হবিগঞ্জের বিখ্যাত
মাটির বিস্কুট। এখনো আফ্রিকার অনেক দরিদ্র দেশ খেয়ে থাকে। তবে জানেন কি? এককালে বাংলাদেশের মানুষও ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে মাটির বিস্কুট খেত। বিষয়টি অবিশ্বাস্য হলেও সত্যিই। এই বিখ্যাত পোড়ামাটির বিস্কুট তৈরি হত হবিগঞ্জসহ সিলেটের কিছু অঞ্চলে
এঁটেল মাটির তৈরি এই বিস্কুট ‘ছিকর’ নামেই পরিচিত ছিল। ৭০-৯০ এর দশকে ‘ছিকর’ হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন গ্রামে নিম্নবিত্ত সমাজে প্রচলিত এক বিশেষ আহার্য ছিল। অনেকের মতে, শুধু ক্ষুধা নিবারণের জন্যই নয় বরং এক ধরনের অভ্যাসের বশেই লোকজন ছিকর খেত।
যেভাবে তৈরি হত মাটির বিস্কুট ‘ছিকর’
ছিকর একটি ফারসি শব্দ। ছিয়া মানে কালো আর কর মানে মাটি। ছিয়াকর শব্দটিই পরে ছিকর হয়ে গেছে। ছিকর তৈরি হত এক ধরনের পোড়া মাটি দিয়ে।
মাটির বিস্কুট
পাহাড়ি টিলায় গর্ত খুঁড়ে লম্বা বাঁশের সাহায্যে গভীর থেকে এক ধরনের মিহি মাটি সংগ্রহ হত। তারপর তা মাখিয়ে খাই বানিয়ে ছাঁচে ফেলে প্রথমে তৈরি করা হতো মন্ড। তারপর তা পছন্দ মত কেটে টুকরো করা হত।
পরে বিশেষ এক পদ্ধতিতে সেই টুকরো আগুনে পুড়িয়ে তৈরি করা হতো ছিকর। ছিকর বিভিন্ন আকৃতির করে তৈরি করা হত। কোনোটি দেখতে বিস্কুটের মতো আবার কোনোটি ললিপপের মতো লম্বা ছিল।
বিভিন্ন এলাকার ছিকর বিভিন্ন স্বাদের ছিল। কোনো এলাকার ছিকরে খাই মাখানোর সময় গোলাপজল, আদার রস ইত্যাদি মেশানো হত। যা মাটির সঙ্গে পোড়ানোর পর ভিন্ন এক স্বাদ হত।
বিভিন্ন আকারের হত এই বিস্কুটগুলো
বিশিষ্ট লেখক দেওয়ান মাসুদুর রহমান চৌধুরী জানান, মাটিকে ভিজিয়ে নরম করে রুটির মতো ছোট ছোট টুকরার মাধ্যমে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুধু আগুনের ধোঁয়া দিয়ে পুড়িয়ে তৈরি করা হতো ছিকর।
বিখ্যাত মাটির বিস্কুট ছিকর
জানা যায়, গর্ভবতী নারীদের কাছে ছিকর অতি পছন্দের খাবার ছিল। তাদের ধারণা ছিল, এটি খেলে রোগ-বালাই হতে রক্ষা পাওয়া যাবে। সেইসঙ্গে পেটের বাচ্চা সুস্থ থাকবে। যদিও এই ধারণার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা প্রমাণ আছে কিনা তা জানা যায়নি।
মৌলভীবাজারে পাহাড়ি এলাকায় হিন্দু সম্পদায়ের মানুষ বসবাস করত। তারা স্থানীয়ভাবে ‘ডুকলা’ নামে পরিচিত। এদের মধ্যে নারীরা এসব ছিকর তৈরি করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করত।
এভাবেই ঝুঁড়িতে করে বিক্রি করা হত এই বিস্কুট
আবার স্থানীয় কুমার সম্প্রদায় বা মৃৎ শিল্পীদের কেউ কেউ ছিকর তৈরি করে বাজারজাত করতেন। দিনে দিনে ক্রেতার সংখ্যা কমে যাওয়ায় ছিকর এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।
নবীগঞ্জ উপজেলার দিনারপুরে পাহাড়ি টিলা থেকে একসময় বিভিন্ন এলাকার কুমাররা এসে মিহি মাটি সংগ্রহ করতেন। তবে এখন এই কাজের সঙ্গে তেমন কেউ জড়িত নেই। এখন আর কেউ মাটি সংগ্রহ করতে যায় না।
এছাড়াও বানিয়াচং, বাহুবল ও মাধবপুরের বিভিন্ন জায়গায় ছিকরের উপযোগী মাটি আহরণের ক্ষেত্র ছিল। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিভিন্ন গ্রাম্য বাজারে ঘুরেই এখন আর ছিকরের সন্ধান মেলেনি।