শেষ পর্যন্ত আমরা কভিড-১৯-এর বিস্তৃতি রোখার ক্ষেত্রে দারুণ বৈজ্ঞানিক সাফল্য পেয়েছি। এ সাফল্যের প্রভাব বিশ্বাস করা কঠিন। আমরা দেখেছি এমন একটি রোগ প্রতিরোধী যন্ত্র, যার সঠিক ব্যবহার নাটকীয়ভাবে কমিয়ে দিতে পারে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সার্স-কোভ-২-এর সংক্রমণ। গবেষণা বলছে, এই যন্ত্র কোথাও কোথাও ৫০ থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত সংক্রমণ কমিয়ে দিতে পারে। এই যন্ত্র সস্তা ও উল্লেখযোগ্যভাবে লো-টেক। এমনকি আপনি বাড়িতেও বানিয়ে নিতে পারেন। এর বিশেষ কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই। প্রতিনিয়ত বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলোও দেখাচ্ছে এই যন্ত্রের শক্তিশালী কার্যকারিতা।
যদি এই যন্ত্র ভ্যাকসিন কিংবা ওষুধ হতো, তবে মহামারী রোধের সফলতায় আমরা সবাই সবাইকে শুভেচ্ছা জানাতাম এবং উদযাপন করতাম।
আমি অবশ্যই বলছি ফেস মাস্কের কথা। সেটা হতে পারে কাপড়ের, সার্জিক্যাল অথবা এমনকি রুমালও। ফেস মাস্ক সাধারণত শ্বাসপ্রশ্বাস থেকে নির্গত ড্রপলেট আটকে দিতে পারে, যার কিনা নভেল করোনাভাইরাস বহন করার আশঙ্কা আছে। তবে কভিড-১৯-এর বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া জানানোর অনেকগুলো দিকের এটিও একটা। গণহারে পরীক্ষা, কন্টাক্ট ট্রেসিং এবং ঘরে থাকার নির্দেশ মেনে চলাও এর অংশ।
অনেক দেশ এখন পর্যন্ত বেশ সফলতার সঙ্গে কভিড-১৯-এর মহামারী মোকাবেলা করেছে। দেশগুলোর জনস্বাস্থ্যের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ এবং জনগণণ কোনো ধরনের বিতর্কের জন্ম না দিয়েই ফেস মাস্ক ব্যবহারকে সাদরে মেনে নিয়েছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, যেসব দেশ প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই বিস্তৃতভাবে মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করেছে তারা মৃত্যুহার অনেক নিচের দিকে রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং সংক্রমণ সীমিত রাখতে পেরেছে। হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম দ্রুতই মাস্ক ব্যবহারের বিষয়টি আয়ত্ত করেছে। সে সঙ্গে অন্যান্য যেসব বিধিনিষেধ ছিল, যেমন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং ট্রেকিং ও ট্রেসিংও তারা মেনে চলেছে। ফলে রিপোর্ট বলছে প্রতি মিলিয়নে তারা মৃত্যুর সংখ্যা ছয়জনের নিচে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে মৃত্যুহার বর্তমানে প্রতি মিলিয়নে ৩৭৯ জন, মাস্কে এখনো তারা পক্ষপাতমূলক অস্ত্র হিসেবে একে অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। তারা প্রেসিডেন্টকে তাদের সূত্রধর মানছে, যিনি ক্যামেরার সামনে মাস্ক পরে দাঁড়াতে অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন, যেসব আমেরিকান মাস্ক পরে তারা তাকে অস্বীকার করার জন্য এটা করছে। তার অনেক সমর্থক মাস্ক না পরাকে দেখছে তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হিসেবে। এমনকি যেসব স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মাস্ক পরাকে উৎসাহিত করেছেন তাদের মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়েছে। অনেকে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।
এই বিপজ্জনক মেরুকরণের ফল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কেবল ১৮টি স্টেট এবং কলম্বিয়া ডিস্ট্রিক্ট মাস্ক পরার বিধান জারি করতে পেরেছে। এখানে কেবল ম্যাসাচুসেটস ও মেরিল্যান্ডের রিপাবলিকান গর্ভনর রয়েছে। আবার অনেক রিপাবলিকান নেতৃত্বাধীন রাজ্য স্থানীয়ভাবে আরোপ করা বিধিনিষেধ বাতিল করার চেষ্টা করছে।
ফেস মাস্ককে প্রত্যাখ্যান করা মানে হলো কভিড-১৯ সংক্রমণ ও মৃত্যুকে কাছে টেনে নেয়া। একটি মার্কিন সমীক্ষা বলছে, যেসব স্টেট বিধিনিষেধ মেনে চলেছে তাদের কভিড-১৯-এ আক্রান্তের হার দ্রুত হ্রাস পেয়েছে এবং মাস্কের ব্যবহার ২২ মে ২০২০ সালের মাঝে সাড়ে চার লাখ কেস প্রতিরোধ করেছে। এদিকে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের একদল গবেষক বলছে, অক্টোবরের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রে কভিড-১৯-এ মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার হতে পারে। তবে তারা বলছে যদি ৯৫ শতাংশ মানুষ মাস্ক পরে তবে অন্তত ৩৩ হাজার মৃত্যু প্রতিরোধ করা যাবে। হ্যাঁ এটাই সত্যি। আমরা আমাদের বাবা-মা, দাদা-দাদি, ভাই-বোন, সহকর্মী, শিক্ষক, বাস ড্রাইভার এবং নার্সসহ ৩৩ হাজার লোকের জীবন বাঁচাতে পারব কেবল এক ডলার খরচ করে আমাদের নাক ও মুখ ঢেকে।
তাহলে কে আমাদের বাধা দিচ্ছে? একটি সমস্যা হচ্ছে, ‘আমি আগে’ বিষয়টি। যেখানে মাস্কবিরোধীরা বলছে জীবন বাঁচানোর চেয়ে মাস্কবিহীন রাস্তাঘাটে ঘোরাঘুরির স্বাধীনতা তাদের অধিকার। তারা যা বুঝতে পারে না তা হলো মাস্ক কেবল নিজেকে না, অন্যকেও রক্ষা করতে পারে।
যদি আপনি সংক্রমিত হন এবং সেটা যদি না জানেন (উপসর্গবিহীন সংক্রমণ) কিংবা তখনো উপসর্গ দেখা না গেলে সেক্ষেত্রে মাস্ক আপনার আশপাশে ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি হ্রাস করে। তাই সমাজের যত বেশি মানুষ মাস্ক পরবে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকিও ততই কমে আসবে। এসব কারণেই সরকারের উচিত মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা। মাস্ক পরা কোনো দুর্বলতার চিহ্ন বহন করে না। এটা মূলত সংহতির নিদর্শন।
টাইম ম্যাগাজিন থেকে সংক্ষেপে অনূদিত