জীবন বাজি রেখে স্বেচ্ছাশ্রমে বিনা পারিশ্রমিকে ঝাপিয়ে পড়েছেন করোনা যুদ্ধে
রাসু। পুরো নাম হাসনাত জামান রাসু। একজন করোনা যোদ্ধার নাম। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলার মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছিলো যুদ্ধে। রাসুও তেমনি জীবন বাজি রেখে স্বেচ্ছাশ্রমে বিনা পারিশ্রমিকে ঝাপিয়ে পড়েছেন করোনা যুদ্ধে। দেশের একঝাক দক্ষ রাসুর খুব বেশী প্রয়োজন। কারণ সম্মুখে থেকে করোনা যুদ্ধের প্রাথমিক কাজটা করছেন রাসুদের মত অসংখ্য মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট।
বিশ্বে যখন করোনার মহামারী তখন তা মোকাবেলায় করোনাযোদ্ধা হয়ে সবচেয়ে বেশি সাহসী ভুমিকা রাখছেন ডাক্তার ও নার্সরা। তাদের পাশাপাশি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন মেডিকেল টেকনোলজিষ্টরা। তাদেরই মধ্যে অন্যতম ফরিদপুরের রাসু। সপ্রোনোদিত হয়ে বিনা পারিশ্রমিকে তিনি কাজ করে চলেছেন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ এর “মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ”করোনা পিসিআর ল্যাবে। ঝুঁকি আছে জেনেও এই কাজে সহায়তা করার জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে টেকনোলজিস্ট হিসাবে যোগদান করেন রাসু। শুধু রাসু নয় তার মতো মোট ৮ যুবক করোনা ইউনিটে কাজ করে যাচ্ছেন।
করোনা উপসর্গের শুরুতেই রোগীরা হাসপাতালে যাচ্ছেন পরীক্ষা করাতে এবং সেই করোনা রোগীকে পরীক্ষা করছেন এইসব মেডিকেল টেকনোলজিষ্টরা। নমূনা সংগ্রহ ও প্রস্তুতও করছেন এসব টেকলোলজিষ্টরা।
রাসু পেশায় একজন ব্যাংকার। সাউথ ইষ্ট ব্যাংক প্রিন্সিপাল শাখায় চাকুরী করেন সে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায়ী শিক্ষায় এমবিএ পড়াশুনা চলছে তার। এর আগে ২০১২ সালে সে ফরিদপুরে দি স্টেট মেডিকেল ফ্যাকালটি অব বাংলাদেশ থেকে চারবছর মেয়াদী ডিপ্লোমা মেডিকেল ল্যাবরেটরী টেকনোলজিষ্ট (ল্যাব) করেন।
রাসুর বাবা মোঃ আব্দুল জলিল মোল্লা কাজ করেন ফরিদপুরের ডা. জাহেদ মেমোরিয়াল শিশু হাসপাতালের সুপারভাইজার হিসেবে। মা হাসিনা বেগম একই হাসপাতালে চাকুরী করেন। বাড়ি ফরিদপুর সদরের মুরারীদহ গ্রামে। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় রাসু। মেজ ভাই হামিদুর রহমান টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার, ছোট ভাই শরীফুল ইসলাম রাহুল নবম শ্রেণীতে পড়ে।
রাসুর ছোট বেলা থেকেই ইচ্ছে ছিলো ডাক্তার হওয়ার কিন্ত সেটাও হয়ে ওঠেনি। সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করতে পারেনি। বেসরকারী মেডিকেল কলেজে পড়ানোর মত আর্থিক অবস্তা ছিলো না তার বাবার। কিন্ত দমে থাকেনি রাসু। দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মত সে লেগে গেল মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট ৪ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা কোর্সে। এই কোর্স শেষ করতে পারলে অন্তত ডাক্তারদের পাশে থেকে মানুষের সেবা করতে পারবে রাসু। সফল ভাবে মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট কোর্স শেষ করে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজেই তিনি ইন্টার্ণশীপ সম্পন্ন করেছিলেন। বিয়ে করেছেন ফারজানা ফেরদৌসকে, সেও একজন ফার্মাসিস্ট।
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে একটানা ৭ দিন কাজ শেষ করেছেন তিনি। এখন আছেন হোম কোয়ারেন্টাইনে। কোয়ারেন্টাইনে থাকার কারণেই কথা হয় মুঠো ফোনে। তিনি জানান, ঢাকা থেকে ফরিদপুরে এসে বাড়িতেই ছিলাম। খবর পেলাম ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে লোকবল সংকটের কথা। সময় অপচয় না করে ফরিদপুর সিভিল সার্জন অফিসে খোঁজ নিয়ে ঘটনার সত্যতা জানতে পারলাম। যেহেতু আমি ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ইন্টার্নশীপ সম্পন্ন করেছি তাই সবাই আমাকে আগে ভাগেই চিনতো। এই সংকটের সময় আমি কাজ করতে চাই জানালে সিভিল সার্জন স্যার আমাকে কাজে লেগে যেতে বলেন।
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে যোগদান করি। এরপর পিসিআর ল্যাবে পরপর ৭ দিন করোনার টেস্টের জন্য নমূনা প্রস্তুত করে দিয়েছি, এখন ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইনে আছি।
জানতে চাইলে রাসু বলেন, অনেক আশা নিয়ে চারবছর মেয়াদী মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেছি। কিন্তু দু:খের বিষয় গত ১১ বছর ধরে এ বিষয়ে সরকারী কোনো নিয়োগ হয় নাই। তাই কোর্স সম্পন্ন করা থাকলেও চাকুরী পাইনি। কিন্ত জাতির এই দু:সময়ে মানবতার স্বার্থে আমি নি:স্বার্থ ভাবে এই কাজটি করছি। আমার আরো একটি অনুরোধ দেশের তরুন সমাজ যারা মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেছেন তারা দেশের এই দু:সময়ে কাজে লেগে পরুন। কারণ লোকবল সংকট হবেই কারণ একজন ৭ দিনের বেশী পিসিআর ল্যাবে কাজ করতে পারবে না এবং ৭ দিন শেষে ১৪ দিন তার কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। কেউ কেউ সংক্রমনের শিকার হতে পারে। তখন ল্যাবে টেকনোলজিষ্ট খুজে পাওয়া যাবে না। সরকারেরও উচিত মেডিকেল টেকনোলজিষ্টদের জরুরী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া।
রাসুর বাবা মোঃ আব্দুল জলিল মোল্লা জানান, “আমার তিন ছেলে। এক ছেলে করোনা যুদ্ধে যাবে এতে আমরা পরিবারের কেউই বাঁধা দেইনি। হাসি মুখে মৃত্যু ঝুকিতে পাঠিয়েছি রাসুকে। দেশ ও দশের কাজে রাসুকে উৎস্বর্গ করেছি আমরা।
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ও বিএমএ ফরিদপুরের সাধারণ সম্পাদক ডা. মো: মাহফজুর রহমান বুলু বলেন, “অদক্ষ কর্মীদের দিয়ে পরীক্ষা করালে যেমন নির্ভুল তথ্য পাওয়া যাবে না, তেমনী রয়েছে ভয়াবহ ঝুঁকি। ভাইরাস ছড়িয়ে যেতে পারে পুরো হাসপাতালে। মেডিকেল টোকনোলজিষ্ট দিয়ে নমূনা সংগ্রহ করা ও পরীক্ষা করানোই হচ্ছে আদর্শিক প্রক্রিয়া। মেডিকেল টেকনোলজিষ্টদের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের যোগ্য সম্মান ও স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। তাদের এই অবদান রয়ে যাচ্ছে পর্দার আড়ালে”।
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ খবিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের যেখানে ১৫ জন টেকনোলজিস্ট দরকার ছিলো সেখানে মাত্র তিন জন টেকনোলজিস্ট দিয়ে কাজ চালাচ্ছিলাম।ফরিদপুর সিভিল সার্জন মহোদয়ের মাধ্যমে এই যুবকদের স্বেচ্ছায় যোগদানের মাধ্যমে আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশী পরিমানে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা করতে পারছি।তিনি আরো বলেন এই যুবকদের আমরা কোনো রকম ভাতা দিতে পারছিনা তার পরেও এরা প্রায় একমাস যাবত নিজেদের খরচে নিরলসভাবে আমাদের কাজে সহায়তা প্রদান করছে, আন্তরিকতার কোনো অভাব দেখছি না। তিনি আরো বলেন, আগামীতে যদি কোনো টেকনোলজিষ্ট নিয়োগ প্রক্রিয়া আসে তাহলে তাদের ব্যাপারে ব্যবস্তা থাকবে আশা করি।
করোনাভাইরাস সনাক্তকরণ পরীক্ষায় সহায়তা করতে রাসুদের এই উদ্যোগ কে সাধুবাদ জানিয়েছেন ফরিদপুরের সর্বোস্তরের জনগন ।