জালিয়াতির মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) থেকে ৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আত্মসাতের মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ (এস কে সিনহা) ১১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর নির্দেশ দিয়েছে আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা এই মামলায় আগামী ১৮ আগস্ট সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ নাজমুল আলম আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে এ আদেশ দেন। এ মামলায় এস কে সিনহা পলাতক রয়েছেন।
বর্তমানে তিনি কানাডায় অবস্থান করছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলায় অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ হলো।
মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীকে গতকাল শুনানির সময় কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। জামিনে থাকা একই ব্যাংকের সাবেক এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) এ কে এম শামীম এবং সাবেক এসইভিপি (সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট) গাজী সালাহউদ্দিন শুনানির সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। আদালতে থাকা তিন আসামিকে অভিযোগ পড়ে শোনানো হলে তারা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে সুবিচারের আর্জি জানান। শুনানি শেষে পলাতক আটজনসহ ১১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর এ আদেশ আসে। মামলার অন্য আসামিরা হলেন ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (এফভিপি) স্বপন কুমার রায়, সাফিউদ্দিন আসকারী, ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) মো. লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা মো. শাহজাহান এবং একই এলাকার নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, রণজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায়। এ মামলায় অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে গত ৫ জানুয়ারি এস কে সিনহাসহ অন্য পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেওয়া হয়েছিল।
দুদক কর্মকর্তা বেনজির আহমেদ গত বছরের ৯ ডিসেম্বর ১১ জনকে আসামি করে মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেন।
তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে এস কে সিনহার ব্যাংক হিসাবের ৪ কোটি টাকা জব্দ করা হয়। অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে ফারমার্স ব্যাংকে ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে সেই টাকা বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর, উত্তোলন ও পাচার করেছেন। যা দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা এবং ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪ (২) (৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা অনুযায়ী সরকারি কর্মচারী, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী বা তার প্রতিনিধির বিরুদ্ধে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
মামলার অভিযোগ অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় আলাদা দুটি হিসাব খোলেন। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য পরদিন তারা ওই ব্যাংক থেকে ২ কোটি টাকা করে মোট ৪ কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং ঋণের আবেদনে উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ৫১ নম্বর বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়। বাড়িটির মালিক ছিলেন তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। ঋণের জামানত হিসেবে এস কে সিনহার পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ রণজিৎ চন্দ্রের স্ত্রী সান্ত্রী রায়ের নামে সাভারের ৩২ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করা হয়। তবে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি এ কে এম শামীম ঋণ দুটি অনুমোদন করেন। এজাহার অনুযায়ী ওই বছরের ৭ নভেম্বর ঋণের আবেদন হওয়ার পর অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে তা অনুমোদন করা হয়। পরদিন এস কে সিনহার নামে মোট ৪ কোটি টাকার দুটি পে-অর্ডার ইস্যু করা হলে ৯ নভেম্বর সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় এস কে সিনহার হিসাবে তা জমা হয়।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে ছুটি নিয়ে বিদেশে যান সে সময় প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে থাকা এস কে সিনহা। বিদেশ যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ পাওয়ার কথা জানায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এছাড়া তার সঙ্গে একই বেঞ্চে বিচারকাজ পরিচালনা করতে অপারগতা প্রকাশ করেন আপিল বিভাগের অপর বিচারপতিরা। একপর্যায়ে বিদেশে বসেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে আসা এস কে সিনহা যুক্তরাষ্ট্রে বসে একটি বই লেখেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন তাকে পদত্যাগে বাধ্য করে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে এস কে সিনহা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডায় গিয়ে সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।