আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস
১৯৭১ সালে ১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে যে সরকার গঠন করা হয় সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে, মুজিবনগরে। তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে মুজিবনগর সরকার অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শপথ গ্রহণ করে।
বৈদ্যনাথ বাবু ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের জমিদার। এই জমিদারের বিশাল সাজানো গোছানো আম বাগান ছিল এ অঞ্চলের নিভৃত পল্লীতে। তারই নামানুসারে স্থানটির নাম ছিল বৈদ্যনাথতলা। জায়গাটি ছিল ভারতীয় সীমান্তবর্তী। খুব সহজেই ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করা যেত এ স্থানটি থেকে।
মেহেরপুর জেলার সেই বৈদ্যনাথতলার বর্তমান নাম মুজিবনগর। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করার ঐতিহাসিক স্থান এটি। মুজিবনগরকে তৎকালীন স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঘোষণা করেন তাজউদ্দীন আহমদ। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগর। স্বাধীনতার বিজয় অর্জনের পরে ১৯৭২ সালে সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের রাজধানী করা হয় ঢাকা।
১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের ঐতিহাসিক বাস্তবতার দিক থেকে বিবেচনায় দিনটি সরকারি সাধারণ ছুটি ঘোষণার কথা বিভিন্ন মহলে উচ্চারিত হচ্ছে। সকল পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রমে মুজিবনগরের ইতিহাসকে বাধ্যতামূলকভাবে সংযুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ স্টাডিজ বিষয়টি বাধ্যতামূলক সংযুক্ত করা হয়েছে অনেক আগেই। ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকারের ইতিহাসকেও উক্ত পাঠ্যক্রমে বাধ্যতামূলক সংযুক্তির বিষয়টি বিবেচনার জোরালো দাবি রাখে।
মুক্তিযুদ্ধকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি, সেক্টরভিত্তিক যুদ্ধক্ষেত্রের বিভক্তি, সেনাবাহিনী গঠন ও তার সর্বাধিনায়ক নির্বাচন, নেতৃবৃন্দকে সুসংগঠিত করা, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের দিকনির্দেশনা প্রদান, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত পর্যায়ে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয় মুজিবনগর সরকারের যোগ্য নেতৃত্ব। যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ও কর্মকর্তাদের কার্যকরী ভূমিকা ছিল।
করোনাভাইরাসের এই কঠিন সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১২ এপ্রিলে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মেহেরপুর জেলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় মুজিবনগর দিবসের অনুষ্ঠান ঘরোয়াভাবে পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে উল্লেখ করেছেন মুজিবনগরের কথা ভুলে গেলে চলবে না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রথম সরকার ছিল মুজিবনগর সরকার। তার পরিপ্রেক্ষিতে মৌখিক বিবৃতির ও মিডিয়াভিত্তিক অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে আজকের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানসূচি। তার আগে পহেলা বৈশাখের আগের দিনে সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এই প্রথম ঘরে বসে বৈশাখ পালনে জনগণকে আহবান জানায়।
স্বাধীনতার ৪৯তম বছরে এসে দেশ তার স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদ্যাপন সরকারিভাবে বাতিল করেছে। এ সময়ে বিশ্বের প্রতিটি ইভেন্ট স্থগিত অথবা বাতিল হয়েছে। এক বছর পিছিয়েছে টোকিও অলিম্পিক আয়োজনসহ বিশ্বের নানা আয়োজন। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার জনগণের সর্বোচ্চ সুরক্ষার জন্য মাঠ পর্যায় পর্যন্ত করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় কাজ করে যাচ্ছে।
১৯৭১ সালের মুজিবনগর সরকার গঠন হয় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার মাধ্যামে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের একটি সোনার বাংলাদেশ গড়ার। সেই বাস্তবতায় সরকার দেশের কর্মহীন, অসহায়, নিম্নআয়ের খেটেখাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দিয়েছেন করোনাভাইরাসের কারণে সারা দেশে সাধারণ ছুটির মধ্যে একজন মানুষও যেন না খেয়ে থাকে।
১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার মুক্তির চেতনার ডাক দিয়ে বিশ্ব দরবারে একটি স্বাধীন দেশের আনুষ্ঠানিক পরিচয় তুলে ধরে। এই সরকার শপথ গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে বাংলাদেশ স্বাধিকার আন্দোলনে নিজেদের মুক্তির জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে। বাঙালি জাতি অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াবার নয়। প্রতিটি দুর্যোগকে সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করে উত্তরণ করেছে বাংলার জনগণ।
বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনের ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের এই দিনে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সাধারণ জনগণের জয় হবেই। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশকে বীরের জাতি বলে সকলে চিনবে ও জানবে। অত্যাচারের শৃঙ্খলের দুর্গ ভেঙে মুক্তির নেশায় মিশে রয়েছে বাঙালির প্রতিটি প্রাণে। সেই মুক্তির প্রাণ আবারও জেগে উঠবে সকল দুর্যোগ ও দুর্ভাবনাকে কাটিয়ে উঠে উন্নত বাংলাদেশ গড়তে। ২১ শতকের বাংলাদেশ হবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার মুজিবনগর সরকারের প্রত্যয়ের চেতনায় গড়ে ওঠা আধুনিক বিশ্বের উন্নত দেশ।
স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর মুজিবনগর তথা মেহেরপুরবাসী মন্ত্রী পেয়েছে বর্তমান মন্ত্রিসভায়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী জনাব ফরহাদ হোসেন এমপি। দেশের প্রথম সরকার গঠনের পর মুজিবনগরের জনগণকে সরকার গুরুত্ব দিলেন তাদের মন্ত্রিসভায় স্থান করে দিয়ে। মেহেরপুর কৃষিভিত্তিক উর্বর ভূমিবেষ্টিত জেলা। কৃষি উৎপাদন এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস।
করোনা মোকাবেলায় গত ১২ এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা এবং কৃষি ক্ষেত্রে সার, বীজে ৯ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি প্রদান করেন। মেহেরপুর জেলা এ সকল প্রণোদনা মধ্যবিত্তের আধিক্যের জনগোষ্ঠী যেন সঠিকভাবে বরাদ্দ পায় সে প্রত্যাশা জেলাবাসীর। উন্নত বাংলাদেশ গড়তে মেহেরপুরের কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর উন্নয়ন জরুরি। এ ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ হিসেবে কৃষি বিশ্ববিদ্যলয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান গঠন করা এখন সময়ের দাবি। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান একটি জেলাকে কর্মঘন জেলায় রূপান্তর করতে সহায়তা করবে। কৃষিভিত্তিক শিল্পের উন্নয়ন মেহেরপুরের মাটি মানুষের দাবি।
শ্রমের বিভাজন যত বেশি হবে তত বেশি সেখানে উৎপাদনের ভিন্নতা সৃষ্টি হবে। উৎপাদনের ভিন্নতা জনগণের ভোগের ভিন্নতা এনে দেয়। ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার ইচ্ছে শক্তি বৃদ্ধি ঘটায়। ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষের আয় বৃদ্ধি পায়। আয় বৃদ্ধির এমন চক্র জনসাধারণের কৃষ্টি কালচারের পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে উন্নত জীবনধারার সূচনা ঘটায়। মুজিবনগর-মেহেরপুরবাসী নিজস্ব সংস্কৃতির মাধ্যমে জীবনযাপন করে। বৈশ্বিক শিল্প-নগর উন্নয়নের সঙ্গে প্রযুক্তিভিত্তিক সমাজ গঠনে বাংলাদেশ ও বিশ্ব এখন অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। মেহেরপুর জেলার উন্নয়ন সেই পর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে সামগ্রিক গ্রাম উন্নয়নে সুষম উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে জেলার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। মুজিবনগর স্থলবন্দর আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
স্থলবন্দর স্থাপন হলে মুজিবনগরের বাণিজ্যের ব্যাপক উন্নয় ঘটবে। প্রান্তিক মানুষের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ পাবে। দর্শনা-মুজিবনগর-মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা রেলপথের নির্মাণ কাজ ধীর গতিতে রয়েছে অথবা কাগজ কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে এটি। সরকারের ব্যয় বৃদ্ধির নীতির মাধ্যমে আয় বৃদ্ধির নীতি বাস্তবায়ন করতে হলে উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। গৃহীত প্রকল্পগুলোর উন্নয়ন মেহেরপুরের উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত যার মধ্যে নিহিত রয়েছে এ অঞ্চলের জনমানুষের ভাগ্য উন্নয়ন।
মুজিবনগরের স্মৃতি কমপ্লেক্স উন্নয়নে সরকার কোটি কোটি টাকার বরাদ্দ দিচ্ছেন। বরাদ্দ বৃদ্ধির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে। কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ এ জেলা কৃষিজ উৎপাদনে অগ্রণী ভূমিকায় রয়েছে। ভৈরব নদী খনন, সড়কের উন্নয়ন, গ্রামীণ পরিষেবা বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ সরবরাহের উন্নয়ন, শিক্ষার প্রসার, আমঝুপির নীল কুঠির ব্যবস্থাপনা, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, মাদক নিয়ন্ত্রণ, চোরাকারবারি দমন, দুর্নীতি রোধ, সন্ত্রাস দমন করে এ জনপদে শান্তি ফিরিয়ে আনা, সীমান্তে অপরাধ কমিয়ে আনা ও ভীতিহীন গ্রাম্য সমাজ বিনির্মাণে জনপ্রতিনিধি ও মন্ত্রী কাজ করে যাচ্ছেন।
মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স দেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যন্য নিদর্শন হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের প্রদর্শিত দর্শন দেখতে হলে মুজিবনগর ভ্রমণে আসতে হবে। ঐতিহ্যগত আম বাগানের উন্নয়ন, বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টি, স্টেডিয়াম স্থাপন, শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি, শিক্ষা, কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান, যুব উন্নয়ন কর্মসূচি, প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধিসহ কার্যকরী মেহেরপুরের উন্নয়নে কর্মসূচি বাস্তবায়ন হোক এ বছরের ঘরোয়া ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের প্রতিপাদ্য।
মজনুর রশিদ : চেয়ারম্যান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।