনিয়ের ফিক্সিংয়ে জড়ানোর কাহিনী। এমনই একটা গুমোট পরিস্থিতিতে অধিনায়ক সৌরভের পথচলা শুরু হয়েছিল। জাত লড়াকু সৌরভ ভড়কে যাননি। অধিনায়কত্ব দিয়েই ভারতীয় ক্রিকেটের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছিলেন সৌরভ। দেশের বাইরে সাদামাটা দলটাকে জিততে শেখালেন। ঘরের বাইরে ২৮ ম্যাচে ১১ টেস্ট জয়ের সঙ্গে সাত ড্র এবং ১১০ ওয়ানডেতে ৫৮ জয় সৌরভের ভয়ডরহীন অধিনায়কত্বের জয়গানই গায়। দেশে এবং দেশের বাইরে জয়ের মানসিকতায় ক্ষুধার্ত বানিয়ে ‘টিম ইন্ডিয়ার’ প্রধান রূপকার যে সৌরভ গাঙ্গুলি। টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ের আট নাম্বারে থাকা দলটাকে তুলে আনেন র্যাঙ্কিংয়ের দুই নাম্বারে।
সেবার ভারত সফরে আসে স্টিভ ওয়াহর অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়া। প্রতিপক্ষকে যারা শরীরি ভাষায় ছিড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলতে সিদ্ধহস্ত। মাইন্ড গেমসে বিশ্বজুড়ে যাদের জুড়ি মেলা ভার। অজিদের সেই ঔষুধ এবার অজিদের সাথেই ব্যবহার করলেন সৌরভ। তিন টেস্ট আর পাঁচ ওয়ানডেতে অন্তত চারবার দেরীতে টসে করতে আসেন সৌরভ। অপেক্ষা করিয়ে রেখেছিলেন স্টিভ ওয়াহকে! ভাবা যায়! তখনকার সময়ে যেটা ভারতীয় ক্রিকেটে অকল্পনীয়! প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়াই করার মন্ত্র পাঠ করিয়ে দিয়েছিলেন সতীর্থদের মগজে। কাঁধে হাত রেখে অভয় দিয়েছিলেন দল থেকে ছিটকে না ফেলার।
সেই দীক্ষায় টেস্ট সিরিজে অস্ট্রেলিয়াকে ২-১ ব্যবধানে হারায় ভারত। অজিদের ষোল টেস্টের অপরাজেয় জয়যাত্রা থামিয়েছিল সৌরভের ভারত। সেই সফরের কলকাতা টেস্ট আজীবন বিখ্যাত হয়ে থাকবে ক্রিকেট রূপকথার অংশ হিসেবে। সবার মনে গেঁথে আছে লক্ষন-দ্রাবিড় জুটির কথা। তবুও দ্বিতীয় ইনিংসে ভালোই জবাব দিচ্ছিল অজিরা! ৩৮৪ রানের জবাবে ১৬৬ রানে ৬ উইকেট। অজিদের আশার আলো হয়ে টিকে রয়েছেন ম্যাথু হেইডেন। নতুন ব্যাটসম্যান গিলক্রিস্ট। এমন সময় সৌরভ বল তুলে দিলেন কিনা শচীনের হাতে। টপাটপ তিন উইকেট (গিলক্রিস্ট, হেইডেন, শেন ওয়ার্ন) তুলে নিয়ে অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দিতে ভুল করেন না শচীনও। আস্থা আর প্রতিদানের মিলনে অজিদের আশার শেষ প্রদীপটুকুও যেন এক ঝটকায় নিভে যায়।
সিরিজ শুরুর পূর্বে হরভজন সিংকে নিয়ে দোটানায় নির্বাচকরা। এদিকে ফর্মও হরভাজনের পক্ষে কথা বলছে না। কিন্তু একজন জানতেন, তরুণদের এক-দুই ম্যাচ দিয়ে বিচার করা যায় না, সেজন্য ডাল হয়ে দাঁড়ালেন তিনি নিজেই। অনেকটা তাঁর চাওয়া এবং কোচ জন রাইটের ইচ্ছাতে সেই সিরিজে টিকে যান হরভাজন। বাকি ইতিহাসটা তো সবারই জানা! স্পিন ভেলকিতে মুড়ি মুড়কির মতো অজিদের শিকার বানিয়েছিলেন ভাজ্জি। সেই ভাজ্জি আজও বলতে দ্বিধা করেন না ‘দাদার জন্যেই আমার ক্যারিয়ারের এতটুকু অর্জন!’
মনে পড়ে ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের ফাইনাল ম্যাচটার কথা? লর্ডসের বারান্দায় জার্সি খুলে সৌরভের সেই বুনো উদযাপন? কোথা থেকে এসেছিল সৌরভের সেই সঞ্জীবনী শক্তির উপাসনা? যেটা সৌরভকে তাঁতিয়ে দিয়েছিল। গল্পের পেছনে যে গল্প থাকে, সে গল্পে – মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়েতে ইংলিশ ক্রিকেটার অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ ইংলিশদের জয়ের পর ঠিক এমনই উদযাপন করেছিলেন। সবাই ভুলে গেলেও সৌরভ ভুলেন না! সেই উদযাপন সৌরভ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ইংলিশদের মাটিতেই। স্লেজিংয়ে বদলা স্লেজিংয়ে, লড়াইয়ের মন্ত্র, জেতার তীব্র তাড়না এসব দিয়েই তো সৌরভ পাল্টে দিয়েছিলেন দলের চিন্তার মানসপট। একটু ঝুঁকি নিয়ে বললে, এসবই যে সৌরভকে ভারতীয় ক্রিকেটের অধিনায়কদের অধিনায়ক বানিয়েছে।
আপনি দেখেন ৮০ কি.মি এর বলটা ডাউন দ্য উইকেটে এসে মিড অন কিংবা মিড উইকেটের উপর দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে গ্যালারীতে আছড়ে পড়তে। গতি বেড়ে ১৪০-১৪৫ কি.মি হলে আপনি দেখেন বলটা গ্যালারীতে আছড়ে পড়ছে এক্সট্রা কাভার এবং মিড-অফের উপর দিয়ে। দুর্দান্ত হ্যান্ড আই কো-অর্ডিনেশনে ব্যাটসম্যানের কাছে বাঁহাতি স্পিনারের নাজেহাল অবস্থা দেখলে আপনার সৌরভকেই মনে পড়ে! পাঁচজন ফিল্ডারের মাঝখান দিয়ে কাভার ড্রাইভে প্রবল গতিতে বলটা সীমানা দড়িতে ঘেষতে দেখে আনমনে আপনি সৌরভকেই খুঁজে বেড়ান। সেই সৌরভ রাহুল দ্রাবিড়ের দৃষ্টিতে ‘অফসাইডের গড’।
অধিনায়ক সৌরভ অনিন্দ্য, তেজোদীপ্ত সুন্দর। মনে রাখার মতো উপজীব্য ভরা একটি নাম। তরুণদের কাঁধে বরাবরই এক বিশ্বস্ত হাত ছিলেন সৌরভ। টেস্টের জন্য ‘অতিরঞ্জিত’ বলে সবাই যখন বাদ দেয়ার ফন্দি আঁটছিলেন। পাঁচে নেমে রানখরায় ভুগতে থাকা সেই ব্যাটসম্যানকে সৌরভ নামিয়ে দিয়েছিলেন ওপেনিংয়ে। সেটাও নিজের প্রিয় ওপেনিং পজিশন ছেড়ে দিয়ে। সেই ছেলেকে লাইসেন্স দিয়েছিলেন ‘ন্যাচারাল’ খেলা খেলার। পরবর্তীতে সেই ছেলেটাই ‘অতিরঞ্জিত’ ব্যাটিংয়ে টেস্টে দুটি ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছেন। সেই ছেলেটা বীরেন্দর শেওয়াগ। আজও শেওয়াগ মনে রেখেছেন দাদার অবদানের কথা। আজও কথার প্রসঙ্গে ধন্যবাদ দিতে ভুলে যান না প্রিয় দাদাকে।
ক্রিকেটের একটু মনোযোগী ছাত্র হলে আপনি এক নিমিষেই বলে দেন অধিনায়ক সৌরভের কীর্তি। দলকে আইসিসি নকআউট ট্রফির (বর্তমান চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি) ফাইনালে তোলা, ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের ট্রফি জয়, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়, ২০০৩ বিশ্বকাপের রানার্সআপ , অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি রিটেইনড, পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জয়। তবুও পরিসংখ্যানের পাতা আপনার মনে উঁকি দিতে চায় কপিল দেবের ভারত হয়ে। মহেন্দ্র সিং ধোনি কিংবা হালের বিরাট কোহলির ভারত হয়ে। আর তখনই ক্রিকেট লিখিয়েদের গুরু নেভিল কার্ডাসের একটা উক্তি ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে উঠে, আর সৌরভের সঙ্গে বাকিদের তুলনা প্রসঙ্গে বলতেই হয় ‘পরিসংখ্যান একটা আস্ত একটা গাধা।’