ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশ করা হয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত গবেষণা সাময়িকীতে। বিশেষজ্ঞরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন গবেষণা এবং তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহের পদ্ধতি নিয়ে। তথ্য–উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে গবেষকেরা যে উপসংহারে পৌঁছান, সেটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। একাধিক বিশেষজ্ঞ সন্তুষ্ট হলে তবেই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। সাময়িকীগুলোর খ্যাতি নির্ভর করে তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা যাচাইয়ের মানসম্মত বিচার–বিশ্লেষণের ওপর। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সবচেয়ে নামকরা সাময়িকীর অন্যতম হলো ‘ল্যানসেট’। ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান। অক্সফোর্ডের করোনাভাইরাসের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে ল্যানসেটে। নতুন ওষুধ বা টিকা মানবশরীরে কার্যকর ও নিরাপদ কি না, তা জানার জন্য তিনটি ধাপে পরীক্ষা করা হয়। প্রথম দুটি ধাপে ভ্যাকসিনটি নিরাপদ এবং প্রাথমিকভাবে কার্যকর কি না, তা পরীক্ষা করা হয়
মনে রাখতে হবে, ভ্যাকসিন শুধু কার্যকর হলেই হবে না, নিরাপদ হতে হবে। প্রত্যেক ওষুধ বা টিকার কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাত্রাটা মানবদেহে সহনশীল হতে হবে। ওষুধের কার্যকর মাত্রা বা পরিমাণও নির্ধারণ করা হয় এই ধাপগুলোয়। প্রকাশিত ফলাফলে দুটি বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেছে। টিকা কি নিরাপদ? ক্লান্তি, শরীর এবং মাথাব্যথা ছাড়া তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। টিকাটি পুরো মাত্রায় নিরাপদ ও সহনশীল কি না, সেটা নিশ্চিত হওয়া যাবে আরও বেশি মানুষের ওপর দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষার পর। দ্বিতীয় যে বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে, সেটি হলো পরীক্ষামূলক টিকাটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরি করে। এই প্রতিরোধব্যবস্থার স্থায়িত্ব এবং টিকাটি ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিহত করে অসুস্থতা ঠেকাতে বা অসুস্থতার মাত্রা কমাতে পারবে কি না, সেটা এই পরীক্ষা থেকে জানা যায়নি। এ এগুলোর জন্য আরও বেশি মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে সম্প্রসারিত পরীক্ষার প্রয়োজন, যেগুলো ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে ব্রিটেন, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আমেরিকায়। ব্রিটেনে সংক্রমণ অনেক কমে যাওয়ায় সংক্রমণের হার এখনো উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি—এমন দেশগুলোয় ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
অক্সফোর্ডের প্রাথমিক ফলাফল নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। কেন? বলছি। ভাইরাস হলো শরীরের শত্রু। শত্রুকে হারাতে প্রথম কাজ হলো তাকে শনাক্ত করা। এই কাজ করে থাকে সাধারণ অ্যান্টিবডি। শরীরের গোয়েন্দা। সাধারণ অ্যান্টিবডি ভাইরাস দেখামাত্র তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। গায়ে গা সেটিয়ে থাকে। একটি ভাইরাস চিহ্নিত করতে দুটি অ্যান্টিবডি যথেষ্ট। আরেক ধরনের অ্যান্টিবডি আছে। সম্ভ্রান্ত। গোয়েন্দা, সঙ্গে মারণাস্ত্র। প্রশিক্ষিত, অস্ত্র চালনায় পারদর্শী। এরা ভাইরাসকে শনাক্ত করে এবং সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এদের বলা হয় নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত যোদ্ধা। বুঝতেই পারছেন, শত্রুকে শনাক্ত করে সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলতে পারলে যুদ্ধে আপনি অনেকটা এগিয়ে। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন এই দুই ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন যাদের একবার প্রয়োগ করা হয়েছিল, তাদের ৯১ শতাংশের শরীরে এই বিশেষ ধরনের অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। শতভাগ নিশ্চিত হওয়া গেছে যাদের শরীরে দুবার দেওয়া হয়েছে। তবে কত দিন এই অ্যান্টিবডি সক্রিয় থাকে, সেটা এখনো জানা যায়নি।
প্রকল্পে যুক্ত অন্যতম গবেষক অ্যান্ড্রু পোলার্ড বলেছেন, ‘উৎসাহিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। এই টিকা সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে—এমন প্রমাণ আছে। তবে ভাইরাস রুখে দেওয়ার জন্য কি পরিমাণ অ্যান্টিবডি প্রয়োজন, তা আমাদের জানা নেই। পুরো মাত্রায় টিকাটি কার্যকর কি না, তা জানার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’
আশার কথা শুনিয়েছেন গবেষণা দলের অন্যতম অ্যাড্রিয়ান হিল। তিনি বলেছেন, ‘করোনামুক্ত রোগীর শরীরে যে পরিমাণ অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে, পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন সমপরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম।’
এ বছরের শেষ নাগাদ নিশ্চিত ফলাফল মিলবে। সেই পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সংক্রমণ অনেকটাই রুখে দেওয়া সম্ভব। পুরোপুরি রুখে দিতে আরও সময় দরকার। তবে অপেক্ষার পালা কমতে শুরু করেছে।
সুব্রত বোস: প্রবাসী বাংলাদেশি ও বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালস অ্যানালিটিকসের গ্লোবাল প্রধান।
subratabose01@yahoo.com