সময়ের পরিক্রমায়, ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাতে উল্টাতে আরবি শাবান মাসের পরে এসে গেল রমজান মাস। ইসলামের পাঁচটি রোকনের মধ্যে রোজা তৃতীয় মাহে রমজান মাস একটি মোবারকময় মাস।
প্রতি বছর রহমত, মাগফিরাত ও নাযাতের বার্তা নিয়ে আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দার নিকট মাহে রমজান মাস উপস্থিত হয়। আলাহর সন্তুষ্টি অর্জনে রমজান মাসে ২৯ থেকে ৩০ দিন রোযা রাখতে হয়। পবিত্র মাহে রমজান আল্লাহর সাথে বান্দার একাত্মতা ও প্রেম বিনিময়ের সর্বোত্তম সময়। আসমানী কিতাব সমূহের সহিত রমজান মাসের বিশেষ সমন্ধ আছে। কারণ, প্রায় সমস্ত আসমানী কিতাবই মোবারকময় এ মাসে নাযিল হয়েছে। তাই, এ মাসের ফজিলত ও মর্যাদা বেড়ে গেছে আরো বহুগুণ। পবিত্র কুরআনুল কারীমের শব্দ হলো রামাদান। আরবি রমজুন শব্দ হতে রমজান শব্দের উৎপত্তি। রমজুন শব্দের অর্থ জ্বালিয়ে দেওয়া বা পুড়িয়ে দেওয়া। সর্বপ্রথম যখন এ মাসের নাম রাখা হয়েছিলো তখন প্রচণ্ড গরম ছিল। এ জন্য লোকেরা এর নাম রেখেছে রমজান অর্থ ঝলসে দেওয়া।
কিন্তু, উলমায়ে কিরাম বলেন, এ মাসকে রমজান এ উদ্দেশ্যে বলা হয় যে, পবিত্র রমজান মাসে আল্লাহ তায়ালা নিজ মেহেরবানীতে মুমিনদের গুনাহসমূহকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেন। মানুষ যেন এক নবজীবন লাভ করে। পবিত্র কুরআনুল কারীমের শব্দ হলো সিয়াম। আমরা সিয়ামকে রোযা বলে থাকি. রোজা (সাওম ও সিয়াম) শব্দটি পবিত্র কুরআনুল কারীমের ১৩ বার ব্যবহৃত হয়েছে।
রমজান মাস ধৈর্যের মাস। আল্লাহর নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে সুবহে সাদিকের প্রারম্ভ (ফরজ) হতে সূর্যাস্ত (মাগরিব) পযর্ন্ত কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির নিয়তসহ বমি, যৌনক্রিয়া ও সর্বপ্রকার পানাহার থেকে বিরত থাকাকে সিয়াম বা রোযা বলে। প্রত্যেক সুস্থ নর নারীর উপর রোযা ফরজ। রোযা একজন মুসলিম ব্যক্তির উপর সর্বোত্তম ইবাদত। কিন্তু, রোযা অন্য সব ইবাদতের মতো নয়। এটা আল্লাহ ও বান্দার গোপনীয় ব্যাপার। প্রকৃত মুমিন মুসলমান ব্যক্তি একিন ও এখলাস সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় একনিষ্ঠ ভাবে ধৈর্যরে সাথে রোযা পালনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে।
ধৈর্য্যের সওয়াব হলো বেহেশত। পাক কুরআনে আল্লাহ পাক বলেছেন যে, ‘আমি তোমাদিগকে ভয়-ভীতিও ক্ষুধা তৃষ্ণা দ্বারা পরীক্ষা করিব এবং, আমি সবরকারিগণের সঙ্গে আছি।’
হযরত আদম (আঃ) বলেছেন যে, ‘রোযা সবরের অর্ধেক, আর সবর ঈমানের অর্ধেক। আরবিতে রোযাকে সওম বলে। বিরত থাকা (মন্দ কাজ ও লোভ হতে)। রোজা মুসলমানের জন্য একটি কঠোর সাধনা। এটা সহানুভূতির মাস। এটা সেই মাস, যে মাসে মুমিন বান্দার রিযিক বাড়িয়ে দেওয়া হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘রোযা শুধু আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দেব।’
(মুমিন-১৫৫১) রোজা জাহান্নাম থেকে বাঁচার ঢাল। রমাদান মাসে আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ নিয়ামত কুরআন এসেছে। সুতরাং, রোজা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উৎকৃষ্ট পথ।
রমজান মাস সংযমের মাস। শুধুমাত্র, ব্যক্তি নিয়তসহ বমি, যৌনক্রিয়া ও সর্বপ্রকার পানাহার থেকে বিরত থাকাকে সিয়াম বা রোযা হবে না। রোযার মধ্যে হালাল বস্তু হতে পরহেজ (বর্জন) করার ফলে হারাম বস্তু পরিত্যাগ করা এবং, আল্লাহর আদেশ নিষেধ পালন করা সহজ হয়। ব্যক্তি মিথ্যা বলা, গীবত করা, চোগলখুরী, মিথ্যা কছম করা, পরনারীর প্রতি কুদৃষ্টি দেওয়া থেকে বিরত থাকা বা নিজেকে সংযত রাখা।
হযরত আদম (আঃ) বলিয়াছেন, ‘যে রোযাদার মিথ্যা কথা ও অসৎ কাজ ছাড়িতে না পারে তাহার রোযায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নাই।’
হযরত আলী (আঃ) বলিয়াছেন, ‘যে রোযায় অনর্থক কাজ ও কথা হতে নিবৃতি নাই ও সংযম নাই, সে রোযার কোনো ফায়দা (লাভ) নাই।’
একদিকে উপবাস অন্যদিকে পাপ কাজ ও সংযমহীন জীবন যাপন। রমজান মাস সংযম মানে প্রতিটি জায়গায় সংযমের কথা বলা হয়েছে। আচার আচরণ, খাদ্যভাস ও মানব চরিত্র গঠনের কথা বলা হয়েছে।
রমজানের ত্রিশ দিনে ত্রিশ রকরমর ফজিলত রয়েছে। রোযা শুধু মাত্র আত্মার উৎকর্ষ সাধন করে না মানবদেহের উপর প্রচুর প্রভাব প্রতিফলিত হয়। এই ত্রিশ দিন আবার তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম দশ দিন রহমতের, দ্বিতীয় দশ দিন মাগফিরাতের বা গোনাহ মোচনের এবং শেষের দশদিন নাজাতের বা মুক্তির প্রার্থনার। বছরের এই মাসটি অন্য আর সব মাস হতে বেশি সওয়াবের এবং নেকিও হাজার গুণ বেশি।
আমরা আল্লাহকে ভয় পাই এবং ইসলামের শরীয়তের দেখানো পথের মাধ্যমে যথযথভাবে রোযা পালন করি। রোযা শুধু মাত্র আত্মার উৎকর্ষ সাধন করে না মানবদেহের উপর প্রচুর প্রভাব প্রতিফলিত হয়।
এ বছর অন্য বছরের মতো না হওয়ায়, লক্ষ লক্ষ মানুষ করোনাভাইরাসের মতো প্রাণঘাতী মহামারীর কারণে গৃহবন্দী হয়ে সময় পার করছেন। তাই আসুন আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় রমজান মাসে বেশি করে ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং পরিশুদ্ধ মানব চরিএ গঠনে সচেষ্ট হই।
লেখক : হোসনে আরা হ্যাপি, স্থপতি, স্থাপত্য অধিদপ্তর।