করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে নিজে নিজে চিকিৎসা করবেন যেভাবে
মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কেউই এই ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির উর্ধ্বে নয়।
সুতরাং সত্যি সত্যি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলে এবং সেলফ আইসোলেশনে যেতে হলে হাতের কাছে কি রাখতে হবে সে সম্পর্কে ধারণা থাকাটা জরুরি। হয়তো অবস্থা এমনও হতে পারে যে করোনা রোগীর সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে, হাসপাতালগুলোতে সকল রোগীর সংকুলান সম্ভব হচ্ছে না। আমরা চাই না যে এমন পরিস্থিতি আসুক, কিন্তু তারপরও ভবিষ্যতে কি হবে জানা নেই বলে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা কিভাবে নিজে নিজে করা যায় তা জেনে রাখা ভালো।
নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসা নিজে নিজে করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। চীনের ৮০ শতাংশ কোভিড-১৯ রোগী হালকা থেকে মধ্যম মাত্রার উপসর্গে ভুগেছেন- তার মানে হলো, ঘরে থেকেই উপযুক্ত চিকিৎসায় এসব রোগীরা নিরাময় পেতে পারেন।
মেডিক্যাল ডিভাইস ও কনজুমার প্রোডাক্টস কোম্পানি অ্যাবটের গবেষণা বিজ্ঞানী জেনিফার উইলিয়ামস বলেন, ‘নতুন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন সন্দেহ করলে অথবা করোনা টেস্টে পজিটিভ রেজাল্ট আসলে ও উপসর্গগুলো হালকা থেকে মধ্যম মাত্রার হলে নিরাময় পেতে নিজেকে সাহায্য করতে কিছু সহজ উপায় রয়েছে।’
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ভার্চুয়াল হেলথ প্ল্যাটফর্ম জিপনোসিসের চিফ মেডিক্যাল অফিসার লিসা ইডি বলেন, হোম কোয়ারেন্টাইন অথবা আইসোলেশনের জন্য গৃহস্থ পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় জিনিস মজুদ করতে হবে। নিশ্চিত হোন যে আপনার কাছে জরুরি ফোন নম্বর রয়েছে, পরিবার-বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজন-সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ফোনে ইন্টারনেট/ব্যালেন্স রয়েছে এবং আপনার কাছে খাবার কিভাবে আসবে তার পরিকল্পনা করা হয়েছে। দুই থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত খাবার পাওয়ার ব্যবস্থা করুন। স্যানিটাইজিং ওয়াইপস ও সাবানের মতো পরিষ্কারক সামগ্রী এবং টয়লেট পেপার ও ফেসিয়াল টিস্যুর যেন অভাব না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। খাবার মজুদের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ভালো থাকে এমন পুষ্টিকর খাবার বেছে নিন, যেমন- চাল, চিড়া, পাস্তা, শুষ্ক শিমের বিচি, শুষ্ক ফল ও স্যূপ।’ এসময় স্বাস্থ্য ও নিরাময়ের জন্য তাজা ফল ও শাকসবজি খাওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। তাই নিয়মিত এসব খাবার পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
হাতের কাছে যা রাখবেন
আইসোলেশন পিরিয়ড বা কোভিড-১৯ থেকে নিরাময়কালে শুধু পর্যাপ্ত খাবার নয়, অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসও হাতের কাছে রাখতে হবে। এখানে ঘরে আইসোলেশনে খাবারের পাশাপাশি অন্যান্য যা কিছু দরকার হবে তার একটি তালিকা দেয়া হলো।
বিশুদ্ধ পানি: আইসোলেশন পিরিয়ডে তালিকায় সবার ওপরে থাকবে বিশুদ্ধ পানি। পানি শরীরকে স্বস্তি ও ভালো অনুভূতি দিতে পারে। ইমোরি ইউনিভার্সিটির পিডিয়াট্রিকস বিভাগের ক্লিনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর রয় বেনারোশ বলেন, ‘কোভিড-১৯ হচ্ছে একটি ভাইরাস সংক্রমণ। অন্যান্য ভাইরাস সংক্রমণের মতো এর চিকিৎসা হচ্ছে শরীরকে স্বস্তিতে রাখা। এসময় শরীরে পর্যাপ্ত পানি থাকা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে জ্বর বেড়ে গেলে।’
ডা. উইলিয়ামস জানান, ‘কোভিড-১৯ এর উপসর্গগুলো (জ্বর, কাশি, ডায়রিয়া ও বমি) রোগীদের পানি পানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে শরীরকে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতায় ভোগাতে পারে। নিরাময়কালে পর্যাপ্ত পরিমাণে স্বাস্থ্যকর খাবার ও তরল গ্রহণ না করলে শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হবে। শরীরে পর্যাপ্ত মাত্রায় পানি থাকলে নাকের শ্লেষ্মা ঝিল্লি অক্ষত থাকে।এটি কাশি, হাঁচি ও শ্বাসক্রিয়ার সময় নাকের অস্বস্তি হ্রাস করে।আর্দ্রতা ক্ষতিগ্রস্ত ঝিল্লি নিরাময় করতেও সহায়তা করে, ফলে শরীরে বাড়তি ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করতে পারে না।’
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যাকাডেমিস অব সায়েন্সেস, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেডিসিনের মতে, সুস্থ নারী ও পুরুষদের প্রতিদিন যথাক্রমে ৩.৭ ও ২.৭ লিটার পানি পান করা উচিত। কিন্তু অসুস্থ মানুষদের আরো বেশি পানি পান করতে হবে।
ব্যথার ওষুধ: ডা. বেনারোশের মতে, নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণে সবচয়ে কার্যকর ব্যথার ওষুধ হচ্ছে সেটা যা মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা ও জ্বর কমাতে পারে, যেমন- অ্যাসিটামিনোফেন বা প্যারাসিটামল। ক্যালিফোর্নিয়ার ইমার্জেন্সি ফিজিশিয়ান লারি বুরশেট বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্ক রোগীদের জন্য ৪ থেকে ৬ ঘন্টা পরপর ৬৫০ মিলিগ্রাম প্যারাসিটামল সুপারিশ করেছেন। তার মতে, এটা নিরাপদ ডোজ।
টিস্যু: ভাইরাস সংক্রমণে অসুস্থ মানুষের কাশি, হাঁচি অথবা থুতুর মাধ্যমে শ্বাসতন্ত্র থেকে ভাইরাসযুক্ত তরল কণা ছড়িয়ে পড়ে, যার সংস্পর্শে এসে সুস্থ মানুষেরাও সংক্রমিত হয়ে থাকেন। তাই পরিবারের অন্য সদস্যদের মাঝে করোনাভাইরাসের বিস্তার এড়াতে হাতের কাছে পর্যাপ্ত টিস্যু রাখুন। সম্ভব হলে ব্যবহৃত টিস্যু পুড়ে ফেলুন।
কাশির ওষুধ: ডা. বেনারোশ বলেন, ‘কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত অনেক রোগী মারাত্মক কাশিতে ভুগেন। যদি আপনার হাঁপানি অথবা অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রীয় সমস্যা থাকে, তাহলে এতদিন শ্বাসতন্ত্রের যেসব ওষুধ নিয়মিত ব্যবহার করে আসছেন তা চালু রাখুন। কোভিড-১৯ এর উপসর্গ প্রশমিত করতে যেসব ওটিসি ওষুধ ব্যবহার করতে যাবেন তা আপনার নিয়মিত ওষুধের সঙ্গে কিভাবে সমন্বয় করলে ভালো হবে তা জানতে চিকিৎসককে কল করতে পারেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘ওটিসি কাশির ওষুধ তেমন কার্যকর নয়, কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে পারেন। কুসুম গরম পানিতে মধু মিশিয়ে খেলেও কাশির উপদ্রব কমতে পারে।’
প্রেসক্রিপশন ওষুধ: হাঁপানি অথবা অন্যকোনো শ্বাসতন্ত্রীয় অসুস্থতা রয়েছে? তাহলে নিশ্চিত হোন যে হাতের কাছে পর্যাপ্ত ইনহেলার ও অন্যান্য প্রেসক্রিপশন ওষুধ রয়েছে। অন্যান্য ক্রনিক স্বাস্থ্য সমস্যার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, যেমন- ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ ও ইমিউন সিস্টেম ডিসঅর্ডার। ভুলে গেলে চলবে না যে দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে এমন রোগীদের কোভিড-১৯ এর মারাত্মক জটিলতার ঝুঁকি বেশি, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। ডা. পিটার্স পরামর্শ দেন, ‘চার সপ্তাহের জন্য প্রেসক্রিপশন ওষুধ ও ওটিসি ওষুধ সংগ্রহ করে রাখুন।’
জিংক: ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের মেডিসিন বিভাগের ক্লিনিক্যাল প্রফেসর এমেরিটাস মরটন টাভেল বলেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ উপশম করতে একটি জনপ্রিয় সাজেশন হচ্ছে, জিংক সাপ্লিমেন্ট। যদিও এখনো পর্যন্ত প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে জিংক সাপ্লিমেন্ট করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ বা নিরাময় করতে পারে। কিন্তু ল্যাবরেটরি গবেষণায় দেখা গেছে যে, জিংকের ভাইরাসবিরোধী উপাদান কোষে করোনাভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরিতে বাধা দিতে পারে। যেহেতু জিংক সাপ্লিমেন্ট সেবনে ক্ষতি নেই, তাই এটি সেবন করে দেখতে পারেন।’
ভিটামিন সি: বি অ্যান্ড ইউর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও খাদ্য বিজ্ঞানী আসলি এলিফ টানুগার সামানচি বলেন, ভিটামিন সি ইমিউন কোষের কার্যক্রমে সহায়তা করে, বিশেষ করে যখন মহামারিতে বেশি কাজ করার প্রয়োজন হয়। আমার পরামর্শ হচ্ছে, কোভিড-১৯ থেকে নিরাময়কালে প্রতিদিন ১ থেকে ৩ গ্রাম ভিটামিন সি গ্রহণ করুন। সাপ্লিমেন্ট নয়, তাজা শাকসবজি ও ফল থেকে এই চাহিদা পূরণের চেষ্টা করুন।’
হলুদ ও আদা: ডা. সামানচি বলেন, ‘হলুদ ও আদা উভয়েই বিস্ময়কর প্রদাহনাশক উপাদান রয়েছে এবং উচ্চ মাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টও রয়েছে। এছাড়া আদাতে এমনকিছু কেমিক্যাল রয়েছে যা ঠান্ডার মতো শ্বাসতন্ত্রীয় অসুস্থতা ও পাকস্থলি-সংক্রান্ত সমস্যা উপশম করতে পারে। হলুদেও শতশত সক্রিয় কেমিক্যাল রয়েছে যা ব্যথা কমাতে দারুণ কার্যকর। উভয় মসলা থেকে সর্বোচ্চ উপকার পেতে শরবত বানিয়ে খেতে পারেন।’
থার্মোমিটার: যদি আপনি সন্দেহ করেন যে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন, তাহলে দিনে দু’বার শরীরের তাপমাত্রা চেক করে দেখার জন্য একটি থার্মোমিটার লাগবে। আপনাকে জ্বর কমানোর ওষুধ খেতে হবে। দ্য নিউ ইয়র্ক ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ উপসর্গ আরম্ভের দিন থেকে ন্যূনতম সাতদিন সন্দেহজনক লোককে আইসোলেশনে থাকতে পরামর্শ দিয়েছে। প্যারাসিটামল খাওয়ার পরও উপসর্গ আরো খারাপ হতে থাকলে অথবা সাতদিনের মধ্যে উপসর্গ দূর না হলে হাসপাতালে ভর্তির প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
পরিষ্কারক ও জীবাণু ধ্বংসের সামগ্রী: ঘরের সদস্যদেরকে নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে আপনাকে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে। নিজেকে ও ঘরের জিনিসপত্র পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, গ্লাভস, ব্লিচ, স্যানিটাইজিং ওয়াইপস ও অন্যান্য পরিষ্কারক সামগ্রী কিনে রাখুন।
অতিরিক্ত বিছানার চাদর, তোয়ালে ও পাজামা: ডা. পিটার্স বলেন, ‘নতুন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীরা তাদের সংস্পর্শে আসা সবকিছুকে দূষিত করতে পারে। শক্ত পৃষ্ঠকে সহজে জীবাণুমুক্ত করা গেলেও কাপড়চোপড়, তোয়ালে ও বিছানার চাদরকে নিরাপদে রেখে গরম পানি ও জীবাণুনাশক তরল দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হয়।’ এসময় অতিরিক্ত বিছানার চাদর, বালিশের কভার, তোয়ালে, টিশার্ট, পাজামা ও অন্যান্য কাপড় প্রয়োজন হতে পারে। তাই অতিরিক্ত না থাকলে ব্যবস্থা করে নিতে হবে।
আইসোলেশনের জন্য জায়গা নির্বাচন: নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ প্রকাশ পেলে আইসোলেশনের জন্য সবচেয়ে আদর্শ হচ্ছে অ্যাটাচ বাথরুমসহ আলাদা রুম। আলাদা রুম না থাকলে শক্ত উপকরণ দিয়ে আলাদা রুম তৈরি করে নিতে হবে। এসময় খেয়াল রাখতে হবে যে পরিবারের সদস্যরা কমপক্ষে ৬ ফুট দূরত্বে আছে। ঘরে একাধিক বাথরুম না থাকলে যতবার ব্যবহার করবেন ততবারই বাথরুমকে ভাইরাসমুক্ত করতে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে।
ফার্স্ট এইড কিট: প্রয়োজনীয় সকল কিছু নিয়ে আইসোলেশনে যাবেন ভালো কথা। কিন্তু বাড়তি সতর্কতা হিসেবে আপনার সঙ্গে ফার্স্ট এইড কিট রাখার কথাও বিবেচনা করতে পারেন। এর ফলে নিজে নিজেই ছোটখাট অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সামলাতে পারবেন।
আইসোলেশনে মানসিক স্বাস্থ্য: আইসোলেশনে যেন মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। বিনোদন মনকে প্রফুল্ল রাখে। বিনোদনের উৎস হিসেবে গেমস, মুভি, বই ও অন্যান্য এন্টারটেইনমেন্ট অপশন রাখতে পারেন। এসময় মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়লে নিরাময় বিলম্বিত হতে পারে অথবা উপসর্গগুলো আরো তীব্র হওয়ার সুযোগ পেতে পারে। অন্যদিকে মন থেকে দুশ্চিন্তা তাড়াতে পারলে নিরাময় প্রক্রিয়া দ্রুত হতে পারে অথবা উপসর্গগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়ে।