শবে বরাতঃ ইতিহাস ও কিছু কথা –আলী আকবর
আজ ১৪ ই শাবান, দিনের সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্ত যেতেই আসবে বরকতময় রজনী শবে বরাত। চারিদিকে বইবে ধর্মীয় উৎসবের আবহ। কিন্তু মহামারী করোনার কারণে মসজিদগুলো আগেরমত প্রাণ পাবে না। ইসলামি বিশেষজ্ঞেরা বাড়ি বসেই এবারের শবে বরাত পালন বা ইবাদত বন্দেগী করার পরামর্শ দিয়েছেন। কোয়ারান্টাইনের এইদিনে তাই ঘরোয়া ইবাদাত বন্দেগীতেই কাটুক আমাদের শবে বরাত এমনটাই প্রত্যাশা করি। যেহেতু এই রজনীটি আমাদের দেশে অন্যান্য মুসলিম দেশের তুলনায় একটু ভিন্ন আঙ্গিকে আমরা পালন করি তাই এর উৎযাপন নিয়ে ইসলামি গবেষকদের মধ্যে নানা মতানৈক্য রয়েছে।
📖 শবে বরাত নাকি মধ্য শাবান?
শবে বরাত শব্দটি সরাসরি ইসলামি পরিভাষা নয়। এটি একটি ফার্সি শব্দ। যার আবিধানিক অর্থ ‘ভাগ্য রজনী’। আবার আরবী ভাষায় লাইলাতুল বারাআত মানে ‘মুক্তির রজনী’। প্রচলিত এই দুই শব্দের কোনটিই হাদীসে উল্লেখ নাই বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ‘লাইলাতুননিফসি মিন শাবান’ বা মধ্য শাবানের কথা। আশ্চর্যের বিষয় হলো, প্রচলিত ফারসি শব্দ শবে বরাত একদিকে যেমন মধ্য শাবানের সঠিক অর্থ বহন করছে না। অন্যদিকে কোরআন সুন্নাহ দিয়ে এর ব্যবহারিক ইবাদতও পরিষ্কার নয়। সুতরাং আমরা শবে বরাত বলতে যা বুঝি তা প্রকৃত অর্থে মধ্য শাবান।
ইসলামের অনেকগুলো মৌলিক ইবাদাতের ফার্সি পরিভাষা আমরা ব্যাবহার করি, যেমন নামাজ, রোজা,বেহেশত,দোযখ ইত্যাদি । কিন্তু সালাত(নামাজ),আর সাওম (রোজা)’র ব্যবহারিক ও শাব্দিক অর্থের কোন পার্থক্য নেই। আরবি শব্দ মধ্য শাবানের ফার্সি শব্দ হলো (নিমফি শাবান) যা শবে বরাত কিভাবে হলো সেটা বলা মুসকিল। মুল ব্যাপারটা হলো, শাবানের মধ্য রজনী একটি মহিমান্বিত রাত। তবে শবে বরাত নামে যে ইবাদতের সাথে আমরা পরিচিত তা রাসূল (সা) বা সাহাবী যুগের ৫০০ বছর পর জেরুজালেমে প্রবর্তিত হয়েছে বলে অনেকে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন।
ঐতিহাসিকদের মতে , বারোদশ শতকের গোড়ার দিকে অর্থ্যাৎ হিজরী ৫০০ হিজরীতে মুসলিম সালতানাতে কতিপয় অযোগ্য শাসকদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা এর প্রচলন ঘটে। এসব শাসকরা ইসলামের ব্যাপারে উদাসীন ছিল। মুসলিম শাসনের গুরুত্বপূর্ণ শহর দামেস্ক ও বাগদাদের আলেমরা তৎকালে ইসলামের নানা বিষয় নিয়ে বিতর্ক বহাস করত। আলেমরা এসময় পরস্পর পরস্পরের বিরোধীতায় যুক্তি-তর্ক দাড় করাতো। মানুষ দলে দলে সেসব জলসায় যোগ দিত। তাদের মধ্যে বাক-বিতন্ডায় যে আলেম যত লোকবল প্রদর্শন করতে পারতো বাদশাহ তাকে ‘সেরা’ বলে জ্ঞান করতো। এভাবেই কতিপয় আলেম নিজ দলে লোক ভিড়াতে ইসলামী শরীয়াতের অপেক্ষাকৃত অপ্রাসঙ্গিক বিষয়কে ইসলামে যোগ করে বাদশাহের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নজরানা নিতেন।
📓 শবে বরাতের প্রচলন
শবেবরাত সর্বপ্রথম চালু হয়েছিল ৪৪৮ হিজরিতে বায়তুল মুকাদ্দাসে (মাসজিদুল আকসায়)। বাইতুল আকসার প্রত্যেকটি মসজিদে তৎকালীন ইমামগণ বাদশার কাছে নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করার জন্য শাবানের রাতে মসজিদে উপস্থিত লোকদের মাঝে বহু ফযিলতের ওয়াজ ও নামাযের অশেষ নেকী পাওয়ার বানোয়াট বিবরণ পেশ করতেন। ইমামরা আরবি মাসের ১৩-১৫ তারিখ রাতের আইয়ামে বীযের বরকতকে শবেবরাতের সাথে মিলিয়ে বেশি ফজিলতের ওয়াজ ও তাফসীর করে বাদশাহর নিকট তাদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করার মধ্যে দিয়ে এটি ধর্মীয় গুরুত্ব পায়।
📜 ভারতীয় উপমহাদেশে শবে বরাত
শবে বরাতের প্রচলন আরবে শুরু হলেও আরব দেশগুলোতে এর বিস্তার লাভ করেনি। তবে আমাদের উপমহাদেশে এটি এখনও বিশেষ গুরুত্ব সহকারে পালিত হচ্ছে। আরব বিশ্বের ইরানে শিয়া মতাদর্শীরা এটাতে আকড়ে ধরে নিয়মিত পালন করে আসছে। ইসলামের পূণ্যভূমি মক্কা মদিনায় শবে বরাতের প্রচলন নেই। কেবলমাত্র বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইরানসহ কয়েকটি দেশে শবেবরাত পালনের ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায়। ইরানে শবে বরাতটি শিয়া মাজহাবের দ্বাদশ ইমাম হযরত ইমাম মাহদির জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়। এই রাতে ইরানের সর্বত্র আলোক সাজসজ্জা ও বিশেষ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। তৎকালে বাংলার নবাবরা ছিলেন শিয়া মতাদর্শী বা শিয়াদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তাই প্রাচীনকাল থেকে তারা ইরানের নওরোজ, মহররম, শবে বরাত ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বে পালন করতে। আর সেই থেকে আমাদের বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানসহ সারা উপমহাদেশে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে।
১৯শ শতকের শেষের দিকে ঢাকার নবাবরা বেশ ঘটা করেই শবেবরাত পালন করতেন, সে সময়ে ঢাকার নবাবরা শবেবরাতের জন্য আলোকসজ্জার পাশাপাশি মিষ্টি বিতরণ করতেন। সে সময়ে যেহেতু মিষ্টির দোকান খুব একটা প্রচলিত ছিল না, সেজন্য মিষ্টি জাতীয় খাদ্য বানানোর উপাদান দিয়ে বাড়িতে হালুয়া তৈরির প্রচলন শুরু হয়। ধীরে-ধীরে এর বিস্তার ঘটতে থাকে।
📚 কুরআন হাদিসে শবে বরাত
মধ্য শা’বানের রাতের ফজিলত নিয়ে যে সহিহ হাদিসটি এসেছে তা হল আবূ মূসা আল-আশআরী (রাঃ) বলেন; রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
إن الله تعالى ليطلع في ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك، أو مشاحن.
“আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে (সমগ্র সৃষ্টির প্রতি) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক/ঘৃণাকারী ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করে দেন।” [সুনানে ইবনে মাজাহ-১৩৯০]
সুতরাং, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এই রাতে যারা শিরক করে ও যাদের মনে হিংসা আছে তাদের কে ছাড়া সৃষ্টির সকল কে ক্ষমা করে দেন। সৃষ্টি কুলের উপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার এটি একটি বিশেষ রহমত, এর মুলকথা আত্নার পরিশুদ্ধতা।
যারা এটাকে ভাগ্য রজনী হিসাবে দাড় করানোর চেষ্টা করেন তারা নিম্নোক্ত হাদিসের রিজিকের কথা বলছেন। কিন্তু এখানে আল্লাহ রিজিকের সমস্যাগ্রস্তকে ডেকেছেন রিজিক দেবার জন্য তকদির বা ভাগ্য নির্ধারনের জন্য নয়।
ইবনে মাজাহর ১৩৮৮ নম্বর হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন মধ্য শাবানের রজনী আসে, তখন তোমরা রাতে দণ্ডায়মান থাকো এবং দিবসে সিয়াম পালন করো। কারণ, ওই দিন সূর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো রিজিক তালাশকারী আছে কি? আমি তাকে রিজিক প্রদান করব। কোনো দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তি আছে কি? আমি তাকে মুক্ত করব। এভাবে সুবহে সাদিক উদয় পর্যন্ত চলতে থাকে। হাদিসের ইমামদের মত অনুযায়ী, এই হাদিসটির সনদ দূর্বল হলেও আমল যোগ্য। এই রাতে যা বর্জনীয় –
১.শবে বরাতের নামে জনসমাগম এড়িয়ে চলা।
২.হালুয়া রুটির সংস্কৃতি, পটকা, আতশবাজি ইত্যাদি একদমই বর্জনীয়।
৩. সম্মিলিত আমল। অর্থাৎ সবাই মিলে একসাথে নফল জামায়াত করে আদায় নিষেধ।
৪. বিশেষ কোন নামাজ নেই, নামাজের নিয়মও নেই। কিছু বইয়েএর আলাদা নামাজের যে বর্ণনা দেয়া আছে তা বানোয়াট, মনগড়া ।
৫. এই রাতে গোসলের কোনো কথা কোথাও বর্ণিত নেই। তাই গোসলের ফজীলত অমুলক।
৬.এ রাতের পরদিন নয় বরং আগের তিনদিন রোজার রাখার কথা হাদিসে বলা হয়েছে ।
🔔পরিশেষে………
শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখার কথা একাধিক হাদিসে এসেছে। রাসূল (সা.) এই মাসে এত রোযা রাখতেন যে উম্মুম মুমিনীনরা বলাবলি করতেন, তিনি বোধহয় আর রোযা ছাড়বেনই না। সুতরাং আমাদের রোজা রাখা উচিত। মহিমান্বিত এই রজনীতে আমরা করোনা মহামারি থেকে বেঁচে থাকার জন্য নিজের ও মুসলিম বিশ্বের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া মোনাজাত করা।
তথ্যসূত্রঃ
▪ শবে বরাত, ড.আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
▪ জাতীয় দৈনিকের ইসলামী সাময়িকী।
▪ আলী আকবর
(৪র্থ বর্ষ) রসায়ন বিভাগ ।
সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর।
মোবাইল : 01956355951