বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ভাতের পরই ডালের স্থান। ডাল প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য। এতে প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ। প্রোটিন ছাড়া অত্যধিক লাইসিন, পর্যাপ্ত পরিমাণে শর্করা, চর্বি ও খনিজ রয়েছে। ডাল হিসেবে আমরা মূলত ছোলা, মটর, অড়হর, মাষকলাই, মসুরের বীজকে বুঝে থাকি।
এ দেশে প্রায় সব রকমের ডালই চাষ করা হয়। এসবের মধ্যে মুগডাল অন্যতম। এটি খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি চাষ করেও ভালো দাম পাওয়া সম্ভব। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুগডালের আবাদ হয়ে থাকে। এর মধ্যে পটুয়াখালী, বরগুনা, বরিশাল জেলায় আবাদ বেশি হয়।
রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলখ্যাত গোদাগাড়ীতে চাষ হচ্ছে এই ফসলের। গোদাগাড়ীর মাঠে মাঠে শোভা পাচ্ছে মুগ ডাল। এখন ফল উত্তোলন শুরু হয়েছে।
গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে ১২৫ হেক্টর জমিতে মুগ ডালের চাষ হয়েছে। অত্র উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের পলাশবাড়ি গ্রামের কৃষক আবুল কালাম আজাদ গোলাই মাঠে তিন বিঘা জমিতে মুগ ডালে চাষ করেছেন। তিনি বলেন, এই ফসল চাষে তেমন খরচ হয়না। সেচ ও সার অনেক কম লাগে। এছাড়াও কিটনাশক তেমন ব্যবহার করতে হয়না। তিনি বলেন বিঘা প্রতি সর্বোচ্চ খরচ হয় ১৫০০-২০০০টাকা। আর এক বিঘা জমিতে থেকে ৫০০০ হাজারের অধিক টাকা আয় করা যায় বলে জানান তিনি।
এদিকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক মুগের একাধিক উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বারি মুগ-২ (কান্তি), বারি মুগ-৩ (প্রগতি), বারি মুগ-৪ (রূপসা), বারি মুগ-৫ (তাইওয়ানি), বারি মুগ-৬। এ ছাড়া বাংলাদেশে পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাতগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিনামুগ-৫, বিনামুগ-৬ ও বিনামুগ-৮।
বারি মুগ-২ (কান্তি) : গাছের উচ্চতা ৪০-৪৫ সেমি.। বীজের রঙ সবুজ। বীজের ত্বক মসৃণ। হাজার বীজের ওজন ৩০-৪০ গ্রাম। এ জাতটি দিবস নিরপেক্ষ হওয়ায় খরিফ-১, খরিফ-২ এবং রবি মৌসুমের শেষ দিকেও চাষ করা যায়। আমিষের পরিমাণ ২০-২৪%। জীবনকাল ৬০-৬৫ দিন। ফলন হেক্টরপ্রতি ০.৯-১.১ টন। জাতটি সারকোস্পোরা দাগ ও হলদে মোজাইক রোগ সহনশীল।
বারি মুগ-৩ (প্রগতি) : দিবস নিরপেক্ষ হওয়ায় খরিফ-১, খরিফ-২ ও রবি মৌসুমে বিলম্বে আবাদ করা যায়। আমিষের পরিমাণ ১৯-২১%। জীবনকাল ৬০-৬৫ দিন। ফলন হেক্টরপ্রতি ১.০-১.১ টন। জাতটি সারকোস্পোরা দাগ ও হলদে মোজাইক ভাইরাস রোগ সহনশীল। বারি মুগ-৪ (রূপসা) : এ জাত দিবস নিরপেক্ষ হওয়ায় খরিফ-১, খরিফ-২ ও রবি মৌসুমে বিলম্বে বপন করা যায়। জাতটি দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। বারি মুগ-৫ (তাইওয়ানি): গাছের পাতা, ফল ও বীজ আকারে বেশি বড়। বীজের রঙ গাঢ় সবুজ। হাজার বীজের ওজন ৪০-৪২ গ্রাম। জাতটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ফল একসাথে পাকে।
বারি মুগ-৬ : গাছের উচ্চতা ৪০-৪৫ সেমি.। একই সময়ে প্রায় সব শুঁটি পরিপক্ব হয়। পাতা ও বীজের রঙ গাঢ় সবুজ। দানার আকার বড়। প্রতি ১০০ বীজের ওজন ৫.১-৫.২ গ্রাম। গম কাটার পর এপ্রিলের ১ম সপ্তাহ পর্যন্ত বপন করা যায়। এ ছাড়া খরিফ-২ ও রবি মৌসুমের শেষেও বপন করা যায়। হলুদ মোজাইক ভাইরাস এবং পাতায় দাগ রোগ সহনশীল। জীবনকাল ৫৫-৫৮ দিন। হেক্টরপ্রতি ফলন প্রায় ১.৫ টন। বিনামুগ-৫ : সব ফল প্রায় একই সাথে পাকে। এ জাতটি কান্তি অপেক্ষা ৭-১০ দিন আগে পাকে। বীজের আকার কান্তি অপেক্ষা বড় এবং রঙ উজ্জ্বল সবুজ। হেক্টরপ্রতি ফলন প্রায় ১.৪ টন। পাতা হলুদ মোজাইক ভাইরাস রোগ সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন এবং সারকোস্পোরা রোগ প্রতিরোধে সক্ষম।
বিনামুগ-৬ : সব ফল প্রায় একই সাথে পাকে। জীবনকাল ৬৪-৬৮ দিন। অনুমোদিত জাত কান্তি অপেক্ষা ১০-১২ দিন আগে পাকে। বীজের আকার কান্তি অপেক্ষা বড় এবং রঙ উজ্জ্বল সবুজ। হেক্টরপ্রতি ফলন প্রায় ১.৪ টন। পাতা হলুদ মোজাইক ভাইরাস রোগ সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন এবং সারকোস্পোরা রোগ প্রতিরোধে সক্ষম। বিনামুগ-৮ : গাছের উচ্চতা মাঝারি (৩৫-৪০ সে.মি)। জীবনকাল কম, বপন থেকে পরিপক্ব পর্যন্ত ৬৪-৬৭ দিন। বীজের আকার মাঝারি ও উজ্জ্বল। ১০০ বীজের গড় ওজন ৪.০ গ্রাম। গ্রীষ্মকালে চাষ উপযোগী, এটি দিন নিরপেক্ষ বিধায় শীতকালেও চাষাবাদ করা যায়। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ১.৮ টন। ভালোভাবে পরিচর্যা করলে হেক্টরপ্রতি সর্বোচ্চ ২.২টন ফলন পাওয়া সম্ভব।
চাষ সম্পর্কে জানতে চাইলে দেওপাড়া ব্লকের উপসহকবারী কৃষি অফিসার শহিদুল আলম টিপু বলেন, বেলে দো-অাঁশ ও পলি দো-অাঁশ মাটি মুগ চাষের জন্য উত্তম। জমিটি হতে হবে মাঝারি উঁচু। মুগের জন্য জলাবদ্ধতা অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা রয়েছে এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। জমিতে ‘জো’ আসার পর ভালোভাবে ৩-৪টি চাষ দিতে হবে এবং মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। এতে বীজের অঙ্কুরোদগম হার বেড়ে যায়। এছাড়া জমির সকল আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। এলাকাভেদে মুগের বপন সময়ের তারতম্য দেখা যায়। খরিফ-১ মৌসুমে ফাল্গুন মাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত (ফেব্রুয়ারির শেষ হতে মার্চের মধ্য ভাগ)। খরিফ-২ মৌসুমে শ্রাবণ-ভাদ্র মাস (আগস্টের প্রথম হতে সেপ্টেম্বরের শেষ ভাগ)। রবি মৌসুমে বরিশাল অঞ্চলের জন্য বপনের উত্তম সময় হচ্ছে পৌষ-মাঘ মাস (জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ হতে ফেব্রুয়ারির মধ্য ভাগ)।
আষাঢ় মাসে (মধ্য জুন থেকে মধ্য জুলাই) অবিরাম বৃষ্টিতে মুগের ফল পচে যায়। চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে (মধ্য মার্চ) বীজ বপন সম্পন্ন করতে পারলে আষাঢ় মাসের আগেই ফসল সংগ্রহ করা যায় এবং ফল পচনের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হয়। অন্যদিকে অনুমোদিত সময়ের আগে বীজ বপন করলে শীতের কারণে চারা মরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, জাতভেদে মুগের বীজের হার ভিন্ন হয়ে থাকে। বারি মুগ-২, বারি মুগ-৩ ও বারি মুগ-৪ এর জন্য হেক্টরপ্রতি ২৫-৩০ কেজি। বারি মুগ-৫ এর জন্য ৪০-৪৫ কেজি বীজের প্রয়োজন। ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে বীজের পরিমাণ সামান্য বেশি দিতে হবে। ছিটিয়ে ও সারিবদ্ধভাবে বীজ বপন করা যায়। তবে সারিবদ্ধভাবে বোনা উত্তম। এক্ষেত্রে সারি হতে সারির দূরত্ব ২৫-৩০ সেমি. এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১০-১৫ সেমি. হলে ভালো হয়। বীজের গভীরতা ৩-৪ সেমি. হলে অঙ্কুরোদগমতা বেশি হয়।