করোনাভাইরাস অনেক প্রতিষ্ঠিত বার্ষিক রীতি যেমন পরীক্ষা ও ভর্তিকে থামিয়ে রেখেছে। প্রথম লকডাউন এসেছিল বোর্ড পরীক্ষার মাঝামাঝি সময়ে। কিছু সময়ের জন্য আশা ছিল, যে বিষয়ের পরীক্ষাগুলো নির্ধারিত সময়ে হয়নি তা নেয়ার জন্য হয়তো অচিরেই সুযোগ পাওয়া যাবে। এখন ফল ঘোষণার জন্য বোর্ড অন্য উপায়ের খোঁজ পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের পরীক্ষাগুলো বাতিল করা হয়েছে। এই একাডেমিক রীতিগুলো অলঙ্ঘনীয় কিন্তু ভাইরাস পেরেছে সেগুলোকে আটকে দিতে। বিবাহও একইভাবে অলঙ্ঘনীয়, যা সামাজিক মর্যাদাগুলোর মাঝে অনেক উচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত। পরীক্ষা থামিয়ে রাখা যায়, কিন্তু বিয়ে থামিয়ে রাখা যায় না।
উদাসীনতার বিপদ
বিহারে অদ্ভুত এক ট্র্যাজেডি দেখা গেছে যখন গত মাসে একজন ইঞ্জিনিয়ার তার বাবাকে তার বিয়ে থামানোর জন্য রাজি করাতে পারেনি। তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ বোধ করছিলেন না, কিন্তু তার অনুরোধ কেউ পাত্তা দেয়নি। খবরে প্রকাশিত সংবাদ বলছে, বিয়ের দুদিন পর তিনি মারা যান। পরবর্তীকালে সেই বিয়েতে উপস্থিত একশর বেশি মানুষকে করোনায় সংক্রমিত হতে দেখা গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি সামলানো কতটা কঠিন হতে পারে, সেটি বুঝতে পেরে ভুবনেশ্বরের প্রশাসন এই মর্মে আদেশ জারি করেছে যে জেলার উচ্চ সংক্রমণ বিবেচনায় নিয়ে বিয়ের আগে বরকে দুই সপ্তাহের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। যদিও কনের পরিবার এই বাড়তি খরচের দায় নিতে রাজি হবে কিনা তা নিশ্চিত না। তাছাড়া কোয়ারেন্টিন ক্যাম্পে কতজন লোক বরের সঙ্গে থাকবে তাও পরিষ্কার না।
আপাতত, এই প্রশ্নগুলো অপ্রত্যক্ষভাবে প্রাসঙ্গিক। ভারতে বিয়ের মৌসুম সাধারণত বজায় থাকে ১১ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত। জুন মাসে বিবাহসম্পর্কিত ভাইরাসের বিস্তৃতি নিয়ে আলাদা করে কেউ ভেবেছে বলে মনে হয় না। এমনকি জুনের শেষ দিনে যে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে সেদিনের সংক্রমণ থেকে আজকেও ভাইরাস হতে পারে। কারণ সংক্রমিত হওয়ার পর উপসর্গ দেখা দিতে অনেক সময় দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত লাগতে পারে। এটা নির্ভর করছে উপস্থিত অতিথিরা মাস্ক পরেছে কিনা এবং সামাজিক দূরত্বের নীতি মেনে চলেছে কিনা তার ওপর। যদিও খাওয়ার সময় এবং ফটোশুটের সময় মাস্ক খুলতে হয়। যার ফলে ঝুঁকি থাকছেই।
সামাজিক চাপ
যদিও অনুমোদিত মৌসুমটি অক্টোবরের আগে ফিরতে যাচ্ছে না। তার পরও ব্যতিক্রম কিছু ঘটার সম্ভাবনা রয়েই যায়। যা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। দম্পতির চেয়েও দুই পরিবারের লোকেরা একধরনের বাধ্যবাধকতার পরিবেশ সৃষ্টি করে। বিহারের ঘটনায় উভয় পক্ষই মনে করেছে, যদি বরের অনুরোধে নির্ধারিত সময়ে বিয়ে না হয় তবে আয়োজনে যে খরচ করা হয়েছে তা নষ্ট হয়ে যাবে। তার জ্বর ছিল, কিন্তু তার পরও তিনি তার বাবা-মাকে মানাতে পারেননি। এ সময় জ্বর থামাতে তিনি প্যারাসিটামলও নিয়েছিলেন।
বিয়ে এমন কী যে যা বন্ধ করা যায় না কয়েক সপ্তাহ কিংবা কয়েক মাসের জন্য? করোনা মহামারী গত কয়েক মাসে আমাদের জীবনের প্রচলিত বিষয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও বিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন গল্প। বিয়ের সঙ্গে করোনার যুদ্ধ মাত্র শুরু হলো। আমরা কেবল আশা করতে পারি যে অক্টোবরে বিয়ের মৌসুম শুরুর আগে করোনা চলে যাবে। যদিও এপ্রিলে লকডাউনের শুরুতেও বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যদিও তা বেশ কঠোরতার সঙ্গেই হয়েছিল। কিন্তু এও মেনে নিতে হবে যে সে সময়ে একটি বিয়ে ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছি। সরাসরি চাপ ছিল বরের বাবার কাছ থেকে। তিনি সার্জারির জন্য অপেক্ষা করছিলেন এবং ফিরে আসার ব্যাপারে অনিশ্চিত ছিলেন। দেখা গেল বিয়ে তার মানসিক প্রশান্তি আনতে ভূমিকা রেখেছে এবং তিনি সার্জারির পর বেঁচে ফিরেছেন। এখন নতুন বউ তার দেখাশোনা করছে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাবা-মার ইচ্ছেটাই সবার ওপারে থাকে। বিশেষ করে এটা মূলত বাবার ইচ্ছের ব্যাপার। যার কোনো ব্যতিক্রম হতে পারে না। বাবা-পুত্রের সম্পর্কে পুত্রের ইচ্ছের জন্য খুব অল্পই জায়গা থাকে। যদিও স্টেরিওটাইপ তৈরির কোনো অর্থ নেই, অনেক ছেলেই বিদ্রোহ করে থাকে কিন্তু একটা সাংস্কৃতি প্যাটার্নও এখানে উপস্থিত থাকে। এমনকি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনার বিষয় বাছাই করার ক্ষেত্রে ছেলেরা বলে তারা তাদের বাবার ইচ্ছের অনুসারী হয়েছে। একই উত্তর বৈবাহিক অংশীদার বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
জীবন বনাম প্রথা
ফিকশন ও ফিল্মের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বেশি পরিচিত। যার তীব্র চিত্র পাওয়া যায় ১৯৭৪ সালের ছবি ২৭ ডাউনে। একবার সেই ছবি দেখলে আপনারা বুঝতে পারবেন কেন পুত্ররা বাবার চাপে নতি স্বীকার করে। এটি রামেশ বকশির উপন্যাস অবলম্বনে বানানো। এই দীর্ঘ ও জটিল নাটকীয়তার উন্মোচন ঘটে শৈশব দিয়ে। এরপর ছেলের অসহায়ত্ববোধ এবং বাবার অসামান্য আধিপত্যে ছেলের ওপর যে চাপ তৈরি হয় তাও ফুটে ওঠে। এই ছবি দেখার ৪০ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এখন আমি যখনই কভিড-১৯-এ বরের মৃত্যুর কথা শুনি এ ছবিটাই যেন বারবার ফিরে আসে।
মেইল টুডে