করোনা পরিস্থিতিতে নবজাতকের কিছু সমস্যা ও তার সমাধান
প্রফেসর ডা. বাসনা মুহুরী( শিশু বিশেষজ্ঞ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ)
সমস্যা: বাচ্চা ঘন ঘন পায়খানা করে, মোড়ামুড়ি করে, খাবার পর পর বমি করে, পায়খানার রাস্তা লাল হয়ে গেছে, পায়খানায় পানির পরিমাণ বেশি, কিছু দানা দানা; কোন কোন সময় পায়খানার রং সবুজাভ, কারো সমস্যা ২-৩দিনেও পায়খানা হচ্ছে না, বাচ্চা বুকের দুধ পাচ্ছে না, বেশি কান্না করে, খাবার পর বমি করে, টিকা কিভাবে দেওয়া যাবে?
সমাধান: উপরের সবগুলোই অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক, তবে নবজাতকের মায়েদের সচরাচর জিজ্ঞাস্য সমস্যা। নবজাতক শিশু প্রথম পায়খানা করে কালো- সবুজাভ রং এর যাকে আমরা বলি মিউকোনিয়াম। জন্মের ২৪ ঘন্টার মধ্যেই প্রায় সব শিশুই প্রথম পায়খানা করে ফেলে,তবে ৩৬ ঘণ্টার পরও যদি এপায়খানা না হয় শিশুর মধ্যে কোন অসুবিধা আছে কিনা অবশ্যই দেখতে হবে। ২/৩দিনের পরই পায়খানার রং পরিবর্তন হয়ে ধীরে ধীরে রং হলুদ হয়ে যায়। শিশু যতদিন শুধু বুকের দুধ পান করে (প্রথম ৬ মাস)ততদিন যেমন বারে বারে পাতলা পায়খানা দৈনিক বেশ কয়েকবার(১০-২০….)হতে পারে, একটু একটু বারে বারে হতে পারে, তেমনি সুস্থ বাচ্চারা অনেক সময় ৫-৭দিন পর পরও পায়খানা করতে পারে। পায়খানার রং যেমন হতে পারে হলুদ , হাল্কা হলুদ, হাল্কা সবুজ, তেমনি হতে পারে পাতলা বা পেস্ট এর মতো ঘন। তবে রং যদি সাদাটে হয় , পায়খানার সাথে যদি রক্ত দেখা যায় অবশ্যই তা স্বাভাবিক না, ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। দেখতে হবে বাচ্চা ভালো করে দুধ চুষে খাচ্ছে কিনা, প্রস্রাব পরিমাণমতো হচ্ছে কিনা,ওজন বৃদ্ধি সঠিক ভাবে হচ্ছে কিনা।জন্মেরপ্রথম ৭-১০ দিনে শিশুর জন্মের ওজন কিছুটা কমে যায় ( প্রায় ১০ ভাগ), কিন্তু ২ সপ্তাহ বয়সেই আবার সেটা বেড়ে জন্মের ওজনের সমান হয়ে যায়, এর পর ওজন বাড়তেই থাকে, গড়ে প্রতিদিন প্রথম মাসে ৩০গ্রাম করে ওজন বাড়ে, ৬মাস বয়সের মধ্যেইএজন জন্মের ওজনের দ্বিগুণ হয়।
জন্মের পর প্রায় সব বাচ্চাই ২৪ ঘন্টার মধ্যেই প্রস্রাব করে , প্রথম কয়েক দিন প্রস্রাবের পরিমাণ এবং মাত্রা কম থাকে ,যা ৩/৪দিনের পর বাড়তে থাকে ।
কোন শিশু যদি শুধু মায়ের দুধ খেয়ে প্রতিদিন (২৪ ঘন্টায়) ৬-৮ বার বা তার অধিকার প্রস্রাব করে বুঝতে হবে শিশুর খাবার পরিমাণ সঠিক আছে, যতই কান্না করুক, ঘন ঘন পায়খানা করুক চিন্তিত হবার কোন কারণ নেই। তবে মনে রাখতে হবে- কোন নব জাতক শিশু যদি ভালো করে দুধ চুষে না খাই, যদি নিস্তেজ বা দুর্বল হয়ে যায়,পেটফাঁপা মনে হয়, অতিরিক্ত বমি করে, জন্মের ৩৬ ঘন্টা পরও প্রথম পায়খানা/ প্রস্রাব না করে অতি দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
অনেক শিশু প্রথম কয়েকদিন স্বাভাবিকভাবে পায়খানা করার পর পরবর্তীতে প্রতিদিন তা নাও করতে পারে, অনেক সময় সুস্থ শিশুরাও ৫-৭ দিন পর পর পায়খানা করে।এটা কোন সমস্যা নয়। তবে কিছু রোগের কারণেও এ সমস্যা হতে পারে, তাই পায়খানায় সমস্যার পাশাপাশি যদি বাচ্চা অতিরিক্ত ঘুমায়, প্লেফুল নাথাকে,কম নড়াচড়া করে, কম কান্নাকাটি করে, পেট ফুলে যাচ্ছে মনে হয়, অতিরিক্ত বমি করে,তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। মোড়ামুড়ি কোন সমস্যা নয়,সঠিকভাবে , সঠিক পদ্ধতিতে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। সুতরাং উদ্বিগ্ন না হয়ে জেনে রাখা ভালো-
*নবজাতক হলো জন্ম থেকে প্রথম ২৮ দিন বা ৪ সপ্তাহ। *নবজাতকের স্বাভাবিক ওজন ২৫০০গ্রাম – ৩৯৯৯গ্রাম।
*জন্মের পর ওজন কমে যায় ৭-১০% ,জন্মের ৭-১০ দিনের মধ্যে, জন্মের ২ সপ্তাহে জন্মের ওজন ফিরে আসে।এর পর প্রতিদিন গড়ে ৩০ গ্রাম করে ওজন বাড়ে প্রথম মাসে। *৬ মাসে বাচ্চার ওজন হয় জন্মের ওজনের দ্বিগুণ। *নবজাতকের খাবার শুধু বুকের দুধ, অন্যকিছু নয়, ৬মাস বয়স পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ এক ফোঁটা পানিও না। *শিশু দৈনিক ৮-১২বার দুধ খাই, তবে যখন খেতে চাই তখনই দেওয়া যাবে। সঠিক পদ্ধতিতে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে, খাওয়ানার পর কিছুক্ষণ মাথার দিক একটু উঁচু করে রাখলে ভালো, এতে বমি যেমন কম হয়, তেমনি অনেক সময় পেটের গ্যাস ও ঢেঁকুরের সাথে বেরিয়ে যায়। *অন্যকোন অসুবিধা না থাকলে, বারে বারে একটু একটু পায়খানা অথবা কয়েকদিন পর পর পায়খানাকে উদ্বিগ্ন হবার দরকার নেই। *বারে বারে পায়খানার ফলে মলদ্বার লাল হয়ে যেতে পারে, আলতো করে মুছে ওখানে রেস্ ক্রিম লাগাতে পারেন (D-Rush, Soft-T, Q-Rush ইত্যাদি)। *কয়েকদিন পায়খানা না হলে, শিশু যদি বেশী অস্বস্তিবোধ করে মনে হয়, Glycerine Suppository (1.15) মলদ্বারে ঢুকিয়ে পায়খানা করাতে পারেন, তবে প্রায়শই প্রয়োজন হয় না, শিশুর মধ্যে এ সমস্যার অন্য কোন কারণ না থাকলে অনেক শিশু ৫-১০দিন পর পরও পায়খানা নিজ থেকেই করে। *নবজাতক শিশুরা একটু আটটু বমি খাবার পর পর করতেই পারে, খেয়াল রাখতে হবে বমি যেন ফুস ফুসে না যায়,সে জন্যশিশুকে একটু মাথার দিকটা নিচু করে বাম কাত করে দিলেই ভালো। *অতিরিক্ত বমি হলে, বমির রং সবুজ/ হলুদ হলে পস্রাবের পরিমান কমে গেলে,সাথে অন্য কোন সমস্যা দেখা গেলে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। *জন্মের প্রথম তিন দিন কোন গোসল নয়, নাভি না পরা পর্যন্ত হাল্কা কুসুম গরম পানি দিয়ে শরীর মুছে দেওয়া যেতে পারে সুস্থ শিশুকে, এর পর আবহাওয়া ও তাপমাত্রা বুঝে শিশু গোসল দেওয়া যেতে পারে, তবে গোসলের পর পরই দ্রুত পরিষ্কার নরমকাপুর দিয়ে সারা শরীর মুছে নিতে হবে। * নবজাতকের শরীরে কোন তৈল না লাগানো ভালো। *মাথার চুল দেরী করে কাটাই ভালো, তবে যাতে ঘেমে অপরিষ্কার না হয়।কাটার সময় বেশি পানি দেওয়া যাবে না যাতে ঠাণ্ডা না লাগে । *শিশুর টিকা- বিসিজ এবং অন্যান্য সরকারি টিকা, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী চালিয়ে যেতে হবে করোনা পরিস্থিতিতেও। আমার মতামত- বিসিজি এখন দিতে না পারলেও দেড় মাসবয়সে অন্য টিকার সাথেও দেওয়া যাবে, যদি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে টিকা দেওয়া যায় দিতে পারেন, সরকারি টিকাদান কর্মসূচি চলমান আছে, অন্যতায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সব টিকাই নিয়ম অনুযায়ী সকল শিশুকে সরকারিভাবে দেওয়া যাবে। সরকারি কোন ভেকসিন যেন বাদ না পরে প্রতিটি অভিভাবক সে দিকে খেয়াল রাখবেন,এখন দিতে নাপারলেও পরবর্তীতে সবগুলো দিয়ে দেবেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।বিশেষ করে হামের টিকা (এমআর-৯মাস এবং ১৫ মাস বয়সে)। ঘরে থাকুন, আপনার সন্তানের সঠিক যত্ন নিন, সুস্থ থাকুন সকলেই।