মাধ্যমিকে ‘খড়ের গম্বুজ’ নামক কবিতা পড়ে কবি সম্পর্কে জানার এক প্রবল আগ্রহ জন্মেছিলো মনে। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষের ছাত্র সেই সময়ে এসেছিলো আমার জীবনের সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি। তবে তাকে কোন প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসু বাক্য উপহার দেই নি সেদিন। শুধু তৃপ্ত নয়নে তাকিয়ে ছিলাম তাঁর পানে। সেই স্বাপ্নিক কবি আল মাহমুদের আজ ৮৪তম জন্মবার্ষিক। তাঁর বিদেহী আত্নার প্রতি জ্ঞাপন করছি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা!
আধুনিক বাংলা কবিতায় আল মাহমুদ এক প্রবাদপ্রতীম প্রাণপুরুষের নাম। বর্তমানে বাংলা সাহিত্যে তিনি এক কিংবদন্তি ও শক্তিমান কবি পুরুষ। অসাধারণ তাঁর সাহিত্যপ্রতিভা। কবিতা ও ছোটগল্পে তাঁর রয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য ও জনপ্রিয়তা। বাংলা সাহিত্যে জসীমউদ্দীন সুপরিচিত পল্লী কবি হিসেবে। আর আল মাহমুদকে বলা যেতে পারে আধুনিক লোকজ কবি। আবহমান বাংলার নারী, প্রকৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও লোকজ প্রসঙ্গ তাঁর কবিতার মূল উপজীব্য। এসব বিষয়কে তিনি বুদ্ধিদীপ্ত মনন ও শানিত অনুভূতি দিয়ে তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন। তাঁর কবিতার ভাব ও ভাষায় এমন এক মায়াজাল সৃষ্টি হয় যা পাঠককে একপ্রকার আবিষ্ঠতার সঙ্গে আকৃষ্ট করে রাখে তাঁর কাব্য পাঠে।
কবির সম্পূর্ণ নাম মীর আব্দুস শুকুর আল মাহমুদ, ডাক নাম পিয়ারো।(আল মাহমুদের কবি হয়ে ওঠা: ড. ফজলুল হক তুহিন)। তিনি কবে, কোথায় জন্মেছেন? তাঁর পারিবারিক পরিমণ্ডল কী? সে বর্ণনা কবির ভাষ্য থেকেই জেনে নেই।
‘সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজশাহ ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সিলেট ও উত্তর কুমিল্লা দখলে আনারও প্রায় দুই শতাব্দী পর আমার পূর্বপুরুষগণ একটি ইসলাম প্রচারক দলের সাথে বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলে প্রবেশ করেন। এই অঞ্চলের দক্ষিণ দিকে শাহ রাসিত, উত্তর-পূর্ব দিকে শাহ গেছু দারাজ ও নুর নগর-বরদাখাত অঞ্চলে কাইতলার মীর পরিবারের ব্যাপক প্রচার-প্রচেষ্টায় গ্রামের পর গ্রাম ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কাইতলার মীরদেরই একটি শাখায় আমার উদ্ভব। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে এই পরিবারের এক সুদর্শন যুবক মীর মুনশী নোয়াব আলী পরিবারের অসম্মতিতে পিতৃপুরুষের প্রাচীন শিক্ষাপদ্ধতি ও খানকার বাইরে এসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন এবং পড়াশোনা শেষ করে স্থানীয় আদালতে একটি চাকরি গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর তাঁর কর্মস্থল অর্থাত্ এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রয়োজন হওয়ায় মীর মুনশী নোয়াব আলী স্থানীয় ধনী ব্যবসায়ী জনাব মাক্কু মোল্লার এক কন্যাকে বিবাহ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের গোড়াপত্তনকালে যে সকল প্রভাবশালী হিন্দু-মুসলামন সমগ্র সরাইল পরগণায় নিজেদের প্রতিভা-প্রতিপত্তিতে মানুষের কাছে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন মাক্কু মোল্লা ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি ছিলেন ধনী, দাতা ও পরহেজগার ব্যবসায়ী। মাক্কু মোল্লার পূর্বপুরুষগণ বহিরাগত ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন স্থানীয় মুসলমান। সুলতানী আমলের প্রথম দিকে এই পরিবারটি সম্ভবত ইসলাম গ্রহণ করেন। এদেশের মাটিতে এই মোল্লাদের শিকড় অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে প্রোথিত থাকায় এঁরা ছিলেন এলাকার মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং ধর্মীয় কারণে সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। মুনশী নোয়াব আলীর জন্য এ ধরনের একটি শক্তিশালী পরিবারের আশ্রয় ও সহায়তা একান্ত দরকার থাকায় এই পরিবারে খানে দামান্দ হওয়ার সুযোগ তিনি আনন্দের সাথে গ্রহণ করেন। যদিও এই বিয়ে প্রাচীন পিতৃপরিবারের সাথে তাঁর বিচ্ছিন্নতাকে চিরস্থায়ী করে দেয়। মাত্র পঁচিশ তিরিশ মাইলের ব্যবধানে থেকেও তিনি কাইতলার মীরবাড়ির সাথে, তাঁর পীর পিতৃপুরুষদের সাথে আর সম্পর্ক রাখতে পারেননি। মুনশী নোয়াব আলী আর কাইতলায় ফিরে যাননি। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে তিনি শ্বশুরবাড়িতেই অবস্থান করেন। আর দয়ালু শ্বশুর কন্যা ও জামাতাকে তাঁর অন্যান্য পুত্রদের সমতুল্য মর্যাদা এবং বিপুল সম্পত্তির অংশ দিয়ে মোল্লাবাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দেন। এই হলো আমার প্রপিতামহ মুনশী নোয়াব আলীর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার, মৌড়াইল মোল্লাবাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এই বাড়িতেই ১১ জুলাই, ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে আমার জন্ম।’
আল মাহমুদ তাঁর ‘আমি ও আমার কবিতা’ প্রবন্ধে বলেছেন যে, তাঁর জন্মক্ষণটি ছিল এক বর্ষণমূখর রাত।
কবি তাঁর মাতৃভাষাকে ভালোবাসতেন মনে প্রাণে। পাক স্বৈর শাসকগণ যখন বাংলার বদলে উর্দুকে আমাদের ভাষা হিসেবে চাপাতে চেয়েছিল তখন তিনি কিশোর ছিলেন। তিনি মাতৃভাষার অবমাননা ও ভিন্ন ভাষাকে জাতীয় ভাষার আসনে মানতে নারাজ ছিলেন। বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কি জানতেন যে এই বাংলা ভাষা তাকে করবে অমর। কবির কথা থেকেই আরেকটু উদ্ধৃতি টানছি তাঁর ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা ও সে জন্য লাঞ্ছনার চিত্র পরিস্ফুটনের জন্য। ‘ভাষা আন্দোলন কমিটির একটি লিফলেটে আমার চার লাইন কবিতা যেদিন ছাপা হয়ে মুহম্মদ মুসার কাছে আসে ঠিক সেদিন আমাদের বাড়িতে পুলিশ হানা দেয়। লিফলেটগুলো তখনো বিলি হয়নি। ছাপা ও বিতরণের দায়িত্ব সম্ভবত মুসাকেই দেয়া হয়েছিল, আমার ঠিক মনে নেই। শুধু মনে আছে লিফলেটগুলো যে প্রেসে ছাপা হচ্ছিল আমরা সারাটা সকাল সেখানে কাটিয়ে বাড়ি ফিরছি। আমি আমাদের বাড়ির গেটে এসে পৌঁছামাত্রই পুতুল নামে আমার এক বোন, যে ছিল একদা শোভার সহপাঠিনী, শিক্ষক ও সাংবাদিক গফুর মাস্টারের মেয়ে—কোথা থেকে যেন দৌড়ে এসে বলল, ‘পালাও। তোমাদের ঘরবাড়ি পুলিশ সার্চ করছে। তোমাকে খুঁজছে। বইপত্র সব তছনছ করে কী যেন খুঁজছে।’ আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। যেন একটা বাজপড়া মানুষ। পরক্ষণে সম্বিত্ ঠিক হয়ে গেল। আমি পুতুলকে একটু ঠেলে সরিয়ে অন্দরের দিকে পা বাড়ালাম। কিন্তু পুতুল বাধা হয়ে দাঁড়াল, না, যাবে না। বাহাদুরি? খালুর অবস্থা জান না? এক শ তিন ডিগ্রি জ্বর এখন। খালা মাথায় পানির ধারা দিচ্ছে। তোমাকে এ অবস্থায় ধরে নিয়ে গেলে খালু হার্টফেল করবে। পালাও।’ পুতুল আব্বার অসুখের কথা বলে আমাকে একদম নরম করে দিল। আমি বললাম, ‘পুতুল তুমি কী বলছ, এখন আমি কোথায় পালাব?’ পুতুল ততক্ষণে ঠেলতে ঠেলতে আমাকে রাস্তায় তুলে দিয়েছে, ‘কেন তোমার বিপ্লবী বন্ধু-বান্ধবদের কাছে যাও। তারা অন্তত আজকের দিনটা তোমাকে আড়াল করে রাখুক। পরে দেখা যাবে। খালাকে বলব আমি তোমাকে পথ থেকে ভাগিয়ে দিয়েছি।’ আমি পুতুলকে পেছনে রেখে পূর্বদিকের কলেজের মাঠ পেরিয়ে তিতাসপাড়ের শ্মশানঘাটের দিকে হাঁটা দিলাম। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দের বাড়িতে হানা না দিয়ে পুলিশ আমাদের বাড়িতেই কেন প্রথম সার্চ শুরু করেছে? পরে অবশ্য জেনেছিলাম প্রেস থেকে লিফলেটের কপি আইবির লোকদের হস্তগত হলে তারা লিফলেটের মাথায় আমার নামসহ চার লাইন কবিতা দেখতে পায়। লিফলেটটিতে যেহেতু অন্য কারো নামধাম ছিল না—ছিল শুধু ভাষা আন্দোলন কমিটি শব্দটি, সে কারণে এই আন্দোলনের কারা কারা জড়িত আছে এই তথ্য বের করার জন্য তারা আমাদের বাড়িতে হানা দিয়েছে। যেহেতু চার পঙিক্ত কবিতা রচয়িতার নাম সেখানে আছে সে সূত্র ধরেই তারা সার্চ শুরু করেছে। যদি বাকি লিফলেট উদ্ধার করা যায়।’
সেই পাকিস্তানিদের থেকে স্বাধীকার নিয়ে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
কর্মজীবনে এই ক্ষণজন্মা কবি সংবাদপত্রে লেখালেখির সূত্র ধরে শেখ মুজিব সরকারের সময় এক বছরের জন্য একবার জেল খাটেন । বঙ্গবন্ধু তাকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে বাসায় ডেকে নিয়ে যান। পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে শিল্পকলা একাডেমীর গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক পদে নিয়োগ দেন। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর তিনি পরিচালক হন। পরিচালক হিসেবে ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
তিনি বাংলা সাহিত্যকে করেছেন ঋদ্ধ তাঁর সৃজনশীলতায়। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের বই মিলিয়ে শতাধিক সাহিত্য প্রকাশনা সাহিত্যরস রসিকদের পিপাসা পূরণ করছে।
আল মাহমুদ কেনো একজন শক্তিমান কবি? এ নিয়ে যদি আমরা গবেষণা করি তাহলে অসংখ্য সাহিত্যবোদ্ধা ও প্রাজ্ঞ সমালোচকগণের আলোচনা-সমালোচনার ক্ষেত্রে বিচরণ করতে হয়। সাথে সাথে তাঁর রচিত কালোত্তীর্ণ সাহিত্যগুলোও অধ্যয়ন করতে হয়। বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ সমালোচকগণের সমালোচনার ক্ষেত্র বিচরণ ও কবির আচরিত কর্মগুলো থেকে চুম্বক অংশ তুলে ধরে তাঁর বাংলা সাহিত্যে শক্তিময়তা ও কিংবদন্তির খ্যাতিকে মূল্যায়ন করবো।
প্রথমেই কবির সামসময়িক কবিগণের মধ্যে সৈয়দ আলী আহসান কী বলেছিলেন তা উক্তি করছি। ‘আল মাহমুদের কবিতার মধ্যে আছে গ্রামীণ জীবন ধারার নিরুপদ্রব সততার অহঙ্কার এবং প্রকৃত শব্দ সম্ভারের অসাধারণ অর্থময়তা। যে বিপুল প্রতীতিতে এ শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে, আমাদের কাব্যক্ষেত্রের জন্য তা নতুন এবং একনিষ্ঠ সংযোজন। কবিতার শব্দ ব্যবহারের নিপুণতাই নয়, কিন্তু স্বতঃবেদ্য স্বাভাবিকতা এবং বিশ্বাসের অনুকূলতা নির্মাণে আল মাহমুদ নিঃসংশয়ে আধুনিক বাংলা ভাষার একজন অগ্রগামী কবি। বাংলাভাষার কাব্যকর্মে তার প্রতিষ্ঠার একটি স্বতঃসিদ্ধতা এসেছে।’
পশ্চিম বঙ্গের বিখ্যাত কবি জয় গোস্বামী একটি সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদের কবিতার মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলায় চিরকালের জন্য যে কবিতা থেকে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি, সেই কবিতা তিনি লিখেছেন। আমি অল্প কথায় উচ্ছ্বাস ছাড়া বলতে চেষ্টা করছি। এবং তার কবিতা আশ্চর্য হয়ে যাওয়ার মতন।… ব্যক্তিগত প্রেমের কবিতার মধ্যে সমগ্র দেশকাল এসে মিশছে।’
বাংলা সাহিত্য তাঁর কাছে কতটুকু ঋণী তা বুঝিয়েছেন ‘আবু সাঈদ হাননান’ একটি প্রবন্ধে এই বলে, ‘তাঁর অলোকসামান্য সৃজন প্রবাহে ঋদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্যের শিরা উপশিরা।’
তিনি যে প্রকৃতই একজন শক্তিমান কবি ও কিংবদন্তি তা তাঁর প্রাপ্ত সম্মাননা দেখলে অনুমেয়। কালের কলস আর লোক-লোকান্তর, মাত্র দুটি কবিতা বই প্রকাশের পর কবিতার জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৮)। পেয়েছেন জয়বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৪), জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পুরষ্কার (১৯৭৪), সুফী মোতাহার হোসেন সাহিত্য স্বর্ণপদক (১৯৭৬), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৭), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯০), সমান্তরাল (ভারত) কর্তৃক ভানুসিংহ সম্মাননা পদক- ২০০৪, কবি গোলাম মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন পুরস্কার (২০০৬) সহ অনেক সম্মাননা।
অনেকেই মনে করেন তার চতুর্দশপদীগুলোতে রয়েছে বোদলেরীয় গঠনসৌষ্ঠব, তা ছাড়া তিনি আদ্যোপান্ত মৌলিক। ১৯৮১ সালে তাঁর সনেটগুলির ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে বাংলাদেশের অনুবাদ সাহিত্যের প্রাণ পুরুষ কবীর চৌধুরী তাকে ‘One of the most important poets of bangladesh and that his poetry is unique in many ways’ বলে মন্তব্য করতে দ্বিধা করেননি।
রবীন্দ্র-বিরোধী তিরিশের কবিরা বাংলা কবিতার মাস্তুল পশ্চিমের দিকে ঘুরিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন; আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতাকে বাংলার ঐতিহ্যে প্রোথিত করেছেন মৌলিক কাব্যভাষার সহযোগে তাঁর সহযাত্রী শামসুর রাহমান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের তুলনায় এইখানে তিনি ব্যতিক্রমী ও প্রাগ্রসর।
তিনি শুধু কবি নন। একজন খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক। একজন বিজ্ঞ প্রাবন্ধিক ও প্রশংসিত গল্পকার। তিনি গল্প-উপন্যাস লেখায়ও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ‘শ্রেষ্ঠ আল মাহমুদ’ গ্রন্থের মুখবন্ধে নন্দিত কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন কবি আল মাহমুদের গল্পের স্তুতি লিখেছেন, ‘কী অসাধারণ সব বিষয় গল্পের, কী অসাধারণ ভাষা, কী অসাধারণ বর্ণনা!
তিনি কতটা কিংবদন্তী তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে, তাঁর আলোচিত ছোটগল্প ‘জলবেশ্যা’ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র ‘টান’। কলকাতার পরিচালক মুকুল রায় চৌধুরী ছবিটি নির্মাণ করেছেন।(প্রথম আলো, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪)
গতবছর ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশে এক প্রতিহিংসার চিত্র দেখা যায়। তিনি একজন কিংবদন্তি কবি ও লেখক। সে হিশেবে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে নেয়ার এক প্রবল দাবি উত্থাপিত হয়েছিলো সাধারণ পাঠক ও দেশবাসীর পক্ষ থেকে। কিন্তু তথাকথিত প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারীদের মানসিক ঔদার্য না থাকায় তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছিলো দেশবাসীর কাছে। এমন কী কবিকে ঢাকার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানেও সমাহিত করার একটু জায়গাও জুটে নি। কবি কি কোনো দলের সম্পত্তি? কবি কি কারো ব্যক্তিক? একজন কবি সার্বজনীন। তিনি সবার সম্পত্তি। অযথা এসব বিষয় নিয়ে জল ঘোলা করা কোনো প্রকৃত শিল্পমানসের কাজ হতে পারে না। যারা করে তারা স্বার্থান্বেষী মহল। কবি তাঁর একটি কবিতায় লিখেছিলেন,
‘আমার কেবল ইচ্ছে জাগে
নদীর কাছে থাকতে,
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মতো ডাকতে।
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলীর কূলটায়,
দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি
ফেরেস্তারা উল্টায়।
তখন কেবল ভাবতে থাকি
কেমন করে উড়বো,
কেমন করে শহর ছেড়ে
সবুজ গাঁয়ে ঘুরবো !
তোমরা যখন শিখছো পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি না হয় পাখিই হবো,
পাখির মতো বন্য।’
এই পাখির মতো বন্য হতে চাওয়াটাই কবুল হয়ে গেছে। তাঁর কাব্য যে তিতাস ও লোকজ আবহে ঋদ্ধ সেই তিতাসের পাড়ে গ্রামীণ আবহে কবির শেষ আবাস হয়েছে।
যতই মৌলবাদী নামক চাপিয়ে দেয়া অপবাদ তাঁর উপর আরোপ করা হোক না কেনো, তিনি তাঁর সৃজনের মাধ্যমে বাংলাভাষী মানুষ, বাংলাদেশের মানুষের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন। সেখানে কালিমার কোনো ছিটেফোঁটা লাগবে না। অধিকন্তু যারা স্বার্থান্বেষণ করে চাটুকারিতায় লিপ্ত হয়ে শিল্পের এ পবিত্র অঙ্গনকে কলুষিত করছে তারা মৃত্যবরণের সাথে সাথেই মুছে যাবে শিল্পের এ অঙ্গন থেকে। শিল্পের সোনালী ইতিহাসের এক আস্তাকুঁড়ে খুঁজেও পাওয়া যেতে পারে তাদের।
উপর্যুক্ত আলোচনা ও পর্যালোচনা থেকে একথা দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলা যায় যে, আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যের একজন কিংবদন্তি ও শক্তিমান কবি। তাঁর জন্মদিনে এ আকাঙ্ক্ষাটি করতে পারি যে, শক্তিমান কবি ও কিংবদন্তি আল মাহমুদ হোক উম্মোচিত সকল অপপ্রচার ও পরশ্রীকাতরতা থেকে।
মীম মিজান
প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, গল্পকার
এম ফিল গবেষক; ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়