উন্নয়নমূলক কাজ চলাকালে পথচারীদের নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানের বার্তা দিয়ে কর্তৃপক্ষ সাইনবোর্ডে লিখে দেয়- ‘উন্নয়নমূলক কাজ চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত।’
দেশে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় কিশোর আন্দোলনকারীদের হাতেও ‘রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে’ সংবলিত প্ল্যাকার্ড দেখা গিয়েছিল। বর্তমান বিশ্বের চিত্র দেখে মনে হচ্ছে, প্রকৃতিও যেন বিশ্ববাসীর সামনে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে বলছে- ‘বিশ্ব মেরামতের কাজ চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য আমরা দুঃখিত।’
প্রকৃতির এ সাময়িক অসুবিধটা হল মহামারী ভাইরাস কোভিড-১৯। আর বিশ্বজুড়ে করোনার থাবায় মানুষ মারা যাওয়ার কারণেই যেন প্রকৃতির এ দুঃখপ্রকাশ।
কিন্তু যে প্রকৃতি যুগের পর যুগ তার সন্তান ‘মানবজাতিকে’ পরম মমতায় আগলে রেখেছে, সেই প্রকৃতিই কেন এমন নরহত্যা করতে বাধ্য হল, সেটা আজ উপলব্ধি করার সময় এসেছে। মানুষ অসচেতন হলেও প্রকৃতি কখনোই উদাসীন নয়। প্রকৃতি খুবই দায়িত্বশীল, আইনের অনুশাসক। তাই তো আইনের ব্যত্যয় ঘটালে প্রকৃতিও তার বদলা নিতে ছাড়ে না। করোনার প্রাদুর্ভাব প্রকৃতির প্রতিশোধ; মানুষের অবিমৃশ্যকারিতার ফলমাত্র।
প্রকৃতি বদলা নেবেই না কেন! প্রকৃতির নির্মল বাতাসকে বিষে পরিণত করা, ওজোনস্তরে মুহুর্মুহু তীব্র আঘাত, বনের পশুকে সামনে পেলেই বন্দুকের নল কিংবা লাঠির আঘাতে হত্যা, প্রকৃতির বেঁধে দেয়া খাদ্যাভ্যাসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো, পাহাড়ের চূড়াকে মাথানত করতে বাধ্য করা, বনভূমির নির্জনতায় করাত চালানো, বরফের আচ্ছাদন, মাটির গভীরতা হেন কোনো স্থান নেই, যেখানের মানবের ‘দানবীয়’ পা পড়েনি! প্রকৃতির ভারসাম্যকে আমরা কীভাবে প্রতিনিয়ত গলাটিপে হত্যা করছি, তার জ্বলন্ত উদাহরণ তো জলবায়ু পরিবর্তন।
কিছুদিন আগে পালিত হয়ে গেল বিশ্ব ধরিত্রী দিবস। দিবস পালিত হলেও ধরিত্রী নিয়ে মানুষের মানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তনটা এখনও অধরাই। শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি মানুষ। সমুদ্রের তলদেশে বসবাসকারী প্রাণীদের প্লাস্টিক দূষণে বিলুপ্ত করার হীন প্রতিযোগিতাসহ পরাশক্তিগুলোর দম্ভ, জীবাণু অস্ত্র নিয়ে ভয়ংকর হোলি খেলার ফলাফলই আজ করোনার রূপ ধরে ফিরে এসেছে; এ ব্যাপারে কারও সন্দেহ আছে?
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়োলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের নেকড়ে হত্যার পর একই প্রজাতিকে আবার ফেরানোর প্রচেষ্টার গল্প, চীনের ফোর পেস্টস ক্যাম্পেইনের অধীন চড়ুই পাখি তাড়িয়ে পঙ্গপাল ডেকে আনার সময় তো প্রকৃতি অন্ধ ছিল না। আরও কতভাবে মানুষ প্রকৃতিকে প্রতিনিয়তই ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত ও মুমূর্ষু করার ভয়ংকর খেলায় মেতেছে, তার হিসাব নেই।
এতকিছুর পরও প্রকৃতি বিদ্রোহ করবে না-এ কথা ভাবলে কি মানুষের চরম নির্বুদ্ধিতাই প্রকাশ পায় না? প্রকৃতি যখন মানবজাতিকে ঘরে আবদ্ধ করে রেখেছে, তখন সাগর-নদীতে মাছগুলো ডিম থেকে বাচ্চা ছেড়ে বংশবৃদ্ধিতে মেতে উঠছে। দূষণে দমবন্ধ আচ্ছাদিত নগরে একটু-আধটু মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে সবুজেরা।
এ যেন প্রকৃতির নতুন পৃথিবী গড়ার ডাক। কোভিড-১৯ মানবজাতিকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল জাতি, বর্ণ, ধর্ম, গোত্র, ভূখণ্ড, পতাকা, মানচিত্র, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা এসবের কোনোটিই একে অপরের শত্রু নয়। মানুষের কমন শত্রু হচ্ছে রোগব্যাধি। এটি ধর্ম-কর্ম, জাত-পাত, সাদাকালো এসবের কিছুই চেনে না। করোনাভাইরাস শিখিয়ে দিল প্রকৃতির মানুষকে যতটা না প্রয়োজন, তার চেয়ে প্রকৃতিকে অনেক বেশি প্রয়োজন মানুষেরই।
প্রতিবছর শুধু চীনে প্রায় এক লাখ মানুষ বায়ুদূষণে মারা যায়। হাজারও শিশুকে জন্মের পরপরই বিশুদ্ধ অক্সিজেন দিতে হয়। কিন্তু করোনাকালে নবজাত শিশুর জন্য বাড়তি অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়নি! কারণ, কলকারখানা, মিল, ফ্যাক্টরি, বহু চাকার যান ইত্যাদি বন্ধ থাকায় বাতাসে কার্বন ইমিশন কমে এসেছে। পেট্রল পোড়া গন্ধ নেই, ধোঁয়ায় বিষাক্ত কার্বন নেই।
বাতাসে নেমে এসেছে বিশুদ্ধ সজীবতা। মানুষের বন্ধু হয়ে মানুষের বাঁচার পথ প্রকৃতি নিজেই দেখিয়ে দিয়েছে। জরাগ্রস্ত পৃথিবীকে নতুনভাবে বাঁচিয়ে রাখতেই প্রকৃতির এ আন্দোলন। প্রকৃতির ভাষা যখন মানুষ শুনেও না শোনার ভণিতায় মত্ত, তখন এ যেন মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির নির্মম অভিমান; যে অভিমানের বলি হয়ে প্রকৃতির কিছু সন্তান মারা গেলেও দীর্ঘস্থায়ী করবে ভবিষ্যৎ মানবজাতির পথচলা।