দেশ রুপান্তরের খবর
দেশে করোনার সংক্রমণ সহসাই কমার কোনো লক্ষণ নেই। বরং সংক্রমণ ও মৃত্যুহার আগামী জুলাই পর্যন্ত বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আগস্টের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সংক্রমণ একটা জায়গায় স্থির থাকার পর ধীরে ধীরে কমতে পারে। তবে এসবই নির্ভর করছে সংক্রমণ ঠেকাতে কতটা দ্রুত লকডাউন শুরু করা যায় ও লকডাউন কতটা সফল হয়, সেটার ওপর।
এ সময় আক্রান্তদের শনাক্ত করার পাশাপাশি তাদের সংস্পর্শে যাওয়া জনগোষ্ঠীকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে নেওয়ার ওপরও নির্ভর করছে সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি। আর যদি লকডাউন সঠিকভাবে করা না যায়, তাহলে করোনার সংক্রমণ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। এরপর সংক্রমণ একসময় কমতে থাকবে। তবে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ব্যাপকহারে বাড়বে।
দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সময় লাগতে পারে এমনটা মনে করছেন সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারাও। তাদের মতে, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগবে বলেই মনে হচ্ছে। তাই মানুষের জীবনযাপন ও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সবকিছু বিবেচনায় রেখে করোনা নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়েই এগোতে হচ্ছে। যেহেতু করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগবে, তাই সবকিছু একসঙ্গে বন্ধ না করে ধাপে ধাপে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে লকডাউন দেওয়া হবে।
এমন অবস্থায় গতকাল বুধবার দেশে করোনায় এক দিনে আক্রান্তের সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে এবং গত ২৪ ঘণ্টায় এই প্রথম আক্রান্তের সংখ্যা চার হাজারের ঘর পেরিয়েছে।
আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৮ জন। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৯৮ হাজার ৪৮৯ জন। ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তদের মধ্যে আরও ৪৩ জন মারা গেছেন। মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৩০৫ জন।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম কভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ওই মাসের শেষদিকেই দেশজুড়ে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সবকিছু বন্ধ করে দেয় সরকার ও তা চলে টানা দুই মাস। গত ৩১ মে সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার কিছুদিন আগে ঈদ সামনে রেখে বিধিনিষেধ শিথিল করে বিপণিবিতান ও দোকানপাট খুলতে শুরু করার পর বাড়তে থাকে সংক্রমণ। বিশেষ করে ১ জুন থেকে অফিসের পাশাপাশি গণপরিবহনও চালু হওয়ার পর প্রায় প্রতিদিনই করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত ও এতে মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে। মৃত্যুও বেড়েছে কয়েকগুণ। গত ২৬ মে পর্যন্ত ৭৯ দিনে যেখানে শনাক্ত ছিল ২৮ হাজার ৬৫০ জন, সেখানে গত ২১ দিনেই শনাক্ত হয়েছেন ৬৫ হাজার ৮৩১ এবং মোট রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ৪৮১ জনে। মৃতের সংখ্যাও বেড়ে ১ হাজার ২৬২ জন হয়েছে।
এমনকি আক্রান্তের সংখ্যায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে ১৮ নম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের ওপরে শীর্ষ আক্রান্ত ১৭টি দেশ রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের ওপরে ১৭ নম্বরে থাকা কানাডায় বাংলাদেশের চেয়ে মাত্র ৯৭৮ জন রোগী বেশি। অর্থাৎ আগামী ২৪ ঘণ্টায় কানাডাকে ছাড়িয়ে শীর্ষ আক্রান্তের ১৭ নম্বর দেশে পৌঁছে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশের। এর আগে বাংলাদেশ চীনকে অতিক্রম করেছে। চীন ১৯ নম্বরে রয়েছে।
শীর্ষ আক্রান্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ক্রমেই ওপরের দিকে উঠতে থাকলেও এখনো ওইসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পরীক্ষার ও সুস্থতার হার একেবারেই নিচের দিকে। শীর্ষ ২০ দেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে বাংলাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষা হয়েছে ৩ হাজার ৩৪৯ জনের, যা সর্বনিম্ন থেকে দুই নম্বরে। অর্থাৎ এই ২০ দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম পরীক্ষা হয়েছে মেক্সিকোর। এছাড়া আক্রান্তদের সুস্থ হওয়ার হারেও ২০ দেশের মধ্যে নিচের দিক থেকে দুই নম্বরে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে সুস্থতার হার ৩৮ দশমিক ৮ শতাংশ। সবচেয়ে নিচে রয়েছে পাকিস্তান, ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ।
করোনার এমন ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের ধারায় দেশের মানুষ খুবই উদ্বিগ্ন। ঠিকমতো পরীক্ষা করাতে পারছেন না। বহু কষ্টে পরীক্ষা করাতে পারলেও ফল পেতে দেরি হচ্ছে। চিকিৎসা পেতেও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে রোগীদের। বিশেষ করে অক্সিজেনের অভাবে হাসপাতালগুলোতে রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এমন অবস্থায় প্রতিদিনই মানুষ জানতে চাইছে কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। করোনার সংক্রমণ কমবে।
করোনার সার্বিক পরিস্থিতির ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, টেস্ট করছি, বাড়ছে, মানুষ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়েছে। ফলে ক্রমেই সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে। একপর্যায়ে এসে হয়তো কমে যাবে, বাড়বে না। তবে এটা বাস্তবতা যে কভিড আরও থাকবে। কাজেই সে অনুযায়ী আমরা আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা বৃদ্ধি করব।
লকডাউন প্রসঙ্গে মহাপরিচালক বলেন, লকডাউন সারা বাংলাদেশে একসঙ্গে হবে না। করার প্রয়োজনও হবে না। পরিস্থিতি যেখানে বলবে লকডাউন করার দরকার, রেড জোন দরকার, সেখানেই হবে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। যখন কেউ মনে করবে এখানে দরকার, আমাদের কাছে অনুমতি চাইবে, আমরা দেখব। একসময় একসঙ্গে পুরো বাংলাদেশে হবে না। ঢাকায় শুরু হয়েছে। যদি এক, দুই বা তিন মাসের ব্যাপার হতো, তাহলে মানুষকে বন্দি করে রাখা যেত। কিন্তু করোনা যেহেতু এখন দীর্ঘস্থায়ী হবে বলেই মনে হচ্ছে, কাজেই আমাদের পরিকল্পনাও ওইভাবে করতে হবে। কীভাবে বেঁচে থাকা যায়, সেটাও ভাবতে হবে।
দীর্ঘস্থায়ীর ব্যাখ্যা দিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, করোনা দীর্ঘস্থায়ী হবে, সেটা সারা পৃথিবীর বাস্তবতা। এটা সহসাই যাচ্ছে না। কাজেই আমাদের সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে হবে। আগে যেমন মাস্ক ছাড়া চলতাম, এখন মাস্ক পরে চলতে হবে। এটাই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দোকানপাটও খোলা থাকবে। মানুষ কেনাকাটাও করবে। কারণ মানুষকে তো বাঁচতে হবে।
কবে নাগাদ করোনার সংক্রমণ কমতে পারে বা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে, এমন কোনো সার্ভিল্যান্স করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এটা খুব কঠিন প্রশ্ন। কারণ করোনার কোনো সার্ভিল্যান্সই কোনো দেশেই যে খুব একটা সফল হচ্ছে, তা নয়। কারণ ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি এত দ্রুত বদলে যায় যে, সেখান থেকে কোনো ধারণা করা খুব কঠিন। আমরা কিছু সার্ভিল্যান্স করেছি, সেটা আমাদের প্রস্তুতির জন্য, তবে সেটা জনসম্মুখে বলার জন্য নয়। তবে এটুকু বলতে পারি, খুব সহসা আমরা সুদিন চোখে দেখছি না। আশাব্যঞ্জক কিছু এখনো দেখছি না।
সংক্রমণের ‘পিক’ (চূড়া) প্রসঙ্গে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, আমরা একসময় একটা লেভেলে ছিলাম, সেখান থেকে হঠাৎ করে বাড়তে শুরু করেছে। আমরা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করি, কীভাবে সামাজিক দূরত্বটা পালন করি, তার ওপর নির্ভর করে ‘পিক’ পেছাবে নাকি আগে শেষ হয়ে যাবে। অনেকগুলো ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভরশীল। তিনি আরও বলেন, একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে সংক্রমণের হার আগের থেকে বেড়েছে। যখন এ হার একের নিচে থাকে তখন এটাকে আমরা বলি যে সংক্রমণ প্রতিরোধ ভালো হচ্ছে বা কমার দিকে। এ হার ১ দশমিক ২ পর্যন্ত নেমেছিল, এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে। তার মানে সংক্রমণ বাড়ছে।
করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার যে আট সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে, সে কমিটির এক বিশেষজ্ঞ সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে বাড়তে বাড়তে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত হয়ে যাবে। বর্তমান যে অবস্থা, তাতে মনে হচ্ছে না এটা জুলাইয়ে গিয়ে কমবে। এখনো যদি সাবধান হতে পারি, এখনো যদি স্বাস্থ্যবিধিসহ নিয়ন্ত্রণে নেওয়া পদক্ষেপ, সবকিছু যদি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি, তাহলে হয়তো কমবে। আর যদি কন্ট্রোলে না এনে সবকিছু এখনকার মতো খোলা থাকে, তাতে সংক্রমণ বাড়তে থাকবে। দেরিতে কমবে। যত বেশি জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ ও নির্দেশনাগুলো পালন করতে পারব, তত তাড়াতাড়ি কমবে। এ ব্যাপারে সবরকমের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা করোনা নিয়ন্ত্রণে যেসব পদ্ধতি বা উদ্যোগ নিয়েছি, সেগুলো ঠিক হয়নি বলেই সংক্রমণ বাড়ছে। ঈদের সময় সবকিছু তো প্রশাসনই খুলে দিল। অফিস খুলে দিয়েছে। লকডাউন করেও বাসায় রাখতে পারেনি। দোকানপাট সব খুলে দিয়েছে। তাহলে তো বাড়বেই।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাহলে উপায় কী জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঠিক কবে বা কখন নাগাদ সংক্রমণ কমতে শুরু করবে বা আরও বাড়বে কি না, এটা নির্ভর করছে রোগটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া পদক্ষেপগুলো কেমন হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে সংক্রমণের প্ল্যাটিউ (ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ যখন নেমে সমান্তরালে আসে) পেয়ে গেছে, সেখানে বাংলাদেশে তিন মাস পরও সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। অর্থাৎ অন্য দেশগুলো যে সময়ে প্ল্যাটিউ পেল, আমরা সে সময়ে পেলাম না। না পাওয়ার কারণ যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো সফল বা কার্যকর হয়নি। যদি হতো তাহলে অন্য দেশের মতো আমাদের এখানেও এখন সংক্রমণ নিম্নমুখী হতো। এখন সামনের দিনে যদি পদক্ষেপগুলো ঠিকমতো না হয়, তাহলে আমাদের সংক্রমণের রেখা সমান্তরালে আসতে আরও দেরি হবে।
এ বিশেষজ্ঞ বলেন, জুলাই নাগাদ রোগী আরও বেড়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা যদি সংক্রমণ ঠেকাতে না পারি, তাহলে পৌনঃপুনিক হারে বাড়তে থাকবে। একজন থেকে দুজন, দুজন থেকে চারজন, চারজন থেকে ১৬ জন এ হারে বাড়বে। এভাবেই তো বাড়ছে। ৮ মার্চের পর ৫ এপ্রিল পর্যন্ত এক-দুই-তিনটা কেস। ৫ এপ্রিল থেকে ৩০ মে পর্যন্ত ১০০-২০০-৩০০-৪০০ কেস। জুন থেকে সেটা হাজারে উঠে এখন চার হাজার পেরিয়েছে। এখন সেটা হয়তো পাঁচ-ছয় বা আট হাজার হবে। সামনের দিনগুলোতে যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে অবশ্যই রোগী বেড়ে যাবে।
ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, এখন যদি জোনিং সিস্টেমটা ভালো করে কার্যকর করতে পারে, যতগুলো রেড ও ইয়েলো জোন আছে, সেখানে যতগুলো হটস্পট আছে, সেই হটস্পটের সংক্রমণ যদি থামিয়ে দেওয়া যায়, নিদেনপক্ষে কমিয়ে দেওয়া যায়, তখন হয়তোবা আমরা ‘পিক’টা দেখতে পাব। আর যদি এসব ঠিকমতো না হয়, তাহলে আমাদের সংক্রমণ কমতে সময় লাগবে। লকডাউনে প্রাধান্য দেওয়া উচিত নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ। সে ক্ষেত্রে নেতৃত্ব থাকা উচিত ছিল জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দলের। তারা ওই জায়গায় রোগ প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ করবে, শনাক্ত করবে, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন করবে। কিন্তু সেখান নেতৃত্বটা ডিসির অথবা ওয়ার্ড কাউন্সিলরের। কেউই তো মেডিকেল পারসন নন। তারা বুঝবেন কীভাবে। অথচ তারাই নেতৃত্ব দেবেন। স্বাস্থ্য বিভাগ পরামর্শ দেবে। সেটা তারা শুনতেও পারে, নাও শুনতে পারে। সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যগত বিষয় উপেক্ষিত হতে পারে।